| শুক্রবার, ২৫ এপ্রিল ২০১৪ | প্রিন্ট
বানিয়াচং উপজেলার পূর্ব সীমান্ত কালাইনঞ্জুরা গ্রাম। গ্রামটির পূর্বপার্শ্ব দিয়ে বয়ে গেছে “শাখা বরাক” নদী যা কালের আবর্তে আজ খালে পরিণত হয়েছে। এই গ্রামেই আস্তানা গড়েছিলেন ৩৬০ আউলিয়ার সফর সঙ্গী হযরত ইলিয়াস (রহঃ) এর বংশধর মহান পূরুষ হযরত ‣সয়দ শাহ আলমাছ খন্দকার (রহঃ) ওরফে কাজী খন্দকার।
এই গ্রামেই জন্ম নিয়েছিলেন মুক্তি যুদ্ধের সম্মুখ সমরে শহীদ হাবিবুর রহমান (নানু)। গ্রামের পশ্চিমে আমন ও বোর ধানের মাঠ। দক্ষিনে হলদারপুর গ্রাম এবং উত্তরে শ্যামল ধানের মাঠ ও অন্যান্য পলী গ্রাম। গ্রামটি নবসনা গ্রাম হিসাবে অত্র অঞ্চলে পরিচিত ছিল। এই গ্রামে জন্ম নিয়েছেন মুক্তিযোদ্ধা ও অনেক গুনী জ্ঞানী। মুক্তিযুদ্ধের সময় মরহুম বজলু মেম্বার সাহেবের বাড়ীতে ক্যাম্প করেছিল মুক্তি বাহিনী এবং মুক্তিযোদ্ধাদের খাওয়া থাকা সহ মুক্তিযোদ্ধের সময় মুক্তি বাহিনীকে সহযোগিতা করা ছিল এই গ্রামের প্রতিটি মানুষের অঙ্গীকার। বলতে গেলে স্বাধীনতা যুদ্ধের স্বপক্ষের একটি আদর্শ গ্রাম।
১৯৭১ সাল ২৫ এপ্রিল, বাংলা মাসটি ছিল ক্সবশাখ মাস, মাঠে মাঠে তখন ক্সবশাখী বেরো ধানের মে․ মে․ গন্ধ। গ্রামের কৃষকেরা মাঠ থেকে ধান নিয়ে আসার জন্য ১০/১২ জনের এক একটি দল কাঁধে বেউ (কাঁধে করে ধান নিয়ে আসার জন্য বাঁশ এর ক্সতরী) দেখতে রাইফেলের ন্যায়। তখন সবেমাত্র মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছে। সাবার মাঝেই আতঙ্ক কি যেন হচ্ছে। মাঠ থেকে ধান নিয়ে আসার জন্য উলুবনের মধ্য দিয়ে একপায়া মেঠো পথ। কৃষক দল মাঠে যাচ্ছে কাঁধে বেউ নিয়ে আবার সেই সময়ের জনপ্রিয় শ্লোগান জয়বাংলা ধ্বনি দিচ্ছে। দেখতে এক একটি মুক্তিযোদ্ধা ইউনিটের মত। বিমান দেখে আবার কেউ কেউ মাঠিতে শুয়ে বেউ থাক করে আছে বিমানের দিকে।
তখন আমি খুব ছোট, ঐ দিন আমি এবং আমার কাকাত বোনকে নিয়ে আমাদের পার্শ্ববর্তী পুকুরের হাটুপানিতে দারকিনে মাছ ধরছি। হঠাৎ দেখি তিনটি কাল বিমান ভয়ঙ্কর আওয়াজ করে দক্ষিণ দিক হতে উত্তর দিকে উড়ে গেল। আবার ১মিনিটের ভিতরেই আবার উড়ে এসে পুকুরের উপর তিনটি ঘুরতি দিল এবং কি যেন ক্সতল জাতীয় পদার্থ পানির উপর ভেষে উঠল। আমি এবং আমার কাকাত বোন ভয়ে পানি থেকে উঠে পাশেই আমাদের এক দিদিমাকে গিয়ে জড়িয়ে ধরলাম। উনি বোরোধান রাখার জন্য ছেঁড়াবস্তা পাট দিয়ে সেলাই করছিলেন।
গাছগাছালিতে ভরা কালাইনঞ্জুরা গ্রাম। সবেমাত্র বসন্ত কাল শেষ হয়েছে। গাছের পাতা পড়ে আবার শুকিয়ে ঝোঁপ ঝাঁড় ভরে আছে। দেখলাম ঝোঁপঝাঁড়ে আগুন জ্বলছে, চতুর্দিকে মানুষের আর্তনাদ এবং প্রাণ বাঁচানোর জন্য ছুটাছুটি।
আমার বাবা দে․ড়ে এস আমাকে, আমার কাকাত বোনকে ও আমার দিদিমাকে নিয়ে তাড়াতাড়ি এই স্থান ত্যাগ করেন। যুদ্ধ বিমান ঘুরপাক খাচ্ছে এদিক হতে ঐ দিক, মানুষ যে দিকে পারচ্ছে প্রাণ বাঁচানোর জন্যে যার যার গন্তব্যে ছুটাছুটি করছে।
আমাদের বাড়ীর পাশেই ছিল একটি পুকুর,আমাদের বাড়ীর সবাই পুকুরের হেলেপড়া আমগাছের মূলে ধরে পানির মধ্যে বাঁদুরের মত ঝুলে আছি। হঠাৎ একটি কামানের গোলা গাছের বড় ঢাল ছেদ করে আমাদের পাশেই পড়ল যদিও কেউ হতাহত হয়নি। আমার জেটিমা ভয়ে উনার কোলে থাকা জেঠাত বোনকে নিয়ে কখন যে পানিতে ডুব দিয়ে আছেন কোলে যে উনার ছোট কন্যা শিশু সে দিখে খেয়াল নেই। উনার শ্বাস যখন প্রায় বন্ধ হয়ে যাচ্ছে তখন তিনি পানির নিচ থেকে শিশুটিকে নিয়ে ভাসলেন, ততক্ষনে শিশুটি পানি খেয়ে প্রায় মৃতপ্রায়।
এদিকে বিমান হামলা, মানুষ প্রাণ বাঁচানোর জন্য দিক বিদিক ছুঁটছে তারপর এই বিপদ, অবশ্য পরবর্তীতে শিশুটির পেঠ থেকে পানি বের করে বাঁচানো গিয়েছিল।
কিছুক্ষণ পরই শুনি আমাদের পার্শবর্তী বাড়ীর নগরবাসী শুক্ল‣বদ্যের স্ত্রীর কামানের গুলি লেগেছে তাঁর শিশু কন্যা কামানের গুলিতে মারা গেছে। পাশেই মা বাসন্তী রানী ক্সবদ্য (৩২) গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ে আছেন, গ্রামের একমাত্র ডাক্তার চাঁনমিযা ভদ্রমহিলার ব্যান্ডেজ করছেন (পরবর্তীতে প্যারালাইস্ড অবস্থায় এই ভদ্র মহিলা কয়েক বছর অত্যন্ত কষ্টের সাথে জীবন সংগ্রাম করে তিনি মৃত্যু বরণ করেন)।
আমাদের একটি ছাগল কামানের গুলায় পা হাড়িয়ে গাছের নিছে পড়ে আর্তনাদ করছে। প্রাণ হারিয়েছে আরও অনেক গবাদি পশু, আমি এবং আমার কাকাত বোন যেখানে আমার দিদিমাকে ধরে ছিলাম পরবর্তীতে দেখলাম এই জায়গায় প্রায় ৫হাত গর্ত হয়েছে। ভাগ্যμমে ঐ দিন আমরা বেঁচে গিয়েছিলাম। যুদ্ধ বিমান কালাইনঞ্জুরা গ্রামে বৃষ্টির মত গুলি ছুঁড়েছে।
বিমান হামলার পর কাঁদা মাটি থেকে গ্রামের অনেকেই এবং আমরা বিষ্ফোরিত এবং অবিষ্ফোরিত অনেক গুলি কুড়িয়ে ছিলাম। গুলির ওজন ছিল দেড় থেকে দুই ছটাক। এ গুলি আজ আর নেই, থাকলে হয়ত মুক্তিযুদ্ধের যাদুঘরে রাখা যেত। বিমান হামলার পর প্রতিটি বাড়ীতে মাটির নীচে গর্ত করে ভাঙ্কার গড়েতোলা হয়েছিল। বিমানের আওয়াজ পেলেই সবাই এই ভাঙ্কারের ভিতর চলে যেত। সেইদিন ১৫-২০ মিনিটের এই বিমান হামলায় লন্ড বন্ড করে দিয়েছিল কালাইনঞ্জুরা এবং হলদারপুর গ্রাম।
আমাদের পার্শ্ববর্তী গ্রাম খ্গাাউড়া,এই গ্রামেই জন্মগ্রহণ করেন মু্িক্তযুদ্ধের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড জনাব এম, এ, রব। মু্িক্তযোদ্ধের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড এম, এ, রব সাহেবের গ্রাম ধারণা করেই হয়ত পাকহানাদার বাহিনী সেইদিন কালাইনঞ্জুরা এবং হলদারপুর গ্রামে নির্বিচারে কামানের গোলা এবং গ্রেনেড ছুঁড়ে ছিল।
এই দিন বিমান হতে ছুড়া কামান এবং গ্রেনেড হামলায় যারা মৃত্যুবরণ করেন, তারা হলেন, কালাইনঞ্জুরা গ্রামের গে․রী রানী শুক্লবেদ্য (১), বাসন্তী ক্সবদ্য (৩২), হলদারপুর গ্রামের মকবুলুনেড়বছা (৩৫), আমিনা খাতন(১২), সোনার মা (৩২), আঙ্গুরা খাতুন (৮), ক্সতয়বচান বিবি(৭০), লাল বিবি(৬০), এবং হলদারপুর গ্রামে নবীগঞ্জ থেকে আসা আমিনা বিবি (৫২), কমলা বিবি, এবং মাঠে থাকা ১২ জন ক্ষেত মজুর, আহত হয়েছিলেন, হলদারপুর গ্রামের ফরিদা খাতুন, মমতাজ বেগম, শারবান বিবি(প্রয়াত) রেজিয়া খাতুন, এখলাছ বিবি, খোদেজা বিবি, আমিনা খাতুন (প্রয়াত) লতিফা খাতুন (প্রয়াত)। ফরিদা খাতুন এক পা হারিয়ে এখন ও বেছে আছেন তখন তার বযস ছিল ৯ বছর, কামানের গুলায় পা হারানোর ফলে তার আর বিয়ে হয়নি।
অভাব অনটনে দিন কাটাচ্ছেন। শুনেছি বঙ্গবন্ধুর স্বাক্ষরকৃত ১টি অভিনন্দনপত্র ও একহাজার টাকা স্বাধীনতা উত্তর সরকারের কাছ থেকে একহাজার টাকা। সম্প্রতি মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে পাঁচ হাজার টাকার চেক গ্রহণ করেছেন (সাপ্তাহিক আলো ২১/০৩/০৬ সালে প্রকাশিত এবং স্বদেশ বার্তা পত্রিকার মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে)।
স্বাধীনতার পর বিমান হামলা নিয়ে পত্রপত্রিকায় অনেক লিখা হয়েছে কিন্ত কালাইঞ্জুরা গ্রামের নাম কখন ও উঠে আসেনি এবং আহত এবং নিহত কেউই সরকারের পক্ষ হতে কোন সাহায্য পেয়েছে বলে আমার জানা নেই।
সুপ্রিয় পাঠক, আমি মূলত লেখক না। সেই দিনের লালিত স্মৃতি আপনাদের মাঝে তুলেধরলাম। আশাকরি ভুলত্র“টি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।
সিন্ধু মনি চন্দ
চাকুরীজিিব
এলজিইডি,বাহুবল
Posted ১১:০৭ | শুক্রবার, ২৫ এপ্রিল ২০১৪
Swadhindesh -স্বাধীনদেশ | admin