| বুধবার, ০১ জানুয়ারি ২০১৪ | প্রিন্ট
ইন্দ্রিয় বিজ্ঞান স্পষ্ট করে জানিয়ে রেখেছে, অন্য কারও বক্তব্য বা তথ্য আমাদের মস্তিষ্কে ঠাঁই পাওয়ার আগে একটা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যায়। হড়হড় করে সবকিছু মাথা নিতে পারে না। নেয়ও না। কোনো তথ্য বা বক্তব্যকে মানুষের মাথা গ্রহণ করে দশ লাখেরও বেশি ব্যান্ডউইথে। কোথায় দশ লাখ, কোথায় চল্লিশ। অর্থাত্ তথ্যপ্রাপ্তির গতি এবং তা প্রকিয়াজাতের গতির মধ্যে আকাশ-পাতাল তফাত। সব কথা মাথায় ঢোকে না। ঢোকা সম্ভবও নয়। অসত্য বা মিথ্যার ক্ষেত্রে বর্জনের ঘটনাটি দ্রুতই ঘটে যায়। কোনো বক্তব্যে বা তথ্যে মানুষ চমকে উঠতে পারে, কিন্তু তা বর্জনের ধারাটি বহুগুণ বেশি গতিতে সম্পন্ন হয়। তথ্যের বেশি চাপ মস্তিষ্ক সইতে পারে না। আর তা যদি হয় বর্তমান প্রধানমন্ত্রী এবং তথ্যমন্ত্রীর দেয়া তথ্য-বক্তব্য।হিটলারের তথ্যমন্ত্রী গোয়েবলসের চাইতে আমাদের তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু কম যান না। সাদ্দামের শেষ তথ্যমন্ত্রীর চাপাবাজিকেও ছাড়িয়ে যাচ্ছেন তিনি।
জনমানসকে চালনা করার উপায় হলো সত্যিকে ঢেকে দেয়া আর মিথ্যাকে খবর হিসেবে বানিয়ে তোলা। নিত্যনতুন কিছু অশালীন অভিযোগ হেনে হেনে মনের মধ্যে বিরোধের মাত্রাটিকে অনেক বাড়িয়ে দেয়া যায়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী এবং তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু এরকম রটনা করছেন সজ্ঞানে। একটা কল্পকথাকে বাস্তবতার পোশাক পরিয়ে ধর্মবিদ্বেষী ও ব্যক্তিবিরোধী রাজনৈতিক উন্মাদনা ও বিদ্বেষকে জাগিয়ে রাখতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে গোটা দুনিয়া যখন জানে যে জার্মানি পোল্যান্ড আক্রমণ করতে যাচ্ছে, তখন হিটলারের গোয়েবলস জার্মানির ভেতরে এই বলে মারমুখো জাতিপ্রেম জাগাচ্ছে যে, পোল্যান্ডই নাকি জার্মানিকে আক্রমণ করতে আসছে।
সেদিন টেলিভিশনে দেখছিলাম, কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী দাঁত-মুখ খিঁচড়ে এক অনুষ্ঠানে বললেন, বিরোধী দলের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া যুদ্ধাপরাধী। কীভাবে? সে ব্যাখ্যা নেই। একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রী, বিএনপি নেত্রী, স্বাধীনতার ঘোষকের স্ত্রী এবং যার জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতার এক কণাও মতিয়া চৌধুরীর নেই, তার সম্পর্কে এমন গুরুতর অভিযোগ কী করে বলতে পারলেন মতিয়া চৌধুরী? ‘অগ্নিকন্যা’ বলে পরিচিত মতিয়া চৌধুরীর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড আর মন্ত্রীগিরি নিয়ে এক শ্রেণীর মিডিয়া ধোপদুরস্ত প্রচার চালায়। অথচ কেয়ারটেকার সরকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে, পঁচানব্বই-ছিয়ানব্বইর কথা বলছি, তেজগাঁও মনিপুরী পাড়ায় প্রধানমন্ত্রীর গাড়িতে পটকা মারার ইন্ধনদাতা কে ছিলেন অথবা জাতীয় প্রেস ক্লাবের পাশে সচিবালয়ের মোড়ে একজন সরকারি কর্মকর্তাকে বিবস্ত্র করার ঘটনাটি কার হাতে ঘটেছিল—সেসব কিন্তু দেশবাসীর অজানা নয়।
মতিয়া চৌধুরীর ওই বক্তব্যকে মানুষ যেমনি করে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছে, একইভাবে ‘জিয়াউর রহমান স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকিস্তানের চর হিসেবে কাজ করেছে’—সংসদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এমন বক্তব্যকেও জনগণ ধিক্কারের সঙ্গে অবজ্ঞা করেছে। কেননা নির্জলা মিথ্যার ভার থেকে নিজেকে মুক্ত করতে না পারলে আমাদের স্মৃতি ভালোভাবে কাজ করে না। ‘বেগম জিয়ার মাথায় সাপের ঝাঁপি’, ‘তারেক রহমান বিদেশে বিলাসবহুল জীবনযাপন করছে’, ‘হলমার্ক-ডেসটিনির কেলেঙ্কারি বিএনপির’, ‘একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা যুদ্ধাপরাধের বিচার বন্ধে দুদককে দিয়ে মন্ত্রীদের চোর বানাতে চাইছে’—এমন সব মিথ্যার বেসাতি প্রতিদিন করতে করতে প্রধানমন্ত্রী মানুষের মন-মগজ থেকে বিদায় নিয়ে ফেলেছেন। তার এসব গুরুত্বহীন কথা নিয়ে মিডিয়াতে আলোচনা হয় না দুটি কারণে—১. ধারাবাহিক মিথ্যাচার বলে ২. প্রধানমন্ত্রী রেগে যেতে পারেন এই ভয়ে।
বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে রাজনীতি থেকে মাইনাস করার দম্ভ দেখিয়ে মন্ত্রিত্ব বাগানো তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুও কম যান না। কোনো সাংবাদিক বর্তমান সরকারের আমলে নির্যাতিত হয়নি—এমন মিথ্যাচারে এরই মধ্যে তিনি সাংবাদিকদের অশ্রদ্ধা কামাই করে ফেলেছেন। স্কাইপ সংলাপ প্রকাশ করে সাংবাদিকতার ইতিহাসে যুগান্তকারী দৈনিক ‘আমার দেশ’ এবং সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থার হুমকি দিয়ে তিনি প্রমাণ করে ফেলেছেন, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা রক্ষা তার কাজ নয় বরং মিডিয়াকে পদানত করাই তার মন্ত্রিত্বের মূল টার্গেট। ‘ক্ষমতায় এলে বর্তমান সরকারের দুর্নীতিবাজদের বিচার করা হবে’—বেগম জিয়ার সাম্প্রতিক এই বক্তব্যকে ‘অশালীন’ বলে আখ্যা দিয়েছেন তথ্যমন্ত্রী। দুর্নীতিবাজদের বিচার করার প্রতিজ্ঞা কীভাবে অশালীন রাজনীতি হতে পারে তা কারও বোধগম্য নয়। আর তার নেত্রী শেখ হাসিনা তো হররোজ একথা বলে থাকেন। পারলে Cherity begins at home’ করুন না।প্রাচীনকালে ঋষিরা যখন সমবেত শ্রোতাদের সম্বোধন করে কিছু বলতেন, তারা আগে বলে নিতেন ‘শং শব্দেঃ’। অর্থ হচ্ছে, যে শব্দসমূহ উচ্চারিত হবে তা সবার কল্যাণ বয়ে আনুক।
কিন্তু বর্তমান সরকারের কর্তাব্যক্তিদের উপলব্ধি হলো—আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়, সরকারের সমালোচনা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়, দুঃসাহস বটে। তাদের কাছে তথ্য হচ্ছে সেই বস্তু যা অপরকে ঘায়েল করার জন্য জড়ো করা হয় এবং নিজেদের বাঁচানোর জন্য অদৃশ্য করা যায় অথবা গুলিয়ে দেয়া যায়। অনাচার-অবিচারকে মিথ্যা দিয়ে ঢেকে রাখাটাই কতক মন্ত্রীর এখন বড় দায়িত্ব। সরকারের অপদার্থতা-দুর্নীতি নিয়ে যে জনবয়ান, তাকে বিভ্রান্ত করে মেকি-বাস্তবতা সৃষ্টিই তাদের আসল মতলব। কিন্তু জনগণের মস্তিষ্ক ওসবকে ধারণই করছে না। শেখ হাসিনার মন্তব্যের চাইতে খালেদা জিয়ার বক্তব্য নিয়েই চারদিকে আলোচনা, এমনকি আওয়ামী ঘরানার টকশোতেও। বেগম জিয়ার কথার সমালোচনাতেও বেরিয়ে আসছে সরকারের দুঃশাসনের প্রতিচ্ছবি।
Posted ০১:৪৮ | বুধবার, ০১ জানুয়ারি ২০১৪
Swadhindesh -স্বাধীনদেশ | admin