বৃহস্পতিবার ১৮ই এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ৫ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

রাষ্ট্রীয় ভাবে উপেক্ষিত চা শ্রমিক দিবস!

  |   রবিবার, ১৯ মে ২০১৯ | প্রিন্ট

রাষ্ট্রীয় ভাবে উপেক্ষিত চা শ্রমিক দিবস!

হাবিব সরোয়ার আজাদ

 

ব্রিটিশ গোর্কা বাহিনীর নির্বিচারে গুলিতে মাতৃভুমিতে ফিরে যাবার পথে শতশত চা শ্রমিকদের প্রাণ হারানোর মধ্যদিয়ে ইতিহাসে রচিত সেই কালো দিনটিকে শোকাবহ দিনটিকে শক্তিত্বে বরণ করে বরাবরের মত আজ ২০ মে ঐতিহাসিক চা শ্রমিক দিবস পালন করবে চা শ্রমিক জনগোষ্ঠী। ১৮৫৪ সালে ভারতের অনুর্বর অঞ্চলে অর্থাৎ উড়িষ্যা, মাদ্রাজ, বিহার, মধ্যপ্রদেশসহ বিভিন্ন অঞ্চলে অভাবপীড়িত মানুষ অনাহার-অর্ধাহারে দিন কাটাতো। গরিব মানুষের অর্থ সংকটের এ সুযোগটিকে সুকৌশলে কাজে লাগায় তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার।

সিলেটের ‘মালিনীছড়া’ চা বাগান প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে চতুর ব্রিটিশরা এ অঞ্চলে প্রাথমিক ভাবে চায়ের বাণিজ্যিক চাষ শুরু করে। খুব সংগত কারনেই চা বাগান প্রতিষ্ঠার জন্য শ্রমিকের প্রয়োজন হয়।
ব্রিটিশ কোম্পানি উড়িষ্যা, মাদ্রাজ, বিহার, মধ্য প্রদেশসহ আশপাশ এলাকা থেকে অভাবপীড়িত মানুষদের আর্থিক লাভের প্রলোভন দেখিযে মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে সিলেট অঞ্চলের চা বাগান গুলোতে নিয়ে আসে। তাদের চা বাগানে শ্রমিক হিসেবে নিয়োগ করে।

কোম্পানির মালিকরা এসব শ্রমিককে সিলেট অঞ্চলের গহিন বনে নামমাত্র মজুরিতে অমানবিক কাজে বাধ্য করে। দিন-রাত খাটুনির পর যে মজুরি পেত, তা দিয়ে শ্রমিকদের ঠিকমতো একবেলা খাবারও জুটত না। একদিকে মালিকদের অত্যাচার-নির্যাতন, অন্যদিকে শ্রমিকরা মানবেতর জীবন-যাপন করতে থাকে। ব্রিটিশ কোম্পানির মালিক শ্রেণীর শোষণ, নির্যাতন , অত্যাচার আর মিথ্যা আশ্বাসের ফাঁদ ও দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র থেকে বেরিয়ে আসতে শ্রমিকরা তখন ঐক্যবদ্ধ হয়।

১৯২১ সালের এই দিনে ব্রিটিশদের অত্যাচার থেকে মুক্ত হতে সিলেট অঞ্চলে থাকা বাগানগুলো থেকে প্রায় ৩০ হাজার চা-শ্রমিক নিজেদের জন্মস্থানে ফিরে যেতে চেষ্টা চালায়। কিন্তু চাঁদপুরের মেঘনাঘাটে গুলি চালিয়ে ১৯২১ সালের এই দিনে নির্বিচারে হত্যা করা হয় সুবিধা বঞ্চিত পিছিয়ে পড়া চা শ্রমিকদের।  এরপর থেকে চা-শ্রমিকরা সেই বর্বোরিত হত্যাকান্ডের দিনটিকে স্মরণ রাখতে ‘চা-শ্রমিক দিবস’ হিসেবে পালন করে আসছেন।  তবে বারবার দাবী জানানো এবং অনেক আন্দোলনের পরও ৯৮ বছরেও রাষ্ট্রীয় ভাবে স্বীকৃতি মেলেনি দিবসটি। ঘুচেনি সুবিধা বঞ্চিত চা শ্রমিকদের শোষণ বঞ্চনা। এই দিবসের স্বীকৃতি পেতে প্রতি বছরের ন্যায় সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জের বিভিন্ন চা বাগানে আজ কর্মবিরতি পালন করবেন চা শ্রমিক জনগোষ্ঠীর লোকজন।

চা শ্রমিক ইউনিয়নের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক চা শ্রমিক নিপেন পাল জানান, এই দিনে চা শ্রমিকদেরকে হত্যা করা হয়েছিল বলে বিভিন্ন চা বাগানে কর্মবিরতি পালন করে র‌্যালি ও আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়ে থাকে। তবে কোন কোন বাগানে শ্রমিকরা আজ সারাদিন কাজ বন্ধ রাখবেন এছাড়া বিভিন্ন বাগানে ২ ঘন্টা কর্মবিরতি পালন করা হবে।

তিনি আরও বলেন, ‘আমরা প্রতি বছরই রাষ্ট্রীয়ভাবে দিবসটি পালনের আহবান জানালেও এ ব্যাপারে সরকারি কোন উদ্যোগ চোখে পড়েনি আজো। আমাদেরকে যুগযুগ ধরে আশ্বাস দিয়ে এদেশে এনে স্বল্প মজুরীর মাধ্যমে হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমের কাজ করানো হচ্ছে। তাই শ্রমিকরা সেই ১৯২১ সালের ২০ মে নিজ মুল্লুকে ( মাতৃভমি) ফিরে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু তারা সফল হয়নি। এখনও আমরা চা শ্রমিকরা বাংলাদেশের নাগরিক হলেও নানাভাবে নাগরিক সুবিধা বঞ্চিত হয়ে আসছি।’ আমরা রাষ্ট্রীয় ভাবে চা শ্রমিক দিবসটি পালকের স্বীকৃতি চেয়ে আজো উপেক্ষিত হয়ে আছি।.

পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতাব্দীতে চীন ছাড়া পৃথিবীর অন্য কোথাও চায়ের প্রচলন ছিল না। ১৮৫৪ সালে পরীক্ষামূলকভাবে সিলেটের মালিনীছড়া চা বাগানে চা চাষ শুরু করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। সে সময় বৃহত্তর সিলেটে চা বাগান তৈরির জন্য ভারতের আসাম, উড়িষ্যা, বিহার, উত্তর প্রদেশসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে শ্রমিকদের বাংলাদেশের সিলেট সহ বিভিন্ন অঞ্চলে নিয়ে আসা হয়। ‘গাছ হিলেগা, রুপিয়া মিলেগা’ (গাছ নড়লে টাকা মিলবে) এমন প্রলোভনে শ্রমিকরা বাংলাদেশে এলেও তাদেও যে প্রলোভন দেখিয়ে নিয়ে আসা হয়েছে সেই ভুল বঝুতে বেশি সময় লাগেনি। বিশাল পাহাড় পরিষ্কার করে চা বাগান করতে গিয়ে হিং¯্র পশুর কবলে পড়ে কত শ্রমিকের জীবন অকালে চলে গেছে তার কোনো হিসেব নেই। এছাড়া ব্রিটিশদের অত্যাচার তো ছিলই।

তাদের অব্যাহত নির্যাতনের প্রতিবাদে তৎকালীন চা শ্রমিক নেতা পন্ডিত গঙ্গাচরণ দীক্ষিত ও পন্ডিত দেওসরন ‘মুল্লুকে চল’ ( মাতৃভমিতে ফিরে যাবার) আন্দোলনের ডাক দেন।
১৯২১ সালের ২০ মে সিলেট অঞ্চলের প্রায় ৩০ হাজার চা শ্রমিক সিলেট থেকে পায়ে হেটে চাঁদপুর মেঘনা স্টিমার ঘাটে পৌঁছান। তারা জাহাজে চড়ে নিজ দেশে ফিরে যেতে চাইলে ব্রিটিশ গোর্খা বাহিনীর সৈনিকরা নির্বিচারে গুলি চালিয়ে শত শত চা শ্রমিককে হত্যা করে মেঘনা নদীতে লাশ ভাসিয়ে দেয়। যারা পালিয়ে এসেছিলেন তাদেরকেও আন্দোলন করার অপরাধে পাশবিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়। চা শ্রমিকদেরকে পড়ানো হয় একটি বিশেষ ট্যাগ। পায়নি তারা ভূমির অধিকার। এরপর থেকেই প্রতি বছর ২০ মে চা শ্রমিক দিবস হিসেবে দিনটি পালন করে আসছেন নাগরিক সুবিধা বঞ্চিত শোষণ বঞ্চনা ও বৈশম্যের শিকার চা শ্রমিকরা।
ছবি: সংগৃহিত

লেখক: হাবিব সরোয়ার আজাদ, গণমাধ্যম ও মানবাধিকার কর্মী

Facebook Comments Box
advertisement

Posted ২২:২৩ | রবিবার, ১৯ মে ২০১৯

Swadhindesh -স্বাধীনদেশ |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

advertisement
advertisement
advertisement
Advisory Editor
Professor Abdul Quadir Saleh
Editor
Advocate Md Obaydul Kabir
যোগাযোগ

Bangladesh : Moghbazar, Ramna, Dhaka -1217

ফোন : Europe Office: 560 Coventry Road, Small Heath, Birmingham, B10 0UN,

E-mail: news@swadhindesh.com, swadhindesh24@gmail.com