| শনিবার, ১৭ মে ২০১৪ | প্রিন্ট
মুহাম্মদ রুহুল আমীন নগরী
মাওলানা শায়খ আশরাফ আলী বিশ্বনাথী (রহ.) এক জন দেশ প্রেমিক, বাতিলের বিরুদ্ধে আপোষহীন সংগ্রামী ব্যক্তিত্ব, ইসলামী আন্দোলনের সিপাহ সালার। প্রখ্যাত আলেমে দ্বীন, বহুগ্রন্থ প্রণেতা ,মাসিক আল ফারুক পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ও জামেয়া ইসলামিয়া দারুল উলূম মাদানিয়া বিশ্বনাথ এর প্রতিষ্ঠাতা মুহতামিম এবং জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি শায়খে বিশ্বনাথী আজ আমাদের মধ্যে নেই। তিনি ২০০৫ সালের ২০ মে ইন্তেকাল করেন। মরহুম মাওলানা শায়খ আশরাফ আলী বিশ্বনাথী রহ. ১৪ই অগ্রহায়ন ১৩৩৩ বাংলা মোতাবেক ১৯২৮ ঈসায়ী সালে বিশ্বনাথ থানার গড়গাঁও গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মরহুম মুন্সি মোহাম্মাদ জাওয়াদ উল্লাহ তালুকদার ও মাতা মহিয়সী মোছা: হাবীবুন্নেছা ওরফে জয়তুন বিবি। তিনি গ্রামেই প্রাথমিক ধর্মীয় শিক্ষা লাভ করেন। ৭ বছর বয়সে বিশ্বনাথ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং কৃতিত্বের সাথে পঞ্চম শ্রেণী উত্তীর্ণ হন। পঞ্চম শ্রেণীতে থাকা অবস্থায় মাত্র ১১ বছর বয়সে তিনি বুকে ব্যাজ ধারণ করে বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। পরবর্তীতে তিনি রানাপিং মাদ্রাসায় সাফেলা ২য় বর্ষ থেকে মিশকাত জামাত পর্যন্ত শিক্ষা নেন। চট্রগ্রাম হাটহাজারী মাদ্রাসায় ভর্তি হয়ে ১৯৪৯ সালে তিনি প্রথম বিভাগে দাওরায়ে হাদীস পাশ করেন।
হাটহাজারী মাদ্রাসার ফারেগীগণদের মধ্যে সেরা ১০০ জন কৃতিত্বের অধিকারীর মধ্যে তাকে ২৭ নাম্বারে স্থান দেয়া হয়েছে। শিক্ষা জীবন শেষ করে ১৯৫০ সালে তিনি গলমুকাপন মাদ্রাসায় শিক্ষকতা জীবন শুরু করেন। এরপর তিনি চক কাসিমপুর মাদ্রাসা, পারকুল মাদ্রাসা ও বিশ্বনাথ এম.ই মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করেন। বিশ্বনাথ এম. ই মাদ্রাসাকে কওমী মাদ্রসায় রূপান্তরিত করলে সরকার সাহায্য বন্ধ করে দেয় ও সরকারী মাদ্রাসায় রূপান্তর করতে চাইলে তার অক্লান্ত পরিশ্রমে মাদ্রাসাটি কাওমী মাদ্রাসা হিসেবে ঠিকে থাকে। ১৯৫৯ সালে প্রতিষ্ঠিত আজকের জামেয়া ইসলামিয়া দারুল উলূম মাদানিয়া বিশ্বনাথ মাদ্রাসায় দাওরায়ে হাদীস খোলা হয় ১৯৮৪ সালে। তিনি উক্ত জামেয়ার আজীবন মুহতামিম ছিলেন। কিশোর বয়সে বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন, ১৯৪৭ সালে রেফারেন্ডামে অংশগ্রহণ সহ ২০০৫ সালের ৯-১০ মার্চ ভারতের টিপাইমুখ বাঁধ নির্মানের প্রতিবাদে জকিগঞ্জ অভিমুখে লংমার্চ নেতৃত্ব দেন ও সমাবেশের সভাপতিত্ব করেন। ২০০৫ ইং সালের ২রা এপ্রিল ঢাকার পল্টন ময়দানে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ এর সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে প্রধান অতিথি ছিলেন ফেদায়ে মিল্লাত হযরত আল্লামা সায়্যিদ আসআদ মাদানী রহ.। সভাপতি ছিলেন শায়খ আশরাফ আলী বিশ্বনাথী রহ.। তিনি পাক আমলে জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের সিলেট জেলার সাধারণ সম্পাদক,পরবর্তীতে কেন্দ্রীয় সহ সভাপতি, নির্বাহী সভাপতি এবং সর্বশেষে ২০০১ সালে আল্লামা আব্দুল করিম শায়খে কেীড়িয়ার ইন্তেকালের পর শায়খে বিশ্বনাথী সভাপতি নির্বাচিত হন। তিনি আমৃত্যু উক্ত দায়ীত্ব পালন করেন। তিনি ছোট বেলায় বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন এবং ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি মজলুম মানবতার পক্ষে আজীবন কাজ করে গেছেন। এসর্ম্পকে গোলাপগঞ্জ মুক্তিযোদ্ধা সংসদের অফিস সম্পাদক জনাব আব্দুল কাদির জানান, ১৯৭১ সালের মে মাসে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী আমাদের গোলাপগঞ্জে আক্রমণ করে, তখন চৌঘরী এলাকায় এক হিন্দু মহিলার ঘর তারা আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ফেলে। খবর শুনে মাওলানা রিয়াসত আলী চৌঘরী রহ. আসেন এবং শায়খে বিশ্বনাথীকে খবর দেন। পরদিন বিশ্বনাথী আসেন। এরপর পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর একান্ডের প্রতিবাদে সমাবেশ ও মিছিল করেন এবং অত্র এলাকা ছেড়ে যাওয়ার জন্য পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীকে আলটিমেটাম দেন। এরপর হিন্দু মহিলার ঘর নির্মাণের জন্য কিছু চাঁদা দেওয়ার জন্য উপস্থিত সকলের প্রতি আহবান জানান। সকলে মিলে যে টাকা উঠে সেই টাকা শায়খে চৌঘরীর হাতে দিয়ে বললেন, হুজুর আপনি এই মহিলাটিকে একটি ঘর নির্মাণের ব্যবস্থা করে দিন। এ সময় মুক্তিযোদ্ধারা উপস্থিত উলামায়ে কেরামের সাথে সাক্ষাৎ এলে শায়খে বিশ্বনাথী তাদের খোজ নেন। এবং দেশ রক্ষার জন্য সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার আহবান জানান। এসময় উপস্থিত ছিলেন মাওলানা রিয়াসত আলী চৌঘরী, শায়খে ফুলবাড়ীসহ অনেক উলামায়ে কেরাম ও বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল কাদির, শহিদ মানিক মিয়া, মুক্তিযোদ্ধা ফলিক মিয়া প্রমুখ। (সূত্র: মাসিক-আল ফারুক শায়খে বিশ্বনাথী সংখ্যা-২০১২)।
ইসলামী রাজনীতি ও সাহিত্য চর্চাকে তিনি দ্বীনের অংশ মনে করতেন। সাহিত্য সাংবাদিকতার ময়দানে আলেম উলামাদের সম্পৃক্ত করতে তাঁর চেষ্টার কমতি ছিলনা। সাপ্তাহিক জমিয়ত ও মাসিক আল ফারুক নিয়মিত প্রকাশের জন্য তিনি বিপুল পরিমান অর্থ ও জীবনের গুরুত্বপুর্ন সময় ব্যয়করেন। মাদ্রাসার ছাত্র ও আলেম উলামাদের লেখালেখির ময়দানে জড়িত করার জন্য তিনি নানা ভাবে উৎসাহ যোগাতেন। পত্র পত্রিকায় যখনই দেশ ও ধর্ম বিরুধী কোন লেখা বা সংবাদ প্রকাশ হতো তিনি সাথে সাথে বক্তব্য-বিবৃতির মাধ্যমে এর জবাব দিতেন। শত ব্যস্ততার মধ্যেও তিনি লেখালেখির কাজে জড়িত ছিলেন। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তাঁর লেখা প্রায় ১৫টি পুস্তক প্রকাশিত হয়েছে। ১৯৯৮ সাল থেকে প্রকাশিত মাসিক আল ফারুক এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলেন।
আধ্যাত্মিক জীবন: শাইখুল ইসলাম আল্লামা হোসাইন আহমদ মাদানী রহ. রমযান মাসে আসামের বাসকান্দিতে আসতেন। শায়খে বিশ্বনাথী বাসকান্দিতে গিয়ে শাইখুল ইসলাম মাদানী রহ. এর হাতে বাইয়াত গ্রহণ করেন। এবং আত্মশুদ্ধির জন্য সচেষ্ট হন। হযরত শাইখুল ইসলাম আল্লামা মাদানী রহ. এর ইন্তেকালের পর শায়খের ইশারা অনুযায়ী হযরত মাওলানা বশির আহমদ শায়খে বাঘা রহ. এর সাথে আধ্যাত্মিক সম্পর্ক কায়েম করেন। তাঁরও ইন্তেকালের পর হযরত শাইখুল ইসলাম- এর প্রিয় খলীফা হযরত আল্লামা হাফেজ আব্দুল করীম শায়খে কৌড়িয়া রহ. এর সাথে আধ্যাত্মিক সম্পর্ক কায়েম করেন এবং তার কাছ থেকে খেলাফত লাভ করেন।
বিশিষ্ট জনের মন্তব্য:
মাওলানা আশরাফ আলী বিশ্বনাথীর মৃত্যুতে হাটহাজারী মাদ্রাসার মহাপরিচালক ও বেফাকুল মাদারিস বাংলাদেশের চেয়ারম্যন,খলিফায়ে মাদানী আল্লামা শাহ আহমদ শফী স্মৃতি চারণ কওে বলেন,দেশে ইসলামী শাসন ব্যবস্থা কায়েম করার জন্য তিনি বহু চেষ্টা চালিয়েছেন। জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম এর মাধ্যমে চল্লিশ বছরের বেশী সময় তিনি সংগ্রম চালিয়েছেন। পবিত্র কুরআন-সুন্নাহ ও সলফে সালিহীনদের আদর্শ সমাজ ব্যবস্থা সর্বস্তরে প্রতিষ্ঠার জন্য তার যথেষ্ট মেহনত ছিলো। হযরত শায়খুল ইসলাম আল্লামা সৈয়দ হুসাইন আহমদ মাদানি (রাহ.) এর খলিফা হযরত আল্লামা হাফিজ আব্দুল করিম শায়খে কৌড়িয়া (রাহ.) এর নেতৃত্বে তিনি সব সময় সক্রিয় ছিলেন।
তাঁর অবদানের কথা আমাদের সব সময় স্মরণ হয়। একজন বিশাল ব্যক্তিত্ব ও মর্দে মুমিন ছিলেন হযরত আল্লামা আশরাফ আলী বিশ্বনাথী সাহেব (রাহ.)। আমরা একই সময়ে হাটহাজারি মাদ্রসায় শিক্ষা লাভ করেছি। তিনি ছিলেন আমাদের সিনিয়র। তিনি সিলেটে মিশকাত, জালালাইন পর্যন্ত অধ্যয়ন করেছিলেন এবং দাওরায়ে হাদিস পড়ার জন্য হাটহাজারিতে ভর্তি হয়েছিলেন। দাওরায়ে হাদীস কৃতিত্বের সাথে সমাপন করেছিলেন। শুনেছি সিলেটে তার শ্রদ্ধেয় উস্তাদ হযরত মাওলানা রিয়াসত আলী সাহেব (রাহ) তাকে দাওরায়ে হাদীস সমাপনের জন্য হাটহাজারী মাদ্রাসায় প্রেরণ করেছিলেন। হযরত মাওলানা রিয়াসত আলী (রাহ) বিশ্ব বিখ্যাত মুহাদ্দিস শায়খুল হাদিস হযরত আল্লামা আনোয়ার শাহ কাশ্মীরী (রাহ) এর বিশিষ্ট শাগরেদ ছিলেন। হাটহাজারী মাদ্রাসায় ছাত্রদের মধ্যে ইসলামী রাজনীতির ক্ষেত্রে আন্দোলনের জন্য যে কয়েক জনের নাম স্মরণীয় হয়ে রয়েছে তাদের মধ্যে আশরাফ আলী বিশ্বনাথী (রহঃ) ছিলেন অন্যতম।
এরহুম মুফতী ফজলুল হক আমিনী বলেন, তার অনেক স্বপ্ন ছিলো। তিনি জানতেন রাজনৈতিক আন্দোলন সফল হতে হলে মিডিয়ায় লোক তৈরী কতো জরুরী। এজন্য তিনি চেষ্টাকরেগেছেন, মাসিক আল ফারুক প্রকাশ করেগেছেন। তার আরেকটি গুণ হলো সাহসিকতা কাউকে পরোয়া করতেন না। খুবই অনমনীয় মানসিকতার মানুষ ছিলেন তিনি। হক অবলম্বনের ইচ্ছার দৃঢ়তার ফলে অনেকের বিরাগভাজন হয়েছেন। কিন্তু যা সঠিক মনে করতেন, তার উপর শক্ত হয়ে অবস্থান করতেন। এক সময় তিনি আপোষহীনতার প্রতিক হয়ে ওঠেন তার দলে। এই রকম একজন পথপ্রদর্শক নেতার গুণ সমূহ চর্চা করা খুবই জরুরী। কারণ আগামী দিন তাদের পথ ধরে নতুন নেতৃত্বকে উঠে আসতে হবে।
Posted ২২:২৪ | শনিবার, ১৭ মে ২০১৪
Swadhindesh -স্বাধীনদেশ | admin