সোমবার ২৯শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১৬ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

উপজেলা নির্বাচনে সরকারি হস্তক্ষেপের নিষ্ঠুর অভিজ্ঞতা

  |   বৃহস্পতিবার, ০৬ মার্চ ২০১৪ | প্রিন্ট

অলিউল্লাহ নোমান

Noman_2

উপজেলা নির্বাচন নিয়ে সরকার কতটা মরিয়া এবং বেপরোয়া, তার ছোট একটু নমুনা দিয়ে শুরু করতে চাই। বিএনপি সমর্থিত একমাত্র মহিলা উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন সাবেরা নাজমুল মুন্নি। তিনি যশোরের ঝিকরগাছা থেকে নির্বাচিত হয়েছেন ২৭ ফেব্রুয়ারি। স্বামীর জনপ্রিয়তায় বিজয়ী হন তিনি। স্বামী নাজমুল ইসলাম ঝিকরগাছা বিএনপি সভাপতি ছিলেন। ২০১১ সালের ডিসেম্বরে তাকে অপহরণ করা হয়। ঢাকার মোহাম্মদপুর থানার কাছ থেকে গাড়িসহ অপহরণের পরদিন সকালে লাশ পাওয়া যায় গাজীপুরে। তারই স্ত্রী সাবেরা নাজমুল মুন্নি।
এলাকার মানুষের অনুরোধে তিনি উপজেলা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামেন। তিনি আমার পূর্বপরিচিত। সে সুবাদে উপজেলা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যোগাযোগের চেষ্টা করি। কিন্তু কোনো অবস্থায়ই তার ফোনে ঢোকা যাচ্ছিল না। ভাবছিলাম নির্বাচন নিয়ে হয়তো ব্যস্ত। এজন্য ফোনটি বন্ধ রাখা হয়। কিন্তু না, আমার ধারণা সম্পূর্ণ ভুল ছিল। ফোনটি বন্ধ— সেটা সঠিক। কিন্তু তিনি বন্ধ করে রাখেননি। সরকারি উদ্যোগে তার ফোনটি বন্ধ করে দেয়া হয়। নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পর তিনিই আমাকে ফোন করেন খবরটি জানানোর জন্য। তখন তার কাছে জানতে চাইলাম ফোনটি বন্ধ কেন? জবাবে যা বললেন, তাতে রীতিমত হতবাক হলাম। একটি সরকার কতটা নির্লজ্জ এবং বেহায়া হলে এমন কাজ করতে পারে।
তিনি জানালেন অনেক তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা। উপজেলা নির্বাচনে মনোনয়ন দাখিলের পরদিনই তার মোবাইল ফোনটি বন্ধ করে দেয় গ্রামীণফোন কতৃপক্ষ। তিনি গ্রামীণফোনের সঙ্গে যোগাযোগ করে কারণ জানতে চান। সরাসরি তাকে জানানো হয়—কিছুই করার নেই; বিটিআরসির নির্দেশ। বিটিআরসির নির্দেশে বাধ্য হয়েছে সংযোগটি বন্ধ করে দিতে। এই হলো গ্রামীণফোন কর্তৃপক্ষের কথা। দ্বিতীয় আরেকটি ফোন নেন। সেটিও বন্ধ করে দেয় বিটিআরসি। একে একে ৩টি মোবাইল ফোন বিটিআরসির নির্দেশে বন্ধ করে গ্রামীণফোন। পরবর্তীতে বাধ্য হয়ে আর নিজের নামে ফোন নেননি। অন্যের ফোন ব্যবহার করেছেন নির্বাচনকালীন সময়টুকু। কী অপরাধ তার! সেটা হলো উপজেলা নির্বাচনে তিনি কেন বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী হলেন!
তাকে পরাজিত করার নানা কৌশল করেছে সরকার। তার এলাকায় ৪০টির বেশি কেন্দ্র দখল করা হয় আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীর পক্ষে। ইলেকশনের দিন কেন্দ্র দখলের নালিশ করেও কোনো প্রতিকার পাননি প্রশাসনের কাছ থেকে। তারপরও ৩৪ হাজার ভোটের ব্যবধানে বিজয়ী হয়েছেন তিনি। মানুষের আগ্রহ এবং সাড়া দেখে প্রত্যাশা ছিল ৬০ থেকে ৭০ হাজার ভোটের ব্যবধানে জয়ী হওয়ার। কিন্তু সেটা পারেননি কেন্দ্র দখল ও প্রশাসনের অসহযোগিতার কারণে। তবে ভোটের ব্যবধানটা বেশি হওয়ায় বিজয় ছিনিয়ে নিতে পারেনি তারা—এই হচ্ছে কথা।
নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পর শুরু হয় নতুন প্রক্রিয়ায় নির্যাতন। এবার সরাসরি তাকে নয়, আক্রমণ করা হচ্ছে তার সমর্থক এবং কর্মীদের। অনেক কর্মী-সমর্থকের বাড়িঘরে হামলা করা হয়েছে। ভাঙচুর করা হচ্ছে সহায়সম্পদ। উল্টো মামলা দেয়া হচ্ছে বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে। আওয়ামী লীগ সমর্থকরা হামলা-ভাঙচুরের পর থানা পুলিশ গ্রেফতার করছে বিএনপি সমর্থকদের। এ নিয়ে থানা পুলিশের চলছে গ্রেফতারবাণিজ্য। পুলিশ যাকে পাচ্ছে, তাকেই ধরে নিয়ে যাচ্ছে। অথবা ধরে নেয়ার হুমকি দিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করছে। কোথাও কোনো প্রতিকার পাচ্ছেন না সাবেরা নাজমুল। ডিসি সাহেবের কাছে নালিশ করলে এসপিকে বলতে বলা হয়। এসপি থানার ওসিকে বলছেন। ওসি বলেন—দেখছি বিষয়টি; এ পর্যন্তই। বরং উল্টো তখন বিএনপি সমর্থকদের ওপর থানার নিপীড়ন বেড়ে যায়। সাবেরা নাজমুলের অভিজ্ঞতায় এই হলো উপজেলা নির্বাচনে প্রশাসনের নিরপেক্ষতার নমুনা!
এর আগে কথা হচ্ছিল নওগাঁর এক বিএনপি নেতার সঙ্গে। তিনি নিজে উপজেলা নির্বাচন করেননি। তবে সক্রিয় ছিলেন তার নির্বাচনী আসনের দুই থানার প্রার্থীদের পক্ষে। তার অভিজ্ঞতা আরও নিষ্ঠুর। সাবেরা নাজমুল শেষ পর্যন্ত বিজয়ী হতে পেরেছেন। কিন্তু নওগাঁর এই উপজেলায় শেষ পর্যন্ত ফল পাল্টে দেয়া হয়। দিনভর কেন্দ্র দখলের নানা নাটকীয়তা চলে। কোনো প্রতিকার নেই প্রশাসন থেকে। তার এলাকায় একটি উপজেলায় বিএনপি সমর্থক প্রার্থীকে মাত্র ২২৭ ভোটে পরাজিত ঘোষণা করেন রিটার্নিং অফিসার। ৯ কেন্দ্রে গণনা বাকি থাকা পর্যন্ত ভোটে এগিয়ে ছিলেন ওই প্রার্থী।
রাতে রিটার্নিং অফিসারের কার্যালয়ে ৯টি কেন্দ্রের ভোট গণনা হয়। ওই গণনায় তাকে পরাজিত ঘোষণা করা হয় মাত্র ২২৭ ভোটের ব্যবধানে। দিনের বেলায় দখল করে নেয়া হয় অনেক কেন্দ্র। প্রশাসনের সহযোগিতা নিয়েই এই কেন্দ্র দখল করে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী। প্রশাসনের এরকম ভেলকিবাজি চলছে বিভিন্ন উপজেলায়। যেসব উপজেলায় বিএনপি প্রার্থীরা বেশি ব্যবধানে এগিয়ে থাকেন, সেখানে খুব একটা সুবিধা করতে পারছেন না। তবে কম ব্যবধানে এগিয়ে থাকা এলাকাগুলো জবরদস্তির মাধ্যমে পরাজিত করা হচ্ছে।
ওই নির্বাচনী উপজেলায় আরেকটি অভিজ্ঞতার কথা জানালেন তিনি। সেটা আরও ভয়ঙ্কর। সেখানে বিএনপির একজন বিদ্রোহী প্রার্থী ছিলেন। তিনি পেয়েছেন ১৩ হাজার ভোট। জিজ্ঞাসা করছিলাম বিদ্রোহী প্রার্থী তো বহিষ্কার করা হচ্ছে। তাকে বহিষ্কার করা হয়নি! জানালেন, কেন্দ্র থেকে চার দিন আগে বহিষ্কার করা হয়েছে। তবে ওই বিদ্রোহী প্রার্থী কেন্দ্রের সিল, প্যাড স্বাক্ষর জালিয়াতি করে কেন্দ্র সমর্থিত প্রার্থীকেও বহিষ্কারের খবর গণমাধ্যমে প্রচারের ব্যবস্থা করে। এতে কেন্দ্র আসলে কাকে বহিষ্কার করেছে—এটা নিয়ে কিছু ভোটার বিভ্রান্তির মধ্যে ছিলেন। এই জালিয়াতি যারা করেছেন, তাদের বিএনপি কোন দৃষ্টিতে নেবে—সেটা দলটির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব সিদ্ধান্ত নেবেন। তবে ভবিষ্যত্ উপজেলাগুলোর নির্বাচনে যাতে এরকম বিভ্রান্তি না ছড়াতে পারে কেউ, সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখা উচিত। এরকম বিভ্রান্তি কেউ করলে কেন্দ্র থেকে সরাসরি পাল্টা ব্যবস্থা নিয়ে বিভ্রান্তি দূর করার ত্বরিত পদক্ষেপ নিতে হবে। নতুবা এরকম বিপর্যয় আরও ঘটার আশঙ্কা রয়েছে।
নির্বাচন চলাকালীন আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ দিলে আমলে নিচ্ছে না নির্বাচন কমিশন। কেন্দ্র দখল, জোরজবরদস্তির বিরুদ্ধে কোনো প্রতিকার নেই প্রশাসনের কাছে বলার পরও। উল্টো সহযোগিতা করা হয় সরকার সমর্থক প্রার্থীদের। এরকম অভিযোগের অন্ত নেই। তারপরও কেউ কেউ বলার চেষ্টা করছেন যে, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশ নিলে উপজেলার মতো বিএনপি বিজয়ী হতো। অবশ্য এর একটু যুক্তি রয়েছে। কিন্তু…। এই কিন্তুর কোনো সরল জবাব নেই। তবে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে না যাওয়া সঠিক ছিল—এটাই প্রমাণ করছে উপজেলা নির্বাচন। ৫ জানুয়ারির নির্বাচন ছিল সরকার পরিবর্তনের নির্বাচন। তখন আওয়ামী লীগের অধীন প্রশাসনকে আরও কঠোর নিয়ন্ত্রণে রাখত। আরও বেপরোয়া থাকত বিজয় ছিনিয়ে নেয়ার টার্গেটে। এছাড়া বেশি বেগতিক দেখলে নির্বাচন ভণ্ডুল করে দিতে পারত। কারণ নবম সংসদ বহাল ছিল। চাইলে জরুরি অবস্থা জারি করতে পারতেন রাষ্ট্রপতি।
জরুরি অবস্থা জারি হলে নির্বাচন ছাড়াই তখন শেখ হাসিনা ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করার সুযোগ পেতেন। এখনও ক্ষমতায় রয়েছেন। তখনও থাকতেন। সংবিধানে একটি ফাঁক রাখা হয়েছে। একটি নির্বাচিত সরকারের কাছে আরেকটি নির্বাচিত সরকার ক্ষমতা হস্তান্তর করবে। ১৫তম সংশোধনীতে শেখ হাসিনা অনেক বিকল্প চিন্তা করেই এই ফাঁকটুকু অন্তর্ভুক্ত করেন। সুতরাং তখন সংবিধানের দোহাই দিয়ে নির্বাচন ছাড়াই ক্ষমতায় থাকার সুযোগ হতো, এখন ক্ষমতায় থাকলেও সারা দুনিয়া জানে ভোটারবিহীন নির্বাচনে স্বঘোষিত প্রধানমন্ত্রী। বরং উপজেলা নির্বাচনে সেটাই প্রমাণ করছে শেখ হাসিনা কেন ভোটারবিহীন নির্বাচন করেছেন।
লেখক : দৈনিক আমার দেশ-এর বিশেষ প্রতিনিধি, বর্তমানে যুক্তরাজ্যে নির্বাসিত

Facebook Comments Box
advertisement

Posted ১২:৩৪ | বৃহস্পতিবার, ০৬ মার্চ ২০১৪

Swadhindesh -স্বাধীনদেশ |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

advertisement
advertisement
advertisement
Advisory Editor
Professor Abdul Quadir Saleh
Editor
Advocate Md Obaydul Kabir
যোগাযোগ

Bangladesh : Moghbazar, Ramna, Dhaka -1217

ফোন : Europe Office: 560 Coventry Road, Small Heath, Birmingham, B10 0UN,

E-mail: news@swadhindesh.com, swadhindesh24@gmail.com