সোমবার ২৯শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১৬ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ধর্ষিত গণতন্ত্রের গন্তব্য কোথায়

  |   বৃহস্পতিবার, ০৩ এপ্রিল ২০১৪ | প্রিন্ট

অলিউল্লাহ নোমান

Noman_2

কোন দিকে যাচ্ছি আমরা। গন্তব্য কোথায় আমাদের। আইনের শাসনের নামে সব কিছুই চলছে ব্যক্তির ইচ্ছায়। গণতন্ত্রের নামে মানুষ দেখছে জবরদস্তি। শেষ দুই দফা উপজেলা নির্বাচনে কেন্দ্র দখলের চিত্র ছিল সর্বত্র। শুধু দখলই নয়, আগের রাতে ব্যালটবাক্স ভোটে পূর্ণ করার খবরও বের হয়েছে। তারপরও ইলেকশন কমিশনের মুখে শুনতে হয়েছে সন্তুষ্টির বাণী। সরকারি দলের ভাষায় ছিল শান্তিপূর্ণ ভোট সমাপ্তি। 

বিরোধী দল হাফ ছেড়ে বলছে এইতো প্রমাণ হলো আওয়ামী লীগের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। প্রতি ধাপে নির্বাচনের আগে বিরোধী দল বিএনপির সংবাদ সম্মেলনে বলা হতো এবার কারচুপি হলো কঠোর কর্মসূচি দেয়া হবে। নির্বাচন পরবর্তী অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে কারচুপি হয়নি। তাই কর্মসূচির কঠোরতাও নেই। গতানুগতিক কিছু বয়ান রেখেই তৃপ্তির ঢেকুর বিরোধী নেতাদের মুখে। 

প্রথম দুই দফা নির্বাচনের পর বিরোধী দল বিএনপি এগিয়ে ছিল। তখন বিএনপির অনেকেই মনে করছিলেন এই বুঝি ক্ষমতায় চলে আসছি। অবশ্য ক্ষমতায় চলে আসার ভাবটা ২০১০ সাল থেকেই আঁচ করা যাচ্ছিল। প্রথমে পৌরসভা, ইউনিয়ন এবং সর্বশেষ সিটি করপোরেশনগুলোর নির্বাচনী বিজয়ে বিএনপির একচেটিয়া প্রাধান্য ছিল। এই প্রাধান্য দেখে ভাব ছিল ক্ষমতায় বসি বসি অবস্থা। আওয়ামী দুঃশাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করলে অর্থনীতির ক্ষতি হবে। সেই ক্ষতির বোঝা ক্ষমতায় এসে বহন করতে হবে বিএনপিকে। এমন কথাও তখন শোনা গেছে অনেক নেতার মুখে। আন্দোলন থেকে বার বার পিছুটান দেয়ার নেপথ্য কারণগুলোর মধ্যে এটাও একটি ইস্যু ছিল। আরও বলা হতো আওয়ামী লীগ যত ক্ষমতায় থাকবে নিজেরাই তত পচবে। সুতরাং কোনো রকমে ৫ বছর পার করতে পারলেই হলো। ক্ষমতায় চলে আসবে বিএনপি। তাইতো আমলা থেকে আসা নেতারা গুলশানে বসে মন্ত্রণালয় ভাগাভাগির করছেন, এমন কথাও বাতাসে ভাসত। 

ক্ষমতার চেয়ারে বসার অপেক্ষায় কেটে গেল ৫ বছর। ততদিনে প্রস্তুতিতে অনেক দূর এগিয়ে গেছে আওয়ামী লীগ। আওয়ামী আমলের প্রথম ধাপের শেষ দিকে এসে হাবুডুবু খেয়েছে বিরোধী দল। বিরোধী দলের ক্ষমতায় যাই যাই ভাব দেখে আওয়ামী লীগ গুছিয়ে নেয় সবকিছু। বিরোধী দলের দুর্বল জায়গাগুলো চিহ্নিত করে আক্রমণের নিশানা প্রস্তুত করা হয় আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে। তখন আন্দোলনের কঠোরতা চেয়েও পারা যায়নি। বলা হয় ঢাকা বাইরে কঠোর আন্দোলন হয়েছে। কথাটা সত্য। কিন্তু যারা আন্দোলনে সক্রিয় ছিল তাদের অবস্থা এখন খুবই করুণ। যাদের জীবন গেছে পরিবারগুলো এখন অসহায়। তারা কেউ কখনও ক্ষমতার অংশ ছিলেন না। তাদের সহায় সম্পদ নেই। এজন্য তারা আন্দোলন করতে পেরেছেন। কিন্তু অতীতে যারা ক্ষমতার চেয়ারে ছিলেন তাদের সেই আন্দোলনে দেখা যায়নি। 

অতীতে সুবিধাভোগী অনেকেই আওয়ামী লীগের কাছে বিক্রি হয়ে গেছেন। কেউ কেউ অর্থ সম্পদ রক্ষার তাগিদে গুটিয়ে রাখেন নিজেকে। নাড়া ছাড়া করলেই সম্পদের রশি ধরে টান দেয়ার হুমকি আসে সরকারি মহল থেকে। অনেকেই আবার আওয়ামী নির্যাতনের ভয়ে আত্মগোপনে। এই অবস্থায় প্রায়ই একা হয়ে যান বেগম খালেদা জিয়া। যার প্রমাণ দেখা যায় ২৯ ডিসেম্বর। তিনি ডাক দিয়েছিলেন মার্চ ফর ডেমক্রেসি কর্মসূচিতে। তার এই ডাকে দৃঢ়তা ছিল। তার বিশ্বাস ছিল নেতারা এত দিন যাই করুক নিজেদের অস্তিত্বের স্বার্থে হলেও ২৯ ডিসেম্বর মাঠে নামবে। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন তাকে আটকে দেয়া হবে। তাই আগের দিন অডিও বার্তায় আবারও ঘোষণা দলের। তাকে আটকে দেয়া হলেও আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানালেন। 

কেউ আসেননি সেদিন। যাদের সম্পদ নেই, যারা বিক্রি হওয়ার সুযোগ নেই বা আতাতের দরকার নেই তারা অনেকেই ছুটে এসেছিলেন ঢাকায়। নানা পথে ঢাকায় প্রবেশ করেছিলেন বেগম খালেদা জিয়ার ডাকে সাড়া দিতে। কিন্তু যাদের পেছনে তারা যাবেন সেই নেতাদের খবর ছিল না। বেগম খালেদা জিয়া নিজেও বাড়ি থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। দেখা গেছে বাড়ির কাজের একজন মহিলা এবং ব্যক্তিগত নিরাপত্তা কর্মী ছাড়া পাশে কেউ নেই। বাড়ির গেটে আটকে দেয়ার পরও তিনি সাহসী উচ্চারণ করেন। গণতন্ত্রের জন্য তার বলিষ্ঠ কণ্ঠ সেদিন আরও উজ্জীবিত হয়ে উঠেছিল। উপস্থিত মিডিয়া কর্মীদের সামনে তীক্ষষ্ট ভাষায় সরকারি আচরণের কঠোর সমালোচনাও করেন। তার সাহসী উচ্চারণই উজ্জীবিত রেখেছিল স্বার্থহীন কর্মীদের। 

অনেক প্রাণ গেছে রাজপথে। অনেকে গুম হয়েছেন। অনেকের লাশ পাওয়া গেছে। গুম হওয়ার পর অনেকের কোনো খবর পাওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু তাদের এই ত্যাগের কোনো ফসল নেই। কোনো আত্মত্যাগ নিষ্ফল যায় না। তবে আপাতত দৃশ্যমান কোনো ফসল নেই সাম্প্রতিক সরকার বিরোধী আন্দোলনের আত্মত্যাগে। শেখ হাসিনা সরকারের দুর্নীতি, দুঃশাসনের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিতে গিয়ে নিস্ব হয়েছেন মাহমুদুর রহমান। শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন রিমান্ডে। তার প্রতিষ্ঠান দৈনিক আমার দেশ-এর আজ করুণ অবস্থা। কেউ ফিরেও থাকায় না তার দিকে। তার সহায় সম্পদ সবই শেষ করেছেন দুঃশাসন বিরোধী লড়াই করে। ব্যক্তি মাহমুদুর রহমান এবং আমার দেশ-এর দিকে তাকালেই বোঝা যায় সরকারি বিরোধী আন্দোলনে যারা নির্যাতনের শিকার তাদের পরিণতি কতটা কঠিন। আমার নিজের কথা না হয় বাদই দিলাম। 

সংবিধানের ১৫তম সংশোধনী এনে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করা হলো। বড় কোন আওয়াজ নেই এর বিরুদ্ধে। তখন এক রকম চুপই ছিল বিরোধী দল। শুধু তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল নয়, এই সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের নানা বিষয়ে আমূল পরিবর্তন আনা হলো। মূলনীতি থেকে বাদ দেয়া হলো সকল কাজে সর্বশক্তিমান আল্লাহর ওপর আস্থা ও বিশ্বাসের বিধান। এটা বিএনপির ১৯ দফা কর্মসূচির অন্যতম একটি। কিন্তু চুপ করে রইলেন সবাই। যেন আল্লাহর ওপর আস্থা এবং বিশ্বাসের কথা বলা যাবে না। এটা বললে পশ্চিমা দেশগুলো এবং ইন্ডিয়া নাখোশ হতে পারে। ভাবটা এরকম ছিল যে আল্লহার ওপর আস্থা ও বিশ্বাসের বিধান বাদ দেয়া হয়েছে হোক। এটা নিয়ে কোনো কথা বলার দরকার নেই। 

অনেক নেতার মুখেই তখন শোনা গেছে শেষ কয়েক মাস আন্দোলন করা হবে। বাধ্য করা হবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার দিতে। আন্দোলনে বাধ্য না হলে বিদেশিরা বাধ্য করবে। শেখ হাসিনা তত দিনে ক্ষমতায় টিকে থাকার নানা বিকল্প চূড়ান্ত করে বসে রইলেন। পাত্তা দিলেন না পশ্চিমা দেশ- আমেরিকা, ইউরোপ এমনকি জাতিসংঘকে পর্যন্ত। জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিব তারানকো সর্বশেষ সফরের সময় বিদায়ের আগে শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠকে বসার কর্মসূচি নির্ধারিত ছিল। সেই নির্ধারিত বৈঠক পর্যন্ত বাতিল করা হলো। শেখ হাসিনা নিজের মনোবল এবং কৌশল দিয়ে হার মানালেন সবাইকে। এর নামই হলো রাজনীতি। খেলায় নামলে দুই দলই মরিয়া হলে খেলে। গোলদাতা দলই বিজয়ী ঘোষিত হয়। কিন্তু বিএনপির অনেকেই মনে করেছিলেন মাঠে থাকলেই চলবে। খেলতে হবে না। অন্যরা খেলে আওয়ামী লীগের পোস্টে গোল ঢুকিয়ে দেবেন। আর এতে বিজয়ী হবে বিএনপি। শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের গোলপোস্টে কেউ বল প্রবেশ করাতে পারেনি। যা হওয়ার তাই হয়েছে। 

৫ জানুয়ারির এক তরফা নির্বাচনের পর বিএনপির দাবি ছিল কার্যালয় খুলে দিতে হবে। সেটা খুলে দেয়া হয়েছে। দাবি ছিল নেতাদের জেল থেকে ছাড়তে হবে। তখন যারা কারাগারে আটক ছিলেন মুক্তি পেয়েছেন। দাবি ছিল সভা সমাবেশের সুযোগ দিতে হবে। সেটা হয়েছে শর্ত সাপেক্ষে। সেই শর্ত মেনেই বিএনপি প্রথম জনসভা করেছিল সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। সংসদ বসার দিন কালো পতাকা মিছিল কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছিল। শেখ হাসিনার কাছে জানতে চাওয়া হয় সংসদের প্রথম দিনে আপনাদের কালো পতাকা দেখাতে চাই। শেখ হাসিনা রাজি হননি। কালো পতাকা মিছিলও আর হয়নি। পরবর্তিতে বলা হয়েছে অনুমতি পাওয়া যায়নি। তাই কালো পতাকা মিছিল কর্মসূচি বাতিল করা হয়েছে। শেখ হাসিনা অনুমতি দেননি। তাই কর্মসূচি বাতিল। অর্থাত্ বিরোধী দলের কর্মসূচিও এখন নির্ভর করে শেখ হাসিনার মর্জির উপর। 

অনেকেই মনে করেছিলেন উপজেলা নির্বাচনে শেখ হাসিনা খেলবেন না। সুষ্ঠু স্বাভাবিক ভোট হবে। ঠেকায় পড়া মানুষ দলে দলে ভোট কেন্দ্রে এসে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীদের বিজয়ী করবে। সারাদেশের উপজেলাগুলোতে বিজয়ী হবে বিএনপির প্রার্থীরা। তখন বিএনপির বিজয়ী উপজেলা চেয়ারম্যানদের নেতৃত্বে আন্দোলন হবে। জুন-জুলাইয়ের মধ্যে সরকার পতন হবে উপজেলা চেয়ারম্যানদের নেতৃত্বে। কিন্তু শেখ হাসিনা ঠিকই খেলেছেন। উপজেলা নির্বাচনে তাঁর মত করেই ভোট হয়েছে। আওয়ামী লীগের সমর্থিত প্রার্থীদের বিজয়ী করা হয়েছে। ৫ দফা নির্বাচনের প্রতিবারই বলা হয়েছে কারচুপি হলে, ভোট কেন্দ্র দখল হলে কঠোর কর্মসূচি। কারচুপি হয়েছে, ভোটকেন্দ্র দখল হয়েছে, জাল ভোট হয়েছে অর্থাত্ সব রকমের অপরাধ হয়েছে। কিন্তু কঠোর কর্মসূচি কেবল বক্তৃতায়ই বন্দি। এমনকি কারচুপি ঠেকানোর মতো যথেষ্ট প্রস্তুুতিও দেখা যায়নি বিএনপির পক্ষ থেকে। বরং সিদ্ধান্তহীনতা, শেষ মুহূর্তে সিদ্ধান্তের পরিবর্তন, বহিষ্কৃত প্রার্থীকে ভোটের ২দিন আগে দলীয় সমর্থন দেয়া, দলীয় সমর্থিত প্রার্থীকে বহিস্কার করার মত বহু ঘটনা দেখা গেছে।

এতে যা হওয়ার তাই হয়েছে। ওই সব এলাকা গুলোতে বিজয়ী হয়েছে আওয়ামী লীগ। বরং প্রমাণ হয়েছে যথেষ্ট প্রস্তুুতি নেই আগে থেকে।
বিএনপির প্রস্তুতি যাই থাকুক, আন্দোলন যাই হোক এটা বলা যায় শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ভোটের গণতন্ত্রকে ধর্ষণ করেছে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচন এবং উপজেলা নির্বাচনের শেষ দুই ধাপে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের হাতে ধর্ষিত হয়েছে ভোটের গণতন্ত্র। জনগনের ভোটের অধিকার শুধু অস্বীকার করা হয়নি, কেড়ে নেয়া হয়েছে নির্লজ্জভাবে। সব সময় ভোট এবং ভাতের অধিকারের কথা যার মুখ থেকে শোনা যায়, ভোট-ভাতের অধিকার প্রতিষ্ঠার কথা বলতে বলতে যিনি মুখে ফেনা তোলেন তার নেতৃত্বে আজ ধর্ষিত ভোটের অধিকার। 


লেখক : দৈনিক আমার দেশ-এর বিশেষ প্রতিনিধি, বর্তমানে যুক্তরাজ্যে নির্বাসিত

Facebook Comments Box
advertisement

Posted ১৯:৪১ | বৃহস্পতিবার, ০৩ এপ্রিল ২০১৪

Swadhindesh -স্বাধীনদেশ |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

advertisement
advertisement
advertisement
Advisory Editor
Professor Abdul Quadir Saleh
Editor
Advocate Md Obaydul Kabir
যোগাযোগ

Bangladesh : Moghbazar, Ramna, Dhaka -1217

ফোন : Europe Office: 560 Coventry Road, Small Heath, Birmingham, B10 0UN,

E-mail: news@swadhindesh.com, swadhindesh24@gmail.com