সোমবার ২৯শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১৬ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

নূহ নবীর কিস্তি এবং জাতিসংঘ সনদের সপ্তম অধ্যায়

  |   শুক্রবার, ০৩ জানুয়ারি ২০১৪ | প্রিন্ট

সিরাজুর রহমান

sherajur rahman

শেখ হাসিনা যে কখন কি বলেন নিজেও নিশ্চয়ই তার তাত্পর্য ভেবে দেখেন না। দুর্গাপূজার মণ্ডপে গিয়ে তার ভোটব্যাংককে তোষণের উদ্দেশ্যে তিনি দেশে ফসল ভালো হওয়ার জন্য তার মা দুর্গাকে ধন্যবাদ দেন, বাংলাদেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের তিনি সন্ত্রাসী রূপে চিত্রিত করেন, আল্লাহ-রাসুল (দ.) আর ইসলামের বিরুদ্ধে কুত্সা রটনাকারী শাহবাগী ব্লগারদের তিনি পোষণ ও তোষণ করেন, আর অন্যদিকে এসবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদকারী হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে যোগদানকারীদের ওপর রাতের আঁধারে বুলেটবৃষ্টি করে বাংলাদেশী জালিওয়ানওয়ালা বাগ গণহত্যা সৃষ্টি করেন। প্রগলভতা আর দম্ভের নতুন মাত্রা দেখিয়েছেন শেখ হাসিনা ২৬ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার। ফরিদপুরের ভাঙায় এক নির্বাচনী সভায় তিনি আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীককে নূহ নবীর কিস্তির সঙ্গে তুলনা করেছেন। তিনি বলেছেন, আওয়ামী লীগের নৌকা হচ্ছে সেই কিস্তি যা দিয়ে নূহ নবী মানবজাতিকে উদ্ধার করেছিলেন। আওয়ামী লীগের নেতাদের উচিত হাসিনার দাম্ভিকতার লাগাম টেনে ধরা। তা না হলে হয়তো শিগগিরই তিনি নিজেকে সর্বশক্তিমান আল্লাহতায়ালার সঙ্গে তুলনা করে বসবেন (আস্তাগফিরুল্লাহ)।
তাছাড়া শেখ হাসিনার ইতিহাস জ্ঞানের মধ্যে বরাবরের মতোই বঙ্গোপসাগরের সমান বিশাল ফাঁক রয়ে গেছে। নূহ নবী শুধু মানবজাতিকে নয়, সার্বিক প্রাণী জগতকে রক্ষার জন্যেই নৌকা ভাসিয়েছিলেন এবং প্রতি প্রজাতির একজোড়া করে প্রাণীকে তিনি সে নৌকায় তুলেছিলেন। তবে এখানে হয়তো হাসিনার উক্তিতে কিছুটা মিল খুঁজে পাওয়া যেতে পারে। তিনি তার নৌকা প্রতীক দিয়ে এমন এক বাংলাদেশ সৃষ্টি করতে চান যেখানে শুধুমাত্র অত্যাচারী আওয়ামী লীগই (চোর-চোট্টা-দাগাবাজসহ) টিকে থাকতে পারবে।
বাংলাদেশের ষোলোআনা মানুষ কেন হাসিনা, তার সরকার ও তার দলের বিরুদ্ধ ক্রুদ্ধ আক্রোশে ফেটে পড়েছে কখনো ভেবে দেখেছেন তিনি? এ দেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমানকে তিনি সন্ত্রাসী বলে অপবাদ দেন, অপমান করেন, ভোটের অধিকার থেকে তিনি তাদের বঞ্চিত করেন। হাসিনা মনে করেন তিনি যা ভাবেন সেটাই সঠিক এবং অন্যরা সকলে স্টুপিড। বিশ্বের সুপরামর্শ এবং হিতোপদেশকে তিনি লাথি মেরে সরিয়ে দেন। তিনি গায়ের জোরে অন্যদের ধ্বংস করে দিতে উঠেপড়ে লেগেছেন। ইতিহাসের মতো তার ভূগোল জ্ঞানও ভুলে ভর্তি। পৃথিবীতে তিনি দিল্লির সরকার ছাড়া আর কোনো দেশ ও প্রতিষ্ঠানকে দেখতে পান না।
হাসিনার প্রগলভ দাবিগুলোর মধ্যে সর্বশেষ কবে সত্যতা দেখেছিলেন? ভাঙার আলোচ্য নির্বাচনী সভাতেই তিনি পদ্মা সেতু তৈরি না হওয়ার জন্য বিএনপিকে দায়ী করেছেন। তিনি দাবি করেছেন, এই সেতু সংক্রান্ত দুর্নীতিতে জড়িতদের কেউ তার আত্মীয় নন। কানাডার আদালতে এ সংক্রান্ত যে মামলাটি বর্তমানে মুলতবি আছে তার অভিযোগপত্র বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ দেখতে পায়নি, তারা যাতে দেখতে ও জানতে না পায় সে জন্য সকল প্রকারের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। সে অভিযোগপত্রে কাদের নাম আছে সেটা একদিন জানাজানি হবেই। সে মামলার ব্যাপারে তদন্তে প্রধানমন্ত্রীর অতি নিকট আত্মীয়দের কারও কারও সম্পদের উত্স সম্বন্ধে কেন অনুসন্ধান করা হচ্ছে সে প্রশ্নও উঠতে বাধ্য।
ঘটনাগুলো সুদূর অতীতের নয়, অতিসাম্প্রতিক। এ ক্ষেত্রে দেশের মানুষকে প্রতারিত করা যাবে না। পদ্মাসেতুর অর্থায়ন সর্বশেষ যে কারণে বিশ্বব্যাংক করেনি সেটা কারোই ভুলে যাবার কথা নয়। বিশ্বব্যাংক দুর্নীতিতে সর্বাধিক জড়িত ব্যক্তিদের নামের একটা তালিকা বাংলাদেশ সরকারকে পাঠিয়েছিল এবং সংশ্লিষ্টদের বিচার ও শাস্তি দাবি করেছিল। বহু ধানাই-পানাইয়ের পরও সরকার এবং তাদের আজ্ঞাবহ দুর্নীতি দমন কমিশন সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের বিচার, এমনকি তার বিরুদ্ধে অভিযোগ সম্বন্ধে তদন্ত করতেও অস্বীকার করেছে।
ওরা দুর্নীতির দল
তখন বহু মহল থেকেই এ সমলোচনা উঠেছিলো যে আবুল হোসেন হয়তো সরকারের এবং শাসক দলের শীর্ষ ব্যক্তিদের কারো কারো হয়ে প্রক্সিতে দুর্নীতি করেছিলেন; সেই শীর্ষ ব্যক্তিদের পরিচয় ফাঁস হয়ে যাবার ভয়েই আবুল হোসেনকে সযত্নে তদন্ত ও বিচার থেকে রক্ষা করা হয়েছে এবং বাংলাদেশ একটি অতিগুরুত্বপূর্ণ সেতু থেকে বঞ্চিত হয়েছে। লজ্জার মাথা খেয়ে এখন হাসিনা আবারও মানুষের ভোট প্রার্থনা করছেন এবং বলছেন যে আবার তিনি ক্ষমতায় এলে পদ্মার ওপর সেতু তৈরি হবে। কিন্তু দেশের মানুষ ভাবছে অন্য কথা। বিগত নির্বাচনের আগেও বহু প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তিনি। তার কোনটি তিনি পালন করতে পেরেছেন? সাধারণ মানুষ বরং মনে করে হাসিনা আর ক্ষমতা না পেলেই দ্রুত একটা সুষ্ঠু ও দুর্নীতিমুক্ত সেতু নির্মাণ সম্ভব হবে এবং দেশের সার্বিক মঙ্গল হবে।
বাংলাদেশের অন্ধ-বধির মানুষও জানেন আওয়ামী লীগ দুর্নীতির দল। বিগত নির্বাচনের আগে হাসিনা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে জয়ী হলে মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের সম্পদের বিবরণ নিয়মিত প্রকাশ করা হবে। কোথায় গেল শেখ হাসিনার সে প্রতিশ্রুতি? প্রতিশ্রুতির যারা বরখেলাপ করে বাংলাদেশের মানুষ তাদের বলে বেঈমান। মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে গদি লাভের কিছুদিনের মধ্যেই হাসিনা সে প্রতিশ্রুতি গিলে খেলেন। কোনো মন্ত্রী কিংবা সংসদ সদস্যেরই সম্পদের বিবরণ কখনো প্রকাশ করা হয়নি।
নির্বাচনী বিধি অনুযায়ী প্রার্থীরা সম্পদের বিবরণ হলফনামায় ঘোষণা করতে বাধ্য। যে ক’জন সে বিবরণ দিয়েছিলেন তাতে দেখা যাচ্ছে বিগত পাঁচ বছরে আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের বিত্ত-সম্পদের পরিমাণ বহুগুণ, এমনকি কারো কারো ক্ষেত্রে শত শত গুণও বেড়ে গেছে। সেসব কেলেঙ্কারি চাপা দেবার মতলবে সরকারের হুকুমের দাস নির্বাচন কমিশন এখন তাদের ওয়েবসাইট থেকেও সেসব বিবরণ গুম করে ফেলেছে। প্রকৃত পরিস্থিতি এই যে, আওয়ামী লীগ দেশের যাবতীয় বিত্ত-সম্পদ তাদের দলের নেতা-কর্মীদের হাতে পুঞ্জীভূত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সম্পদের অর্থ শক্তি। এভাবে শক্তি কেন্দ্রীভূত করে শেখ হাসিনা চিরস্থায়ীভাবে ক্ষমতা নিজেদের হাতে রাখার পরিকল্পনা করেছেন।
বাইবেলের কাহিনী এবং আওয়ামীদের স্বরূপ
বিগত কয়েক মাসে বাংলাদেশে যা ঘটছে সেটাকে একটা চাপা গৃহযুদ্ধ বলতেই হয়। সরকার রাজনৈতিক বিরোধীদের নির্মূল করে শোষণের রাজত্ব কায়েম করতে চায়। বাইবেলে আছে ভবিষ্যত্ বক্তারা বলেছিলেন জুডিয়াতে (বর্তমান ইসরাইল) এমন এক শিশুর জন্ম হবে যে হবে রাজার রাজা। রাজ্য হারানোর ভয়ে দুর্নীতিবাজ ও অত্যাচারী রাজা হ্যারোড সকল নবজাত পুরুষ সন্তানকে হত্যা করার নির্দেশ দিয়েছিলেন তার সৈন্যদের। দৈবাত্ যোসেফ ও মেরী ঈসা নবী (দঃ)কে (যিশু খ্রিস্ট) নিয়ে মিসরের পথে পাড়ি দিয়েছিলেন। পাইকারি শিশু হত্যা হ্যারোডের মসনদ রক্ষা করতে পারেনি।
আওয়ামী লীগ হ্যারোডের মতোই রাজনীতি করতে ভালোবাসে। কোনো প্রকার বিরোধিতা কিংবা সমালোচনার মুখে তারা রাজনীতি করতে পারে না। শেখ মুজিব যখন প্রথম বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন তার তখনকার জনপ্রিয়তা আধুনিক ইতিহাসে একমাত্র নেলসন ম্যান্ডেলার সঙ্গেই তুলনা করা যেতে পারে। কিন্তু সে জনপ্রিয়তা নিয়েও তিনি সন্তুষ্ট থাকতে পারেননি। ‘লাল ঘোড়া দাবাইয়া’ দেবার হুমকি দিয়েছিলেন তিনি, পেছন থেকে গুলি করে সিরাজ শিকদারকে হত্যা করা হয়েছিল, রক্ষীবাহিনী ৪০ হাজার বিরোধী ও সমালোচককে হত্যা করেছিলেন, সংসদে ৯৫ শতাংশেরও বেশি গরিষ্ঠতা থাকা সত্ত্বেও একদলীয় সংসদ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে তিনি মধ্যমেয়াদে নির্বাচন করেছিলেন। শেখ হাসিনাও বারবারই খালেদা জিয়া ও বিএনপিকে রাজনীতির মানচিত্র থেকে মুছে ফেলতে চেয়েছেন, তিনি এবং তার মাস্তান মন্ত্রীরা এখন আবার খালেদা জিয়াকে পাকিস্তানে, আফগানিস্তানে কিংবা পাবনায় পাঠিয়ে দিতে চান। তাদের খালেদা ও বিএনপি ভীতি প্রকারান্তরে তাদের গণতন্ত্র ভীতিরই পরিচয় দেয়।
শেখ হাসিনার মন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগ নেতারা বিএনপি দল এবং সারা দেশেরই নেত্রী খালেদা জিয়াকে বিলুপ্ত করার প্রকাশ্য হুমকি দিয়ে চলেছেন। বিগত এক বছরে বাংলাদেশে প্রায় ছয়শ’ রাজনৈতিক হত্যা হয়েছে, আহত হয়েছেন ২২ হাজার। এসবের প্রায় সবগুলোর জন্যই দায়ী আওয়ামী লীগের ক্যাডাররা। প্রকাশিত খবর অনুযায়ী বিরোধী দলীয় কর্মীদের হত্যার জন্য আওয়ামী লীগ ক্যাডারদের আরও ৫০ হাজার আগ্নেয়াস্ত্র দেয়া হয়েছে। বিরোধী দলকে সভা-সমাবেশ ও মিছিল করার গণতান্ত্রিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। মিথ্যুক সরকার উদ্ভট ও অবিশ্বাস্য অভিযোগে বিরোধী পক্ষের নেতাদের বিরুদ্ধে মামলার পাহাড় গড়ে তুলেছে।
ফ্যাসিবাদ এভাবেই গড়ে ওঠে
বিএনপির যে নেতা যখনই মুখ খোলেন তখনই তাকে বাংলা মোটরে কনস্টেবল হত্যা কিম্বা গাড়ি ভাংচুরের জন্য অভিযুক্ত করা হয়। শীর্ষ নেতাদের প্রায় সকলকে এবং দেশজোড়া হাজার হাজার রাজনৈতিক কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ৮৮ বছর বয়স্ক ড. আরএ গনির বিরুদ্ধেও পুলিশ কনস্টেবল হত্যার হাস্যকর অভিযোগ এনেছে এই সরকার। গত ২৯ ডিসেম্বর বিএনপির মার্চ ফর ডেমোক্র্যাসি কর্মসূচির দিন এবং তার আগের দু’দিনে গ্রেফতার করা হয়েছে এক হাজারেরও বেশি। বাংলাদেশের কারাগার ও বন্দি শিবিরগুলো এখন হিটলারের কনসেনট্রেশন ক্যাম্পগুলোর মতোই টইটম্বুর ভরাট হয়ে গেছে।
ইউরোপের ইতিহাসে অনুরূপ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল বিগত শতাব্দীর ত্রিশের দশকে। অ্যাডলফ হিটলার বিশ্ব জয়ের স্বপ্নে প্রথমেই সকল সম্ভাব্য উপায়ে সকল সমালোচনা ও রাজনৈতিক বিরোধিতাকে হত্যা করেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ক্লান্তি ও বিভীষিকা ইউরোপীয় রাজনীতিকরা তখনো ভুলতে পারেননি। গোড়ায় তারা হিটলারের ফ্যাসিস্ট অত্যাচার ও নির্যাতনকে উপেক্ষা ও ক্ষমার, এমনকি প্রশ্রয়ের চোখেই দেখেছেন। তাদের টনক নড়েছিল অতি বিলম্বে—হিটলার যখন চেকোস্লোভাকিয়া এবং পোল্যান্ড আক্রমণ করেন। কিন্তু তখন খুবই বিলম্ব হয়ে গিয়েছিল। একজন অতি-উচ্চাভিলাসী ব্যক্তির বাড়াবাড়ি এবং অবাধ্যতার কারণে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয় এবং সে যুদ্ধে কয়েক কোটি মানুষ মারা গিয়েছিল, গোটা মানব সভ্যতাই ধ্বংস হতে বসেছিল।
ভবিষ্যতে পুনরাবৃত্তি প্রতিরোধের লক্ষ্যেই যুদ্ধবিধ্বস্ত পৃথিবী ১৯৪৫ সালে জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তোলে। জাতিসংঘের প্রথম এবং প্রধান কাজ ছিল বিশ্বব্যাপী শান্তি এবং মানুষের অধিকার ও মর্যাদা রক্ষার লক্ষ্যে একটা সনদ তৈরি করা। বাংলাদেশের বর্তমান (বৈধ কি অবৈধ সুনিশ্চিত নয়) প্রধানমন্ত্রী বিগত পাঁচ বছরে যে পথে চলেছেন সেটা বিশ্ব সমাজের প্রতি চূড়ান্ত অবাধ্যতাস্বরূপ। প্রকৃত গণতন্ত্র চর্চা করে দেশে শান্তি এবং উন্নতি-প্রগতির পথ প্রশস্ত করার পরামর্শ বিশ্ব সমাজ তাঁকে দিয়ে এসেছে। কিন্তু ইউরোপীয় ইউনিয়ন, কমনওয়েলথ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন, জাপান, কানাডা, এমনকি জাতিসংঘের প্রতিও তিনি চরম অবমাননা দেখিয়ে চলেছেন। উপরোক্ত সবগুলো দেশ এবং সংস্থা পরামর্শ দিয়েছে সংলাপের মাধ্যমে সকলের গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি করতে। কিন্তু হাসিনা সেসব পরামর্শ গ্রাহ্য করেননি, কেননা তিনি জানেন পাঁচ বছর ধরে তিনি যে জাতি ও গণবিরোধী পথে চলেছেন তাতে সাধারণ মানুষের ভোটে তাঁর আবার ক্ষমতা পাবার কোনো সম্ভাবনাই নেই।
আমাদের ধর্মীয় সংস্কৃতিতে বিশ্বাস করা হয়, আল্লাহ যাকে ধ্বংস করতে চান তাকে আগে উন্মাদ করে দেন। সরকার ও প্রধানমন্ত্রীর আচরণ এবং কথাবার্তা থেকে অবশ্যই মনে হবে তারা সবাই জ্ঞান-বুদ্ধির কাছ থেকে বিদায় নিয়েছেন! শেখ হাসিনার উন্মাদ আচরণ বন্ধ করা না গেলে বাংলাদেশে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে সেটা গোটা দক্ষিণ এশিয়ার শান্তি ও নিরাপত্তার প্রতি হুমকি হয়ে দাঁড়াতে বাধ্য। দেশে এবং বিদেশে সকলেই এখন একমত যে হাসিনার ফ্যাসিস্ট শাসন প্রলম্বিত হলে বাংলাদেশের মানুষ পরিত্রাণের জন্যে হাতে অস্ত্র তুলে নিতে বাধ্য হবে—যেমন করে তারা অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিলো পাকিস্তানি অত্যাচারীদের বিরুদ্ধে।
জাতিসংঘের উদ্বেগ যে কারণে
এদেশের মানুষ এখন আর নিরীহ নয়। একাত্তরে তারা গেরিলা যুদ্ধ এবং নাশকতা শিখেছে। অত্যাচারীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সাহস তখনই তাদের হয়েছিল। তখন তারা ৯৩ হাজার পাকিস্তানি সৈন্যের একটা অত্যাধুনিক সুসজ্জিত বাহিনীকে নাস্তানাবুদ করে ছেড়েছিলো। অনুরূপ পরিস্থিতি যদি আবার দেখা যায় এই মানুষগুলো চুপচাপ ঘরে বসে থাকবে না এবং সে প্রতিরোধ উপছে সীমান্তের বাইরেও চলে যাবে। প্রতিবেশী পরাশক্তি ভারতেরও সেটা গভীর চিন্তার কারণ হওয়া উচিত। উত্তর-পূর্ব ভারতের সাতটি রাজ্য বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবার জন্য চার দশকেরও বেশিদিন ধরে গেরিলা যুদ্ধ চালাচ্ছে। ভারতের অন্যান্য রাজ্যে (পশ্চিমবঙ্গসহ) ত্রিশটিরও বেশি সন্ত্রাসী দল ও গোষ্ঠী বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবার জন্য সংগ্রাম করছে। বাংলাদেশে একটা গৃহযুদ্ধের বিস্ফোরণ ঘটলে তার প্রভাব ভারতেও পড়তে বাধ্য।
খুব সম্ভবত, এসব সম্ভাবনা জাতিসংঘ সদর দফতরেও উদ্বেগ সৃষ্টি করছে। সংলাপের মাধ্যমে বিরোধী দলের সঙ্গে বিবাদ মিটিয়ে ফেলার উপদেশ দিয়ে জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন কয়েক দফায় শেখ হাসিনাকে টেলিফোন করেছেন। রাজনীতি বিষয়ে তার বিশেষ সহকারী অস্কার ফার্নান্ডেজ তারাঙ্কো একাধিকবার বাংলাদেশ সফর করেছেন। সরকার সংলাপ করবে বলে তাঁকে প্রতিশ্রুতি দিলেও তাঁর বাংলাদেশ ত্যাগের সঙ্গে সঙ্গে তারা ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। সংলাপ হয়নি। সমস্যা এখন সঙ্কটে পরিণত হয়েছে।
মি. তারাঙ্কো মহাসচিবের কাছে সর্বশেষ যে প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন। জানা গেছে, তাতে চারটি সুপারিশ রয়েছে। সুপারিশগুলো হচ্ছে (১) অবিলম্বে বিরোধীদলের নেতা-কর্মীদের মুক্তিদান, তাদের অফিস খুলে দেয়াসহ স্বাভাবিক রাজনৈতিক কার্যক্রম চালু রাখা এবং সভা-সমাবেশে কোনো রকম বাধা না দেয়া, (২) নির্বাচনকালীন সময়ে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর ছুটিতে যাওয়া, (৩) প্রথম দু’টি প্রস্তাব মেনে নেয়া না হলে জাতিসংঘের একটি বিশেষ কমিটির তত্ত্বাবধানে নির্বাচন অনুষ্ঠান, এবং (৪) উপরোক্ত কোনো পন্থায় সমাধান না হলে জাতিসংঘ সনদের (উপরে বর্ণিত) সপ্তম অধ্যায় অনুযায়ী সামরিক পদক্ষেপ এবং প্রয়োজনে শক্তি প্রয়োগ।
আগেই বলেছি অবাধ্য ও দুর্বৃত্ত দেশগুলোকে সামলে রাখা ও শায়েস্তা করার উদ্দেশ্যেই জাতিসংঘের সনদটি প্রণীত এবং গৃহীত হয়েছিল। অবাধ্য সদস্য দেশের শাসনের জন্য প্রয়োজনবোধে সামরিক শক্তি ব্যবহার ছাড়াও অন্যান্য শাস্তিমূলক ব্যবস্থার বিধান আছে সনদে। যেমন সপ্তম অধ্যায়ের ৪১ ধারায় অপরাধী দেশের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক, রেল, বিমান, ডাক ও তার যোগাযোগ সম্পূর্ণ কিম্বা আংশিকভাবে বিচ্ছিন্ন করার নির্দেশ জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে দেয়া যাবে। বাংলাদেশের বর্তমান সরকার তার অবাধ্য আচরণের দ্বারা ভারত ছাড়া সকল গুরুত্বপূর্ণ দেশেরই বিরক্তি উত্পাদন করেছে। এমনকি ভারতের সবচেয়ে পুরাতন মিত্র রাশিয়াও সরকারের নির্বাচন সংক্রান্ত নীতি ও কার্যকলাপ সমর্থন করছে না। মস্কো গত সপ্তাহে জানিয়ে দিয়েছে যে হাসিনা সরকারের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে সে কোনো পর্যবেক্ষক পাঠাবে না।
জাতিসংঘের যে কোনো সদস্য দেশ এ সরকারের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার জন্য জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদকে অনুরোধ করতে পারে। মনে হচ্ছে সে অনুরোধ ইতিমধ্যেই করা হয়েছে। সর্বশেষ খবর অনুযায়ী বাংলাদেশ পরিস্থিতি বিবেচনার জন্য জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ জানুয়ারির শুরুতেই বৈঠকে বসবে।
হরতাল-অবরোধে হাসিনার মেকি অরুচি
সরকারের গোঁয়ার্তুমি এবং প্রতারণাপূর্ণ পন্থায় গদি দখলে রাখার চেষ্টার প্রতিবাদে বিএনপি এবং ১৮ দলের জোট বহু প্রকার আন্দোলন করছে। ফ্যাসিস্ট পন্থায় তাদের সভা-সমাবেশ করার গণতান্ত্রিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। বাধ্য হয়ে তাদের হরতালের পথ ধরতে হয়েছিলো। মনে হচ্ছে প্রতিবাদ, হরতাল ইত্যাদিতে হঠাত্ করে শেখ হাসিনার অরুচি ধরে গেছে। ১৯৯১ সালে নির্বাচিত সরকারের মেয়াদে তিনি ১৭৩ দিন হরতাল করেছিলেন, তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতিতে নির্বাচনের দাবিতে লাগাতার হরতাল ও অবরোধ করে তিনি দেশ অচল করে দিয়েছিলেন, অনেকগুলো নরহত্যা ঘটিয়েছিলেন। বিগত পাঁচ বছরে বিএনপি ও ১৮ দলের জোট হরতাল করেছে আজ অবধি ৬৫ দিন, অবরোধ হয়েছে ২৩ দিন। এখন কিন্তু ‘আইন-শৃঙ্খলার’ দরদ তার উথলে উঠেছে।
শান্তিপূর্ণ পন্থায় বিরোধী পক্ষকে নিজেদের প্রতিবাদ দেশবাসীকে জানান দেয়া এবং সমর্থন সংগ্রহের চেষ্টার সুযোগ দান ছিল যে কোনো সভ্য সরকারের কর্তব্য। কিন্তু বর্তমান সরকারকে প্রকাশ্যে অসভ্য বলা হয় না সৌজন্যের খাতিরে। তারা পুলিশ, র্যাব এবং আওয়ামী লীগের সশস্ত্র ক্যাডার ও ভাড়াটে গুণ্ডাদের দিয়ে বিরোধীদের হরতাল-মিছিলে বাধা দিয়েছে। বিশৃঙ্খলা, অশান্তি, সম্পত্তির ক্ষতি, এমনকি কিছু মূল্যবান প্রাণহানিও ঘটেছে আওয়ামী লীগ সরকারের নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের ফলে। সেসব ঘটনা নিয়ে মিথ্যা প্রচার চালিয়ে সরকার বিরোধী দলগুলোকে দুর্নাম ও অপবাদ দেবার ব্যর্থ চেষ্টা করেছে।
গত সোমবার ২৯ ডিসেম্বর এবং পরের দু’দিনে যা ঘটেছে তাতে ঢাকা নগরী রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছিল। ঢাকার বাইরে সরকারের নিয়ন্ত্রণ অনেকদিন আগেই হাতছাড়া হয়ে গেছে। বিরোধী দলের অবরোধের বিরুদ্ধে সরকারের মন্ত্রীরা বহু চেঁচামেচি করেছেন। কিন্তু ২৯ তারিখের দু’দিন আগে থেকেই সরকার যেন দুর্ভেদ্য প্রাচীর তৈরি করে তার আড়ালে আত্মগোপন করেছিল। সদরঘাটের লঞ্চঘাট বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। দেশের সকল অঞ্চল থেকে প্রতিদিন যে শত শত লঞ্চ ঢাকায় আসে তাদের যাত্রা শুরু করতে দেয়া হয়নি। দূরপাল্লার কোনো বাস ঢাকা অভিমুখে ছাড়তে দেয়া হয়নি। ট্রেনগুলো ঢাকা থেকে দূরের কোনো স্টেশনে থামিয়ে দেয়া হয়। এমনকি প্রাইভেট গাড়িতে কিম্বা পায়ে হেঁটেও কাউকে ঢাকার দিকে এগুতে দেয়া হয়নি। শেখ হাসিনার সরকার বাংলাদেশের মানুষকে কেমন ভয় করে এই হচ্ছে তার কিছু নমুনা।
সনাতনী ঐতিহ্য
গুণ্ডাগার্দি আওয়ামী লীগের সনাতনী ঐতিহ্য। হাসিনার ’৯৬ সালের সরকারের আমলে খোদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম সরকারের ইচ্ছা অনুযায়ী রায় দিতে বিচারপতিদের ওপর চাপ সৃষ্টির লক্ষ্যে গজারী কাঠের লাঠিধারীদের মিছিল নিয়ে সুপ্রিমকোর্ট প্রদক্ষিণ করেছিলেন। মনে হচ্ছে একমাত্র লাঠি নির্মাণ শিল্পই ইদানীং বাংলাদেশে ফুলটাইম কাজ করছিল। একই মাপের এবং একই চেহারার লাঠি উঁচিয়ে হাজার হাজার মানুষের মিছিলের আলোকচিত্র বিশ্ব মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়েছে। সুপ্রিমকোর্টের আর জাতীয় প্রেস ক্লাবের ভেতরে ঢুকে আওয়ামী লীগের ভাড়াটে গুণ্ডারা আইনজীবী ও সাংবাদিকদের লাঠিপেটা করেছে, তিনবারের প্রধানমন্ত্রী এবং বর্তমানে প্রধান বিরোধী বিএনপি দলের ও ১৮ দলের জোটের নেতা বেগম খালেদা জিয়াকে দিনের পর দিন বালুভর্তি ট্রাক আর পুলিশের দেয়াল দিয়ে গৃহবন্দি করে রেখেছে, এসব দৃশ্যের পর বাংলাদেশের বর্তমান শাসকদের সভ্য বলে বিশ্বাস করতে বিশ্ববাসীর অসুবিধা হবে।
আওয়ামী লীগের মহাসচিব সৈয়দ আশরাফ সব সময় স্থিরমতি থাকেন না। তার রক্তচক্ষু ও বেসামাল হুঙ্কার যে তরল এবং কৃত্রিম সামগ্রীর প্রভাবে ঘটে বাংলাদেশের মানুষ অনেকদিন আগে থেকেই জানে। ইদানীং মনে হচ্ছে আরও কোনো কোনো মন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগ নেতাও একই তরল ও রাসায়নিক পদার্থের যাত্রী হয়েছেন। এদের হুঙ্কার আর তর্জন-গর্জনে খালেদা জিয়া কিম্বা অন্য কোনো বিএনপি নেতা ভয় পাবেন বলে আমার মনে হয় না। বরং বাংলাদেশের মানুষ তাদের পূর্বপুরুষদের সম্বন্ধেই বিরূপ ধারণা পোষণ করবে। মানুষ গণতন্ত্র চায়। যে কোনোভাবেই হোক শেষ পর্যন্ত তারা গণতন্ত্র আদায় করেই ছাড়বে। তারা স্বাধীনতা চেয়েছে এবং এখনো চায়। দেশের স্বাধীনতা রক্ষার এবং দেশকে পরের হাতে তুলে দেয়া তারা প্রাণ দিয়ে হলেও প্রতিরোধ করবে।
ইংরেজি নতুন বছরের শুভ কামনা আপনাদের সবার জন্য। বিভীষিকার কালরাত্রি অতিক্রম করে এ বছর আপনাদের জন্য সুখী ও নিরাপদ হোক। এ বছরে বাংলাদেশ অত্যাচারী ও গণবিরোধীদের বিতাড়িত করে গণতন্ত্র, উন্নতি ও প্রগতির পথে সম্মুখযাত্রা শুরু করুক।
ত্রুটি স্বীকার : গত সপ্তাহের কলামে অসাবধানতাবশত কমনওয়েলথের সদস্য দেশের সংখ্যা ২৭টি বলে লেখা হয়েছিল। সে জন্যে আমি আন্তরিক দুঃখিত। এ সংস্থার বর্তমান সদস্য সংখ্যা ৫৩।
(লন্ডন, পয়লা জানুয়ারি ২০১৪)
serajurrahman34@gmail.com

Facebook Comments Box
advertisement

Posted ০৪:২৭ | শুক্রবার, ০৩ জানুয়ারি ২০১৪

Swadhindesh -স্বাধীনদেশ |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

advertisement
advertisement
advertisement
Advisory Editor
Professor Abdul Quadir Saleh
Editor
Advocate Md Obaydul Kabir
যোগাযোগ

Bangladesh : Moghbazar, Ramna, Dhaka -1217

ফোন : Europe Office: 560 Coventry Road, Small Heath, Birmingham, B10 0UN,

E-mail: news@swadhindesh.com, swadhindesh24@gmail.com