| বৃহস্পতিবার, ১৩ মার্চ ২০১৪ | প্রিন্ট
হা সা ন হা ফি জ
বিশ্ব নারী দিবস ছিল গত ৮ মার্চ। সাড়ম্বরে বিশ্বজুড়ে সে দিবস পালন করা হলো। বেশ ভালো কথা। একখান সওয়াল মনের মাজারে খোঁচা মারছে। প্রশ্নটা হলো, বছরে একটা দিন নারীদের জন্যে সসম্মানে একটি দিন বরাদ্দ। বাকি ৩৬৪ দিন? সেসব কি পুরুষ দিবস? জাতিসংঘওয়ালাদের এইটা ‘প্রশ্ন’ করলে তারা নিরুত্তর থাকবেন, লা-জওয়াব যে থাকবেন, সেটা হলফ করে বলতে পারি না জনাব। অনুমান করছি মাত্র।
ওই নারী দিবসেই একটি খবর চাউর হয়েছে। মামুলি খবর বার্তা না। রীতিমত গবেষণা জরিপের ফল। অতএব, ব্যাপারটাকে খাটো করে দেখবার সুযোগ নাই।
আইসিডি আরবি’র গবেষণার ফল সেটি। গবেষণার মোদ্দা কথাটুকু আগে জেনে নেওয়া যাক। তারপর না হয় উঠতি বাছুরের নয়া শিং নিয়ে ডিটেইলসের গুঁতাগুঁতি করা যাবে।
জরিপের মোদ্দা কথা, বাংলাদেশের বেশিরভাগ পুরুষই মনে করেন স্ত্রীকে মারধোর করা যায়। গ্রামাঞ্চলের হিসাব, শতকরা ৮৯ ভাগ পুরুষ মনে করেন, স্ত্রী অন্যায় কিছু করলে স্বামীর মার দেয়ার অধিকার আছে। শহরাঞ্চলের কি খবর? শহরের বাসিন্দা যে পুরুষকুল, তেনারাও কম যান না (সব শেয়ালের এক রা)। ৮৩ শতাংশ শহুরে পুরুষ একই রকমের ধারণা পোষণ করেন।
নাউ উই উইল গো ফর ডিটেইলস। শহরের শতকরা ৯৩ জন পুরুষ, গ্রামের ৯৮ জন পুরুষ বিশ্বাস করেন, পুরুষ হতে হলে তাকে কঠোর হতেই হবে। শহুরে ৫০ শতাংশ এবং গ্রামের ৬৫ শতাংশ পুরুষের বিশ্বাস, পরিবারকে বাঁচানোর জন্য নারীদের উচিত নির্যাতন সহ্য করা। গবেষণার নাম কী ছিল? গালভরা নাম। গভীর তাত্পর্যেও ভরপুর। শিরোনামটি হচ্ছে বাংলাদেশে লিঙ্গীয় পরিচয় (জেন্ডার) এবং নারীর প্রতি সহিংসতা সম্পর্কে পুরুষের মনোভাব ও চর্চা।
গবেষণার প্রাপ্ত যেসব তথ্য তা অবশ্যই পিলে চমকানো। চিন্তার খোরাক জোগায়। শহরের ৭৭ শতাংশ এবং গ্রামের ৮১ শতাংশ পুরুষের বিশ্বাস, যৌনতা বা এ সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোতে অধিকার শুধু পুরুষের। তাদের ইচ্ছাই প্রধান। ২৯ থেকে ৩৫ শতাংশ পুরুষ তাদের রাগঝালের কারণে কিংবা নারীদের শাস্তি দেয়ার মানসে যৌন নির্যাতন করে থাকেন। মোট দুই হাজার চারশ’ পুরুষ ছিলেন এই জরিপের আওতায়। তাদের মধ্যে গ্রামীণ পুরুষের সংখ্যা কিঞ্চিত্ কম, এক হাজার ১৪৬ জন। শহুরে পুরুষের সংখ্যা এক হাজার ২৫৪।
নানাবিধ প্রশ্নে পুরুষেরা যে মত দিয়েছেন, তার কয়েকটি উল্লেখ করছি। বেশিরভাগ পুরুষ মনে করেন, পরিবারের সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা শুধু পুরুষের। স্বামীর বাধ্য থাকা স্ত্রীর কর্তব্য। স্বামীর সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনে স্ত্রীর কখনোই অসম্মত হওয়া উচিত না। ধর্ষণের শিকার নারীরও দোষ আছে, নারী যদি বাধা না দেন, তবে তা ধর্ষণ হবে না। এ ধরনের বক্তব্যও সমর্থন করছেন বেশিরভাগ পুরুষ। শহরের ৬৯ শতাংশ এবং গ্রামের ৭৮ শতাংশ পুরুষ মনে করেন, যৌনতার বিষয়টি নারীর চেয়ে পুরুষের বেশি দরকার।
একজন পুরুষ হিসাবে এই গবেষণায় প্রাপ্ত ফল সম্পর্কে আমি বড়ই শরমিন্দা। এই তাহলে আমাদের সমান প্রগতির অবস্থা? এই নাকি হালচাল? নারীশাসিত দেশে ভেতরে ভেতরে এতটাই ফোঁপরা ও দেউলিয়া হয়ে গেছি আমরা? ছি! ছি! ছি, লজ্জা, লজ্জা। লজ্জা-শরমের চল তো এদেশ থেকে উঠেই গেছে। লাজ-শরমের শব্দার্থ জানতে হলে বাংলা একাডেমির ব্যবহারিক বাংলা অভিধানের স্মরণ নিতে হবে।
পাঁচ/দশ পার্সেন্ট ভোটার জাতীয় নির্বাচনে ভোট দিয়েছেন— ১৫৩ জন বিনা ভোটে জয়ী। মাশাআল্লাহ্। এইটা তো মিয়াভাই আপনের বিশ্বরেকর্ড। নির্বাচন সুষ্ঠু, অবাধ হয়েছে। তারস্বরে, জোরেশোরে। গলা ফাটিয়ে দাবি করা হচ্ছে। চোরের মার গলা তো বড়ই হয়। পটুয়াশিল্পী কামরুল হাসান কার্টুন এঁকে স্বৈরাচারী এরশাদের অপকর্ম অবৈধতার কঠোর নিন্দা করেছিলেন। এরশাদশাসিত স্বদেশকে অ্যাখ্যায়িত করেছিলেন—‘দেশ আজ বিশ্ববেহায়ার খপ্পরে’ বলে।
আজকের যে পরিস্থিতি, এরশাদ তার কাছে ডাহা ফেল।
আন্তর্জাতিক অনেক নেতা ওই তথাকথিত নির্বাচনকে সুষ্ঠু অবাধ বলে সার্টিফাই করেছেন। লাজ-শরমের মাথা ওরাও খুইয়েছে। সারা দুনিয়াই বোধকরি এইমতো বিশ্ব পাগলদের খপ্পরে। পুরুষেরা এখনো সামন্ত মানসিকতা লালন করে। হায় আল্লাহ! একবিশং শতকে এরকম অদ্ভুতুড়ে পরিস্থিতির মুখোমুখি আমাদের হতে হবে, ভাবা যায়নি। কেনিয়ার পার্লামেন্ট একবার একটা আইন পাস করতে চেয়েছিল। সেই চেষ্টা ফলবতী হয়নি। সরকারি দলই সে মহতী চেষ্টা ভণ্ডুল করে দেয়। বৌ পেটানো আমাদের জাতীয় ঐতিহ্য, জাতীয় অহঙ্কার। এসব ধুয়া তুলে সে প্রচেষ্টা ভেস্তে দেয়া হয়। বাংলাদেশ কী কেনিয়ার চেয়ে পিছিয়ে? কেনিয়ার চেয়ে অনগ্রসর? বিদ্যা, বুদ্ধি, মনন, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের বিবেচনায় কেনিয়ার চাইতেও অধম? এর উত্তর আমাদের সুশীল (!)। পণ্ডিতদেরই দেয়ার কথা। তারা স্পিকটি নট হয়ে থাকবেন। সেটাই উত্তম। কারণ হলো, বোবার শত্রু নাই।
ক্ষমতাসীন সরকার ক্ষমতার মধু খেয়ে বুঁদ হয়ে আছে। তারাও জরিপে উল্লেখিত পুরুষকুলের মতোই মনে করে, হ্যাঁ, পাবলিক ইচ্ছেমতো ঠেঙ্গানো যায়। এটা সাংবিধানিক অধিকার। পদ্মা সেতু নামের মহা প্রকল্প নিয়ে মহা নয়/ছয় করা চলে। দশ টাকা কেজি চাল, ঘরে ঘরে চাকুরি, বিনামূল্যে সার দেওয়ার ভুয়া প্রতিশ্রুতি দিয়ে পার পাওয়া যায়। উপজেলা নির্বাচনে গায়ের জোরে রেজাল্ট উল্টে-পাল্টে দেয়া যায়। শরম যাতে পেতে না হয়, সেজন্যে প্রধান নির্বাচন কমিশনার লম্বা ছুটি নিয়ে বিদেশে গিয়ে বসে থাকেন। হলমার্ক, ডেসটিনি, সোনালী ব্যাংক, শেয়ার মার্কেট অজস্র কেলেঙ্কারি করেও লজ্জা লাগে না। ক্ষমতার নেশা ইয়াবার চাইতেও সর্বনাশা।
লেখক : কবি ও সাংবাদিক
hasanhafiz51@gmail.com
Posted ১৭:১০ | বৃহস্পতিবার, ১৩ মার্চ ২০১৪
Swadhindesh -স্বাধীনদেশ | admin