মঙ্গলবার ২৩শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১০ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সর্বস্তরে বাংলা ভাষার ব্যবহার হউক

  |   মঙ্গলবার, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ | প্রিন্ট

সর্বস্তরে বাংলা ভাষার ব্যবহার হউক

মো.ওসমান গনি

বাংলা আমাদের মাতৃভাষা। এ ভাষার মাধ্যমেই আমরা বাঙালিরা একে অপরের সাথে মনের ভাব প্রকাশ করে থাকি।এ ভাষায় কথা বলতে পেরে আমরা আত্মতৃপ্তি পাই।আমরা বাঙালিরা যেভাবে বাংলা ভাষায় কথা বলে বা লিখে আমরা মনের ভাব প্রকাশ করতে পারি তা অন্য ভাষায় প্রকাশ করা আমাদের জন্য বেশ কষ্টকর।তাই পৃথিবীতে যত ভাষা রয়েছে সব ভাষার চাইতে আমাদের মাতৃভাষা বাংলা আমাদের কাছে সবার চেয়ে উবের্ধ।তাতে কারও কোন সন্দেহ থাকার কথা না।বর্তমানে আমাদের এ বাংলা ভাষা হাটি হাটি পা পা করে আজ আন্তর্জাতিক ভাষার মর্যাদা লাভ করছে।যেটা আমাদের বাঙালির কাছে সবচেয়ে বড় সম্মানের বিষয়।কিন্তু আমাদের এ ভাষা আমরা কোন ব্যক্তি বা জাতির করুণায় পাইনি।

এ ভাষার জন্য আমাদের অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছে।এ ভাষা আদায় করার জন্য বাঙালি জাতি তাদের বুকের তাজা রক্ত দিয়েছে।শহীদ হয়েছে এ দেশের লাখ লাখ মানুষ।বহু ত্যাগ-তিথিক্ষার মধ্যে দিয়ে আমরা আমাদের এ প্রিয় বাংলা ভাষাকে চিনিয়ে আনতে হয়েছে।যাদের বুকের তাজা রক্তের বিনিময়ে আমরা আমাদের বাংলা ভাষাকে পেয়েছি আজ আমরা তাদের কাছে চিরঋণী।কিন্তু যারা আমাদের ভাষার জন্য সংগ্রাম করে আমাদের কে বাংলা ভাষা এনে দিয়ে গেল আমরা আজ তাদের জন্য কি করতে পেরেছি? আর এ বাংলা ভাষার প্রচলনটাই বা কতটুকু ধরে রাখতে পেরেছি।যারা ভাষার জন্য নিজেদের জীবন বাঁজি রেখে ভাষা আনল তারা কি আজ তাদের যথাযথ মর্যাদা পাচ্ছে।আমরা প্রায় সময় বিভিন্ন গণমাধ্যমে দেখি ভাষা শহীদদের স্মৃতি গুলো অযত্ম আর অবহেলায় পড়ে থাকে।এ গুলোর যথাযথ কোন মুল্যায়ন করা হয়নি।প্রতি বছর ফেব্রুয়ারী মাস আসলে পরে আমরা আমাদের ভাষার জন্য পাগল হয়ে যাই।বছরের অন্যদিন গুলোতে তার কোন খবর থাকে না।

এমন টা হওয়া আমাদের জন্য মোটেও ঠিক না।যে ভাষার জন্য লাখ লোক শহীদ হয়ে ভাষা আনল সেই ভাষার প্রতি আমাদের সবসময় সচেতন থাকতে হবে।ভাষার কোন বিকৃত হয় কিনা সে ব্যাপারে আমাদের সজাগ থাকতে হবে।দেশের সর্বত্র বাংলা ভাষার প্রচলন হয় কিনা সেটাও দেখতে হবে।আমাদের দেশের সর্বত্র যদি বাংলা ভাষার প্রচলন চালু রাখতে পারি তাহলে আমাদের ভাষার জন্য সংগ্রাম সার্থক ও সফল হবে।এখনও আমাদের দেশের অনেক জায়গায় ভিন দেশের ভাষার প্রচলন দেখা যায়।যেটা আমাদের জন্য মোটেও কাম্য না।হ্যাঁ ভিন দেশের ভাষার ও প্রয়োজন আছে। দেশের কিছু আন্তর্জাতিক ব্যাপার রয়েছে, যেগুলোতে ভিনদেশী ভাষা ইংরেজির দরকার হয় বা হবে।

সেক্ষেত্রে আমরা আমাদের ভাষার স্থান দিতে হবে সবার উবের্ধ।প্রয়োজনে বাংলা ভাষার নীচে ছোট করে ভিনদেশী ভাষা ব্যবহারের নিয়ম করা যেতে পারে। নিজ দেশের ভাষাকে বিসর্জন দিয়ে অন্য দেশের ভাষাকে উপরে স্থান দিতে হবে তা মানা যায় না।যদি দেয়া হয় তাহলে ভাষার জন্য বাঙালির সংগ্রাম ও রক্ত বৃথা যাবে।এটা হবে আমাদের বাঙালির জন্য হবে আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। যেটা এদেশের কোন শিক্ষিত বা অশিক্ষিত কোন লোকই মেনে নেবে বাংলা না।বাংলা ভাষার প্রসার ঘটাতে আমাদের সকলকে কাজ করতে হবে। দেশের নিরীহ লোকেরা ভাষার প্রতি খুবই দায়িত্বশীল।কিন্তু আমাদের দেশের উচ্চশিক্ষিত লোকেরা কতটুকু দায়িত্বশীল?তারা কি করেন?তারা ব্যস্ত থাকেন তাদের ছেলে-মেয়েদের ইংরেজি শেখাতে।তারা মনে করেন ছেলে-মেয়েরা ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত হলে তাদের গৌরব।যেটা মোটেও ঠিক না।

হ্যাঁ ইংরেজি শিখবে,তবে আগে নিজ মাতৃভাষা বাংলা শেখার পর।তাহলেই তাদের গৌরব করা সাজে।নিজের মাতৃভাষা পদদলিত করে অন্য দেশের ভাষা ছেলে-মেয়েদের শিখানো সেটা বোকামি ছাড়া আর কিছুই না।ইংরেজি যেমন বর্তমানে সারাবিশ্বের ভাষা, পর্যায়ক্রমে বাংলাও হবে একদিন সারাবিশ্বের ভাষা।হয়ত সেদিন আর বেশি দূরে নয়।বর্তমানে আমাদের দেশে লাখ লাখ নতুন লেখক সৃষ্টি হয়েছে।যারা সারা বছর বিভিন্ন গল্প ও উপন্যাসের বই লিখেন একুশের বইমেলায় প্রকাশের জন্য।আর এ বইগুলো এত পাঞ্জল ভাষায় লিখেন যেগুলো মানুষ শুধু পড়তেই চায়।এতে করে মানুষের বই পড়ারও একটা অভ্যাস হচ্ছে।তবে বই লেখার ক্ষেত্রে আমাদের দৃষ্টি রাখতে হবে যাতে ভাষার বানান ও রুপ সঠিক থাকে।বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য যেমন আমরা জীবন দিয়েছি এ ভাষার প্রসার ঘটাতে ও আমরা জোর চেষ্টা চালিয়ে যাব। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সুনির্দিষ্ট দাবি দুটির একটি ছিল রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, অপরটি সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন চাই।

পেছনে ফিরে তাকালে প্রশ্ন উঠতে পারে যে, দুটি দাবি কেন তোলা হলো, একটিই তো যথেষ্ট হওয়ার কথা। রাষ্ট্রভাষা যদি বাংলা হয় তাহলেও সর্বস্তরে তার যে প্রচলন ঘটবে কি ঘটবে না সে-বিষয়ে কোনো সংশয় ছিল কি? জবাব হচ্ছে, হ্যাঁ, ছিল। প্রথমত পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা যে বাংলা হবে এমন দাবি পূর্ববঙ্গের মানুষ তোলেনি, তারা চেয়েছে বাংলা হবে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা, অর্থাৎ দুটির একটি; তাই বাংলাকে যদি রাষ্ট্রের ভাষা হিসাবে মেনে নেওয়াও হয় তাহলেই যে সর্বস্তরে বাংলা ভাষার ব্যবহার নিশ্চিত হয়ে যাবে এমন ভরসা কোথায়? ভরসা নেই বলেই বোধ হয় রাষ্ট্রভাষা দাবি সঙ্গে বাংলা প্রচলনের দাবিটাও উঠেছিল।

অখন্ড পাকিস্তানে বাংলাকে শেষ পর্যন্ত অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মেনে নেওয়া হয়েছিল; কিন্তু নতুন জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ বাঙালি ওই মেনে নেওয়াতে সন্তুষ্ট হতে পারেনি, যে জন্য ধাপে ধাপে এগিয়ে এবং পূর্ণ স্বাধীনতা প্রাপ্তির প্রয়োজনে তারা এমন একটি রাষ্ট্রই প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছে যার অন্যতম নয়, একমাত্র রাষ্ট্রভাষাই বাংলা। বাংলা উচ্চশিক্ষার মাধ্যম হয়নি। তদুপরি শিক্ষা তিন ধারায় বিভক্ত হয়ে গেছে। তিনটির মধ্যে যে ধারাটি ক্রমাগত শক্তি সঞ্চয় করছে এবং যার ভেতরে থেকে বিত্তবান পরিবারের সন্তানরা লেখাপড়া করছে এবং আগামী দিনে যে-ধারায় শিক্ষিতরাই সমাজে কর্তৃত্ব করবে বলে ধরে নেওয়া যায়, সেই ধারাটির মাধ্যম অবশ্যই বাংলা নয়। সেটি ইংরেজি। আর বাংলা মাধ্যমে যারা লেখাপড়া করে তাদের ভেতরও ইংরেজির প্রতি আগ্রহ যে কমছে না বরং বাড়ছে এতেও নিশ্চয়ই সন্দেহ নেই। উচ্চস্তরে মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা না-দেওয়ার ব্যর্থতার দরুন শিক্ষা গভীর হচ্ছে না, এমনকি তাকে যথার্থ শিক্ষাও বলা যাচ্ছে না, কেননা মাতৃভাষা ছাড়া কোনো শিক্ষাই যথার্থ হয় না। উচ্চ আদালতে বাংলাভাষার কার্যকর ব্যবহার নেই, অথচ সেখানে বাদী-বিবাদী আইনজীবী বিচারক সবাই বাঙালি। এটিও বাংলার অপ্রচলনের একটি করুন দৃষ্টান্ত বৈকি। কিন্তু এসবের কারণ কী?

কারণটা স্পষ্ট, সেটা হলো দেশের শাসক শ্রেণি বাংলা ব্যবহারে আগ্রহী নয়। আমাদের দুর্ভাগ্য যে এদেশের শাসক শ্রেণি বাংলা ভাষার ব্যাপারে কখনোই উৎসাহী ছিল না। অতীতে আমরা পরাধীন ছিলাম, বিদেশিরা আমাদের শাসন করেছে, তারা বাংলা ভাষা ব্যবহার করবে না, বরং তাদের নিজেদের ভাষা চাপিয়ে দিতে চাইবে এটাই ছিল স্বাভাবিক। এ জন্য আমরা দেখেছি সংস্কৃত, ফার্সি এবং পরে ইংরেজি হয়েছে সরকারি ভাষা, বাংলা ভাষা সে-মর্যাদা পায়নি। পাকিস্তানিরা চেয়েছিল উর্দুকে চাপিয়ে দেবে। শেষ পর্যন্ত পারেনি। কিন্তু তখন তো দেশ শাসন করছে স্বদেশিরা, তাহলে এখনো কেন বাংলা সর্বত্র প্রচলিত হচ্ছে না? না-হওয়ার ঘটনা এই মর্মান্তিক সত্যের প্রতিই ইঙ্গিত করে যে, আমাদের শাসকশ্রেণি এ দেশেরই যদিও তবু তারা ঠিক দেশি নয়। তারা জনগণের সঙ্গে নেই। নিজেদের তারা জাতীয়তাবাদী বলে দাবি করে, কিন্তু তাদের ভেতর দেশপ্রেমের নিদারুণ অভাব। এককথায় এদেশে তাদের অবস্থানও আগের বিদেশিদের মতোই; তারা কেবল যে জনবিচ্ছিন্ন তা নয়, জনবিচ্ছিন্নতার দরুন তাদের ভেতর গোপন অহঙ্কার রয়েছে।

অপরদিকে তাদের সংযোগ যে পুঁজিবাদী বিশ্বের সঙ্গে তার ভাষা স্পষ্টরূপে ইংরেজি। বাংলা জনগণের ভাষা, চিরকালই তাই ছিল, এখনো সে রকমই আছে; কিন্তু শাসকরা জনগণের থেকে দূরেই রয়ে গেছে, যেমন তারা আগে ছিল। শাসকশ্রেণির সন্তানরা ইংরেজি শেখে, তারা দেশের সম্পদ বিদেশে পাচার করে, বিদেশে ঘরবাড়ি কেনে এবং তাদের সন্তানরা বিদেশমুখো হয়। তাছাড়া বাংলাদেশের রাজনীতিতেও বিদেশিদের হস্তক্ষেপ ঘটছে। বাংলার প্রচলনের অন্তরায় অন্য কেউ ঘটাচ্ছে না, জ্ঞাতে অজ্ঞাতে দেশের বিদেশমুখো ও বিদেশপ্রভাবিত শাসকরাই ঘটাচ্ছে। শাসকশ্রেণির ভেতর রাজনীতিক, ব্যবসায়ী, আমলা পেশাজীবী, সবাই আছে। তাদের প্রধান যোগ্যতা তারা ধনী। এরা ইংরেজি ব্যবহার করতে পারলে খুশি হয়, এবং যখন বাংলা ব্যবহার করে তখন মনমরা থাকে এবং ভাষাকে বিকৃত করে। রাজনীতিকরাই প্রধান, তারাই সবচেয়ে বেশি দৃশ্যমান, তাদের বক্তব্যই আমরা শুনি; লোকে তাদেরই দৃষ্টান্ত বলে মানে, প্রভাবিত হয়, অনুকরণ করে।

জাতীয় সংসদে, সভা সমিতিতে রাজনীতিকরা যে-ভাষা ব্যবহার করে তাতে অনেক সময় কানে আঙুল দিতে ইচ্ছা করে। যারা রাজনীতিক নয় তারাও বাংলা ব্যবহার করে বেশ স্বাধীন ভাবে, উচ্চারণ ও ব্যাকরণের তোয়াক্কা করে না, আঞ্চলিকতার সঙ্গে ইংরেজি শব্দ মিলিয়ে জগাখিচুড়ি তৈরি করে। যেসব ভুল ইংরেজির ব্যবহার ঘটালে তারা লজ্জায় ম্রিয়মাণ হতো সেগুলো নির্বিচারে ঘটাতে থাকে। লজ্জা পাবে কি, অনেক সময় তারা গর্ব অনুভব করে, ভাবে বাংলা ভালোভাবে না জানাটাই তাদের আভিজাত্যের প্রমাণ। দেশের পরিস্থিতিতে যে নৈরাজ্য বিরাজমান তার ছবি ভাষার প্রতি এই দুর্ব্যবহারের মধ্যে চমৎকারভাবে ফুটে ওঠে। ওদিকে জনসাধারণের বড় একটা অংশ অশিক্ষিত, যাদের শিক্ষিত বলে গণ্য করা হয় তাদেরও অনেকেই অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন মাত্র, যথার্থ অর্থে শিক্ষিত নয়। এদের পক্ষে বাংলা ভাষার যথার্থ ব্যবহার সম্ভব নয়।

বাঙালি তার ভাষা নিয়ে গৌরব করে থাকে। গৌরবের কারণ আছে। একটি কারণ বাংলাভাষায় উচ্চারণের সঙ্গে লিখিতরূপের নৈকট্য। আমরা যেভাবে উচ্চারণ করি সে-ভাবেই লিখে থাকি। শাসকশ্রেণি মনে হয় শাসিতশ্রেণিকে অন্যদিক থেকে তো বটেই, বানানের ক্ষেত্রেও হ্রস্ব করে ছাড়বে, কোনো ক্ষেত্রেই রেহাই দেবে না। হায় দরিদ্রশ্রেণির মানুষ, তোমরা পালাবে কোথায়? হরফ বিতাড়নের উদ্যোগটা পাকিস্তানি শাসকরাও নিয়েছিল, সফল হয়নি, কেননা শিক্ষিত বাঙালি সেদিন রুখে দাঁড়িয়েছিল; এখন শিক্ষিত বাঙালিদের বিত্তবান অংশ শাসকশ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয়ে বিতাড়নের কাজটি নিজেরাই সিদ্ধ করছে।

দুর্দশাটা এমনকি একুশে ফেব্রুয়ারির উদযাপনের ক্ষেত্রেও দৃশ্যমান। আয়োজনের অভাব নেই, কিন্তু একুশের উদযাপনে মৌলিক পরিবর্তন ঘটানো হয়েছে, সেটা হলো মধ্যরাতে উদযাপনের সূচনাকরণ। বাঙালির উৎসব শুরু হয় সকালে, ইউরোপীয়দেরটা মধ্যরাতে। ওদের মধ্যরাত আক্রমণ করেছে আমাদের সকালবেলাকে। যা ছিল স্বাভাবিক তাকে কৃত্রিম করে দেওয়ার আয়োজন বৈকি! সাংস্কৃতিকভাবে মধ্যরাত থার্টিফার্স্ট নাইটের ব্যাপার, পয়লা বৈশাখের নয়। থার্টিফার্স্ট নাইট আর পয়লা বৈশাখ এখন আলাদা হয়ে গেছে, ইংরেজি নববর্ষ হুমকি দিচ্ছে বাংলা নববর্ষকে; হুমকির লক্ষণ একুশের উদযাপনেও দেখা দিয়েছে। হুমকি এসেছে আরো একটি। সেটি বিশ্বভালোবাসা দিবস।

এটি আমাদের নয়, ইউরোপের। এর সঙ্গে যোগ রয়েছে বাণিজ্যের। দখলদারিত্বের ভেতর দিয়ে বিশ্ববাজার এখন কোণঠাসা করতে চায় দেশীয় উৎপাদনকে, ভালোবাসা দিবস প্রকাশ্যে উদ্দীপনা তৈরির মধ্য দিয়ে গোপনে শত্রুতা করছে শহীদ দিবসের সঙ্গে। যে তরুণদের কাছে প্রত্যাশিত ছিল মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসার ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ হওয়া, তারা প্রদর্শনী ঘটাচ্ছে একেবারে ব্যক্তিগত পর্যায়ে দুজনে দুজনে মিলবার অভিপ্রায়ের।  আবার  ভারতীয় টেলিভিশন চ্যানেলের মধ্য দিয়ে বর্তমানে আমাদের দেশের ঘরে ঘরে আগমন ঘটছে হিন্দি ভাষার।এ ভাষার জন্য দেশের প্রতিটি ঘরের দরজা জানালা খোলা।যার কারনে অনেকেই অতি সহজে বাংলাকে বিতারিত করে হিন্দি ভাষা শিখছে। অতীতে আমরা উর্দুর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলাম, বর্তমানে হিন্দির জন্য আমাদের দরজা জানালা খোলা।

সাহিত্যের ব্যাপারটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সাহিত্য অনেক কিছুকেই প্রতিফলিত করে, ভাষা ব্যবহারে উৎকর্ষকে তো অবশ্যই। সাহিত্যের মাধ্যমেই ভাষার সর্বোৎকৃষ্ট বিকাশ ঘটে থাকে। দেশে এখন প্রচুর বই, প্রতিবছর বইমেলাতে বই উপচে পড়ে। কিন্তু অধিকাংশ বইয়েরই অন্তর্গত বস্তু অকিঞ্চিতকর। প্রচুর পরিমাণে বিক্রি হয় উপন্যাস ও উপন্যাসসদৃশ রচনা। জনপ্রিয় এই ধারা পাঠকদের জন্য এক ধরনের আমোদ সরবরাহ করে, অল্প সময়ের জন্য হলেও বাস্তব জগৎকে ভুলিয়ে দেয়। ফলে পাঠকদের একটা রুচি তৈরি হয়, যে-রুচি গভীর ও তাৎপর্যপূর্ণ সাহিত্যের স্বাদগ্রহণের জন্য মোটেই অনুকূল নয়, বরং প্রতিকূল বটে।

মাদকাসক্তির মতো অতটা ক্ষতিকর না হলেও কথিত জনপ্রিয় সাহিত্যও এক ধরনের আসক্তি বটে, এ নেশায় যাকে পেয়েছে তার পক্ষে গভীর কোনো বিষয়ে গভীরভাবে চিন্তা করা সম্ভব না হওয়াটাই স্বাভাবিক। এই সঙ্গে এ ঘটনাও তাৎপর্যহীন নয় যে, মেধাবী লেখকদের কেউ কেউ এখন ইংরেজিতে লিখছেন। তারা ইংরেজিতে উচ্চশিক্ষিত, সেই সঙ্গে ইংরেজি বইয়ের বাজারও তুলনামূলকভাবে উন্নত। এটাও অবধারিত যে, জনমাধ্যমের গুরুত্ব আরো বাড়বে। অনেক বেড়েছে, থামবে না। জনমাধ্যম কিন্তু ভাষার উন্নতিতে সহায়ক হচ্ছে না। সেখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনা তো হয়ই না, ভাষাবিকৃতি ঘটে বিজ্ঞাপনে এবং নাটকে। সরকার নিয়ন্ত্রিত মাধ্যমগুলো সরকারের মহিমা প্রচার করতে ব্যস্ত থাকে, তাতে মানুষের বিরক্তি উৎপাদিত হয়, এবং প্রচারের ভাষাও হয় নিম্নমানের। এফএম রেডিও তরুণদের যে ভাষা শেখাচ্ছে তা ভাষাচর্চার জন্য মোটেই স্বাস্থ্যকর নয়।

বিশ্বে এখন বাংলাভাষীর সংখ্যা প্রচুর, ত্রিশ কোটিরও বেশি হবে; সংখ্যাবিচারে বাংলাভাষী মানুষের স্থান পঞ্চম। কিন্তু বাংলা ভাষার মর্যাদা খুবই কম। কারণ কী? কারণ হচ্ছে আমরা সংখ্যায় অনেক ঠিকই কিন্তু ক্ষমতায় সামান্য। অনেকটা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার মতোই পরিমাণে শিক্ষিতদের সংখ্যা অনেক, কিন্তু গুণগতমান নিম্নগামী।

ক্ষমতাহীনতার একাধিক কারণ রয়েছে। প্রধান ও প্রাথমিক কারণটা হলো জ্ঞানচর্চার অপ্রতুলতা। জ্ঞানচর্চা ঠিক মতো হচ্ছে না। আর তার কারণ হলো চর্চা যেটুকু যা হচ্ছে তা বাংলাভাষার মাধ্যমে ঘটছে না। জ্ঞানই যে শক্তি, এ সত্যে কোনো ভেজাল নেই; জ্ঞানের চর্চায় আমরা উঁচুতে উঠতে পারছি না; মেধা ও মনন অবিকশিত রয়ে যাচ্ছে। ফলে ক্ষমতা বাড়ছে না। আমরা তরল হচ্ছি, ঘন হতে ব্যর্থ হয়ে। বিশ্বে তাই বাঙালির কোনো সম্মান নেই। ওদিকে সব বাঙালি বাংলাদেশের দিকে তাকিয়ে আছে, কেননা বাংলাদেশেই হচ্ছে বাংলাভাষা চর্চার কেন্দ্রভূমি এবং  ভরসাস্থল। আবারো ওই শাসক শ্রেণির জনশত্রুতার বিষয়টির কাছেই যেতে হয়। রাষ্ট্র অনেক কিছুই করতে পারেনি; রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা বাংলা ভাষার চর্চার ক্ষেত্রেই ঘটেছে। ওই ব্যর্থতা অনেক ব্যর্থতার প্রতিপালক। ব্যর্থতার কারণ হলো রাষ্ট্র ভেঙেছে ঠিকই, কিন্তু বদলায়নি।

ভেতরে সে আগের মতোই রয়ে গেছে। বদলাবার কথা ছিল, কেননা এই রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা বাঙালির মুক্তি সংগ্রামের ফলশ্রুতিতে। মুক্তির ওই সংগ্রামেরই অংশ রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, তারই পরিণতিতে মুক্তিযুদ্ধ এবং তার ভেতর দিয়েই বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা। মুক্তির জন্য প্রয়োজন ছিল বাংলাভাষা চর্চার স্বাধীনতা। সেটা সম্ভব হতো রাষ্ট্রের চরিত্রে, অর্থাৎ রাষ্ট্রের ভেতরে শাসক ও শাসিতের সম্পর্কের ক্ষেত্রে যদি মৌলিক পরিবর্তন ঘটত তবেই। সেটা ঘটেনি। শাসক বদল হয়েছে, শাসক-শাসিতের সম্পর্কে বদল হয়নি। মুক্তির সংগ্রামে চালিকাশক্তি ছিল সাধারণ মানুষ। সেই সাধারণ মানুষের মুক্তি আসেনি। তাই তাদের মাতৃভাষাও মুক্তি পায়নি; আগের মতোই শাসকদের অবহেলা ও উৎপীড়নের শিকার হচ্ছে।

কিন্তু হতাশ হওয়ার কারণ নেই। জনগণ আছে। এবং তাদের ভাষাও থাকবে। কেবল বাংলাদেশে নয় বিশ্বজুড়ে যে বাঙালিরা রয়েছে তাদের ভাষা অবশ্যই নিজের জন্য মর্যাদার স্থান খুঁজে নেবে। কিন্তু দায়িত্বটা বাংলাদেশের মানুষেরই, নেতৃত্ব তাদেরকেই দিতে হবে। বাংলাভাষার উৎকর্ষ ও প্রয়োগ বৃদ্ধির জন্য আমরা বিভিন্ন কাজের সুপারিশ করতে পারি। যেমন পাঠাগার গড়ে তোলা; সংস্কৃতিচর্চার গুণ ও ব্যাপকতা বৃদ্ধি। বলতে পারি ব্যক্তিগত উদ্যোগ গ্রহণের আবশ্যকতার কথা। সাহিত্যচর্চার অপরিহার্যতার বিষয় তুলে ধরতে পারি। উচ্চ আদালতের সঙ্গে যারা যুক্ত তাদের অনুরোধ জানাতে পারি বাংলা ব্যবহারের। কিন্তু মূল ব্যাধিটাকে যেন না ভুলি। সেটা হলো বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় চরিত্র। ওই চরিত্রে বদল ঘটিয়ে, রাষ্ট্রকে জনগণের অধীনে নিয়ে আসতে হবে। সেটা ঘটলে রাষ্ট্র, সমাজ ও ব্যক্তিজীবনের সর্বত্র জনগণের ভাষা অব্যাহতরূপে ব্যবহৃত হবে, তার উন্নতির পথে অন্তরায় থাকবে না।

বাংলা ভাষার মর্যাদা আমাদেরকেই রক্ষা করতে হবে।দেশের সর্বত্রই বাংলা ভাষার প্রচলনের ব্যাপারে সরকারের পাশাপাশি সকলকে এগিয়ে আসতে হবে।আমাদের সন্তানদের কে বাংলা ভাষা শেখার ব্যাপারে আগ্রহী করে তোলতে হবে।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
Email:ganipress@yahoo.com

 

 

Facebook Comments Box
advertisement

Posted ০৭:১০ | মঙ্গলবার, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

Swadhindesh -স্বাধীনদেশ |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

advertisement
advertisement
advertisement
Advisory Editor
Professor Abdul Quadir Saleh
Editor
Advocate Md Obaydul Kabir
যোগাযোগ

Bangladesh : Moghbazar, Ramna, Dhaka -1217

ফোন : Europe Office: 560 Coventry Road, Small Heath, Birmingham, B10 0UN,

E-mail: news@swadhindesh.com, swadhindesh24@gmail.com