শুক্রবার ২৬শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১৩ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

শিরোনাম >>
শিরোনাম >>

আমার ডায়েরীতে সাংবাদিক ড্যানিয়েল পার্ল অত:পর

  |   রবিবার, ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২২ | প্রিন্ট

আমার ডায়েরীতে সাংবাদিক ড্যানিয়েল পার্ল অত:পর

ডায়েরি? ডায়েরি হচ্ছে ব্যক্তিগত দিনলিপি সংক্ষণের এক বহুল প্রচলিত বার্তা মাধ্যম। জীবনের কোন না কোন সময়ে প্রায় সকল মানুষ-ই ডায়েরি লিখে যায়। প্রতিদিন বা প্রতি মুহুর্ত অতি সহজ সরল বর্ণনা-ই ডায়েরির পাতা জুড়ে অবস্থান করে। কিন্ত অনেক সময় আজকের অতি সামান্য কিংবা স্বাভাবিক ঘটনা-ই হয়ে যায় অপ্রতিরোধ্য ভবিষ্যতের ইতিহাস। জীবনের ডায়েরিতে গুরুত্বহীন কোনো ঘটনা-ই অনেক সময় হয়ে উঠে ইতিহাসের দলিল। যদিও ডায়েরি কারো ব্যক্তিগত জীবনের প্রতিচ্ছবির মুহুর্ত তবুও এই ডায়েরিতে প্রকাশিত অতীতের অনুভুতি গুলো কালের সাক্ষী হয়ে আমাদেরকে শোনায় ইতিহাসের গল্প। যে গল্প ব্যক্তি,পরিবার,সমাজ,দেশ ও জাতির চক্ষু খোলে দিয়ে ভবিষ্যতের পথ উন্মোচন করে দেয়। এই জীবন ডায়েরি লিখে ইতিহাসের পাতায় অনেকে সু-খ্যাতি অর্জন করে আছেন। আমরা এই ডায়েরির মাধ্যমে আজকের ডিজিটাল যুগে বসে জেনেছি প্রাচীন সময়ের নিখাত বর্ণনা।

পৃথিবীর বিখ্যাত মানুষ গুলোর ডায়েরি হয়ে উঠেছে ইতিহাসের দিকপাল। এই দিকপাল ডায়েরির মাঝে বাঙ্গালী জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানের ডায়েরি অবল্মনে বঙ্গবন্ধুর আত্নজীবনি, স্যামুয়েল পেপিসের ডায়েরি, ক্যাপ্টেন স্কটের জার্নাল, নেলা লাস্টের ডায়েরি, লেনা মুখিনার ডায়েরি, নেলসন ম্যান্ডেলার কনভারসেশনস উইথ মাইসেল্ফ ডায়েরি গুলো তাদের নিজ নিজ জাতি সত্বাকে ভাবিয়েছে। তাদের ডায়েরিতে বাস্তব অভিজ্ঞতার মনের মাধুরি হয়ে উঠে জাতির প্রেরণা। তেমনি আমার ডাযেরি লেখার অভ্যাস ছিল। সাংবাদিকতার আড়ালে লিপিবদ্ধ থাকতো অপ্রকাশিত মনের ইঙ্গিত।

আর একজন সাংবাদিক আর সাংবাদিকতার মুল উপাদান হলো ঘটনার সংবাদ বা তথ্য। সেটি জীবন, সমাজ ও রাষ্টের গতি প্রকৃতি বর্ণনার একটি কৌশল। চিন্তা ধারার উন্নয়ন, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক রূপান্তরের ধারক ও বাহক হল সাংবাদিকতা। আর একটি সংবাদপত্র হচ্ছে এক একটি দিনের ইতিহাস বা ঐ সমাজের প্রতিচ্ছবি। সাংবাদিকতা হচ্ছে শিক্ষা,সংস্কৃতি,অর্থনীতি,রাজনীতি,ধর্ম,দর্শন,বিনোদন প্রভৃতি বিকাশের মূল সমীকরণ। বর্তমানে রেড়িও,টে লিভিশন, সামাজিক যোগাযোগ ওয়েবসাইট, ইন্টারনেট প্রবৃত্তির কল্যাণে সাংবাদিকতা আগের মত কাগজের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। তাই বর্তমানে বলা যায় সাংবাদিকতা মানুষের আচার-অনুষ্ঠান, কাজ-কর্মে প্রভাব বিস্তারকারী সবচেয়ে শক্তিশালী একটি নক্ষত্র।

আর ১৯৯০ সালে বাবা গণমাধ্যমে দায়িত্ব গ্রহন করার পর প্রায় সময় পত্রিকা অফিসে যাতায়াত করা হতো।  তাই নিজস্ব প্রেসে হাতে অক্ষর গুলো সাজিয়ে বসানোর জন্য বাবা প্রায় সময় নির্দেশ দিতেন। আমার অবুঝ মনন আর বালকের মতো নিরিবিলি কাঠের বোর্ডে ছোট-ছোট রাবারের অক্ষর গুলো বসিয়ে পত্রিকা তৈরি করে দিতাম। কিন্তু সাংবাদিকতা পেশার মুলভাব অজানা কিংবা অদৃশ্য রয়ে যায়। ১৯৯৯ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষে হাতে গোনা কয়েক মাসের অবসর সময়ে বাবার নির্দেশনায় সরকারী তালিকা ভুক্ত দৈনিক পত্রিকায় সাংবাদিকতার সংবাদ সম্পাদনার কাজ করা সুযোগ হয়ে উঠে। এভাবে সংবাদ জগতের প্রাথমিক ধারনা চেতনার সংগ্রহশালায় আয়ত্ব হয়ে যায়। এক সময় সাফল্যের সাথে নিয়মতান্ত্রিক পুঁথিগত শিক্ষা জীবনে যাত্রা করার সাথে সাথে অনিয়মিত চলে সাংবাদিকতা।

কিন্তু হঠাৎ ২০০২ সালে জুন মাসে আমার জন্মদাতা পিতা সাংবাদিক সৈয়দ ফারুক আহমদ নিখোঁজ হয়ে যান। বাবাকে বিভিন্ন পরিচিত মহলে খুঁজ করে তাহার সন্ধান মিলেনি। আমরা বুঝতে পারলাম কে বা কারা বাবাকে গুম করেছে। তারপর থানা-পুলিশ এই বছরই ৩ আগষ্ট বিকালে পরিত্যক্ত বদ্ধ ঘর থেকে প্রায় দুই মাসের গলিত বাবার লাশ উদ্ধার করে। বাবার মৃত দেহটি দেখে এতোটা মানষিক ভাবে পরাস্ত হই যে স্বাভাবিক চলাফেরার গতি হারিয়ে ছয়মাস চিকিৎসা পর্যন্ত নিতে হয়। নিজের মননে ভয় জেগে বার বার প্রশ্ন তৈরি করে কেন, কেন, কেন হত্যা করা হয়েছে? শহরের নানা প্রতিকুল পরিবেশ ছেড়ে পরিবার গ্রামে আবাস নিয়ে সেখানে প্রতিদিন জাতীয় দৈনিক গণমাধ্যমে মনের নীড় খুঁজে নেয়। আর প্রতি সপ্তাহের শুক্রবারে চারটি পত্রিকা রাখা ছিল রুটিনের তালিকায়। তাছাড়া সাপ্তাহিক, মাসিক, ত্রৈমাসিক পত্রিকাও তালিকা থেকে বাদ যায়নি।

২০০৩ সালের প্রথম দিকে একটি দৈনিক পত্রিকায় ড্যানিয়েল পার্লকে নিয়ে একটি প্রবন্ধ প্রকাশ হয়। আর কলামটি পড়ার পর নিজের ভিতরের ভয় কেটে গিয়ে স্পৃহা তৈরি হয়। যা দিয়ে নিজের অস্তিত্ব আবিষ্কার হয়ে যায়। তার মানে দ্বিতীয় জন্ম। তারপর ড্যানিয়েল পার্লকে মনে মনে স্মরণ রেখেছি। কিন্তু আমার স্মৃতির পাতায় তার নামটি ‘‘জন পার্ল’’ হিসেবে মেমোরিতে সেইভ রয়ে যায়। ২০১৩ সালে যখন ইন্টানেটের ছড়াচড়ি তখন জন পার্ল নামে অনেক খুঁজেও পাইনি। একরাতে আমার পুরনো ডায়রির পাতা খুঁজতে গিয়ে দেখি তার নাম ড্যানিয়েল পার্ল ও তার জীবন লিপিবদ্ধ রয়েছে। আজকের সমাজ ব্যবস্থায় যখন সাংবাদিকতা বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতায় ধাপে ধাপে কলংঙ্কিত হচ্ছে।  তখন তিনি আমাদের পথ চলার প্রেরণার বাতিঘর হয়ে উঠতে পারেন। কে সেই বিশ্বখ্যাত সাংবাদিক?

সেই ড্যানিয়েল পার্ল‘র দীর্ঘ সাংবাদিক ক্যারিয়ার রয়েছে। তিনি মার্কিন পত্রিকা ওয়ার্ল্ড স্ট্রিট জার্নালের দক্ষিণ এশিয়া প্রধান হিসেবে নিযুক্ত হন। এর পরই ভারতের মুম্বাইয়ে চলে যান এই সাংবাদিক। আল-কায়েদাকে নিয়ে অনুসন্ধানী রিপোর্ট তৈরির পরিকল্পনা করেন। পরবর্তীতে আল-কায়েদা অনুসরণের জন্য পাকিস্তানের অন্যতম ধর্মীয়নেতা শেখ মুবারক আলী গিলানির সাক্ষাৎকারের উদ্দেশ্যে পাকিস্তানে যান। সময়টা ২০০২ সাল পাকিস্তানের করাচি। এই সুযোগটাই কাজে লাগায় জঙ্গিরা। সেখান থেকেই একটি জঙ্গি গ্রুপ তাকে প্রথমে অপহরণ করে এবং পরে মুক্তিপণ দাবি করে। এরপর জঙ্গিরা তার ওপর চালায় নানাবিধ শারীরিক অত্যাচার। দিনের পর দিন অমানুষিক নির্যাতন চালানো হয় ড্যানিয়েল পার্লের ওপর। এরপর ধারালো ছুরি দিয়ে গলা কেটে হত্যা করে জঙ্গিরা ও পুরো ঘটনাটির ভিডিও ধারণ করে তারা। ২০০২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি জঙ্গিরা ভিডিওটি গণমাধ্যমের কাছে পাঠায়। তখন আল-কায়েদাকে নিয়ে তার সাহসী খবর গুলো বিশ্ববাসীকে নাড়া দেয়।

এছাড়া ড্যানিয়েল পার্ল ১০ অক্টোবর ১৯৬৩ সালে জন্ম গ্রহণ করেন ও তিনি একজন মার্কিন সাংবাদিক। তিনি তিনি সন্ত্রাসী রিচার্ড রেইড (দ্য স্টোন বোম্বার), আল কায়েদা, এবং পাকিস্তানী গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই-এর ওপর পত্রিকায় একটি তদন্তমূলক প্রতিবেদন দাখিলের উদ্দেশ্যে পাকিস্তানে গিয়েছিলেন। পরবর্তীতে অপহরণকারীরা শিরঃচ্ছেদের মাধ্যমে তাকে ১ ফেব্রুয়ারি ২০০২ সালে হত্যা করা হয়।

১৭ মে ২০১০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা গণমাধ্যমের স্বাধীনতা আইনে স্বাক্ষর করেন। যেসব দেশে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা লঙ্ঘন করা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর তার একটি তালিকা প্রকাশ করবে এবং আইনের নাম দেওয়া হয় ড্যানিয়েল পার্ল ফ্রিডম অব দ্য প্রেস অ্যাক্ট। তৎকালিন সময় বারাক ওবামা, ড্যানিয়েল পার্লের স্ত্রী ম্যারিয়ান, তাঁদের সাত বছরের সন্তান অ্যাডাম ও পার্লের মা-বাবার উপস্থিতিতে এই আইনে স্বাক্ষর করেন।

সর্বোপরি বিশ্ববাসী ২০২২ সালে ১লা ফেব্রুয়ারী ড্যানিয়েল পার্ল হত্যার বিশ বছর অতিক্রম করলো। কিন্তু আজো তার হত্যার বিচার হয়নি। বরং মার্কিন সাংবাদিক ড্যানিয়েল পার্ল হত্যা মামলার প্রধান আসামী জঙ্গি ওমর সাইদ শেখকে মুক্তি দেয় সুপ্রিম কোর্ট। তিন বিচারপতির ওই প্যানেলে ২-১ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় তার মুক্তির পক্ষে রায় দেয় আদালত। এর ফলে ড্যানিয়েল পার্ল হত্যা মামলার সকল আসামীকে মুক্তি দেয়া হয়। এটি লজ্জাজনক। বিশ্বে যুগে-যুগে সাংবাদিকতার জন্য অশনিসংকেত। তাই ড্যানিয়েল পার্ল হত্যার দিনটি বিশ্বের প্রতিটি রাষ্ট্রের সাংবাদিক হত্যার সুষ্ট বিচার, বাক-স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা রক্ষার জন্য প্রেরনা হয়ে মুক্তির দিন উন্মোচনের দাবী জানাই। যেখানে সংবাদ ও সাংবাদিকরা হবে জাতির বিবেক অত:পর রাষ্ট্র এবং সরকারের প্রতিপক্ষ নয়। সাংবাদিকরাই বিশ্ব মানবতা রক্ষার অন্যতম মাধ্যম। তাই এই সাংবাদিকদের নিরাপত্তা রক্ষার ক্ষেত্রে জাতি সংঘের উদ্দেগ্যে  নেয়া একান্ত প্রয়োজন। ড্যানিয়েল পার্ল হত্যার বিচারের দাবী জানাই।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট-ফ্রান্স।

Facebook Comments Box
advertisement

Posted ২০:৫৪ | রবিবার, ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২২

Swadhindesh -স্বাধীনদেশ |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

অবাধ্য ভাবনা
(518 বার পঠিত)
advertisement
advertisement
advertisement

এ বিভাগের আরও খবর

Advisory Editor
Professor Abdul Quadir Saleh
Editor
Advocate Md Obaydul Kabir
যোগাযোগ

Bangladesh : Moghbazar, Ramna, Dhaka -1217

ফোন : Europe Office: 560 Coventry Road, Small Heath, Birmingham, B10 0UN,

E-mail: news@swadhindesh.com, swadhindesh24@gmail.com