শুক্রবার ৩রা মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ২০শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

অশেষ গল্পের মতো অশেষ সন্ত্রাস ফল কী হবে?

  |   বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর ২০১৩ | প্রিন্ট

অশেষ গল্পের মতো অশেষ সন্ত্রাস ফল কী হবে?

আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী

70_pht

রূপকথার সেই অশেষ গল্পের কাহিনী আপনারা সবাই জানেন। রাজার শখ হয়েছিল তিনি এমন গল্প শুনবেন, যার শেষ নেই। এমন গল্প যে তরুণী তাঁকে শোনাতে পারবে, তিনি তাকেই বিয়ে করে রানি করবেন। রাজাকে গল্প শোনাতে এসে বহু দেশের তরুণীরা হার মেনে চলে গেল। গল্পের শেষ নেই- এমন গল্প আবার আছে নাকি? রাজার কাছে দেশ-বিদেশের বহু তরুণীকে নাকাল হতে দেখে তাঁর মন্ত্রীকন্যা শেষ পর্যন্ত রাজাকে জব্দ করতে এগিয়ে এলেন।
তিনি গল্প শুরু করলেন এভাবে- এক দেশের রাজার ছিল একটি শস্য গোলা। হঠাৎ একদিন সেই শস্য গোলার ছাদে ফুটো দেখা দিল। গোলাভর্তি চাল। একটি চড়ুই এসে ছাদের সেই ফুটো দিয়ে গোলায় ঢুকে একটি শস্যকণা ঠোঁটে নিয়ে উড়ে গেল। তারপর এলো আরেকটি চড়ুই। সেটি চলে গেল, আবার একটি চড়ুই এলো। তারপর আরেকটি চড়ুই। সেও আরেকটি শস্যকণা ঠোঁটে নিয়ে উড়ে গেল। রাজা অসহিষ্ণু হয়ে বললেন, তারপর? মন্ত্রীকন্যা বললেন, আরেকটি চড়ুই এলো। রাজা বললেন, আহা, তারপর? মন্ত্রীকন্যা বললেন, আরো একটি এলো। শস্যকণা নিয়ে চলে গেল। রাজা যতবার জিজ্ঞাসা করেন তারপর? মন্ত্রীকন্যা ততবার বলেন, আরো একটি চড়ুই এলো। দেশে চড়ুই পাখির অভাব নেই। এ গল্পেরও শেষ নেই।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখন এই অশেষ গল্পের মতো অশেষ সন্ত্রাস শুরু হয়েছে। বিএনপি-জামায়াতের হালের রাজনীতি হচ্ছে, সরকারকে তাদের দাবির কাছে নতিস্বীকার করানোর জন্য ‘কঠোর কর্মসূচি’ দেবে। কিছু হলেই তারা কঠোর কর্মসূচির নামে হরতাল ঘোষণা করে। হরতাল মানে সন্ত্রাস। একটি হরতাল শেষ হলে তারা বলে, আরো কঠোর কর্মসূচি দেব। আবার হরতাল ও সন্ত্রাস। সেটি শেষ হলে বলে, আরো কঠোর কর্মসূচি দেব। চলে ভাঙচুর, সন্ত্রাস, শিশুমৃত্যু, নিরীহ পথিকের মৃত্যু। অশেষ গল্পের মতো এই অশেষ হরতালেরও শেষ নেই। গল্পের রাজার মতো কেউ যদি বিএনপিকে জিজ্ঞাসা করে, তারপর কী? জবাব, আবার আরেকটি হরতাল।
এটা যদি গান্ধী বা মুজিব যুগের হরতাল হতো, তাহলে ক্ষতি ছিল না। সে যুগের হরতালে পাবলিক প্রোপার্টি, জনগণের জানমালের এত ক্ষতি হতো না। ওই হরতালে জনগণের সমর্থন ও অংশগ্রহণ থাকত বলে সাধারণ মানুষের ওপর হামলা এড়িয়ে চলা হতো এবং সেই হরতাল ছিল গণ-আন্দোলনের অংশ। হরতালের একটা সময়সীমা ছিল এবং হরতাল ডেকে তার আগের দিনই জনজীবনে অবৈধ ও বর্বর হামলা চালানো হতো না। গাড়ি-বাড়ি পোড়ানো হতো না। বিএনপি ও জামায়াত-মার্কা বর্তমানের যে হরতাল, তা হচ্ছে সন্ত্রাস, জনজীবনে অবৈধ হামলা ও বর্বরতা।
স্বাভাবিক ও সংগত রাজনৈতিক আন্দোলনে গণতান্ত্রিক দল বা দলগুলো জনগণকে সঙ্গে নিয়ে হরতাল ডাকে। তাতে ধ্বংসাত্মক ও হিংসাত্মক দিক কম থাকে। হরতালের পরবর্তী পর্যায় বিশাল গণসমাবেশ, অবরোধ ও অসহযোগ। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে বঙ্গবন্ধু যা করেছিলেন। বর্তমান বাংলাদেশে বিএনপি মুখে অবরোধ ও অসহযোগ আন্দোলনের কথা বলে, কিন্তু এগুলো করার জনসমর্থন ও সাংগঠনিক ক্ষমতা- কোনোটাই তার নেই।
বিএনপির সভায় বিশাল জনসমাবেশ হয়। কিন্তু তারা ‘দেশনেত্রী’র অঙ্গুলি হেলনে রাজপথে আন্দোলনে নামে না। তাদের ডাকা অবরোধ প্রহসনে পরিণত হয়। এ বছর ৫ মে নিজেদের শক্তিতে নয়, হেফাজতিদের ওপর নির্ভর করে ঢাকায় শাপলা চত্বরে যে অবরোধ সৃষ্টির ডাক দেওয়া হয়েছিল, তা কেমন করে প্রহসনে পরিণত হয়েছিল, তা দেশবাসী দেখেছে। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ যে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়েছিল, তাতে দেশের শুধু সর্বস্তরের মানুষ নয়, সচিবালয়ের সরকারি কর্মচারী ও কর্মকর্তারাও সাড়া দিয়েছিলেন। আর এখন বিএনপি ও জামায়াত অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিলে বিএনপি-সমর্থকদের ঘরের বউও কি চুলোয় আগুন নিভিয়ে ফেলবেন?
বিএনপি নেত্রী এই অসহযোগ আন্দোলন দ্বারা বহুবার বৈধ-অবৈধ উপায়ে বর্তমান সরকারের পতন ঘটানোর চেষ্টা করেছেন। তাতে গাছের একটি পাতাও নড়েনি। সরকারকে দেওয়া তাঁর ৪৮ ঘণ্টার আলটিমেটাম ৪৮ দিনেও সাফল্যের মুখ দেখেনি। তিনি সরকারের সঙ্গে অসহযোগিতার জন্য সেনাবাহিনীকে উসকেছেন। সরকারি কর্মচারীদের সরকারের হুকুম না মানার নির্দেশ দিয়েছেন। শেখ হাসিনাসহ তাঁর মন্ত্রিদের দেশত্যাগ করে পলায়নের জন্য সময়সীমা বেঁধে দিয়েছেন। তা লোক হাসিয়েছে। কোনো কাজ দেয়নি।
গত পাঁচ বছরেও এটাই বারবার প্রমাণিত হয়েছে, গণ-আন্দোলন করার ক্ষমতা বিএনপি বা জামায়াত- কারো নেই। সেই গণ-আন্দোলন দ্বারা তারা সরকারকে ক্ষমতা থেকে হটাবে, সেই সাংগঠনিক ক্ষমতা ও দক্ষতাও তাদের নেই। জামায়াতও সেই পাকিস্তানি আমল থেকে মাসমুভমেন্ট বা গণ-আন্দোলন করার কোনো ট্রেনিং নেয়নি। সেই অভিজ্ঞতাও তার নেই। তাদের ট্রেনিং গুপ্তহত্যা, অগ্নিসংযোগ, শিরা কাটা, রগ কাটা, গণহত্যায় অংশগ্রহণ ইত্যাদি সন্ত্রাসমূলক কাজে। তারা গণসমর্থন আদায় করতে জানে না। জনগণকে ভয় দেখাতে জানে।
বিএনপি বর্তমানে জামায়াতের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে দেশে আন্দোলনের নামে এই সন্ত্রাস ও বিভীষিকা সৃষ্টির কাজে রত হয়েছে। তাদের সাম্প্রতিক রাজনীতির ইতিহাস হচ্ছে কখনো স্বল্পমেয়াদি কখনো দীর্ঘমেয়াদি সন্ত্রাস সৃষ্টির ইতিহাস। কিন্তু সন্ত্রাস সৃষ্টির দ্বারা যে কখনোই রাজনৈতিক সাফল্য অর্জন করা যায় না, বিশ্ব ইতিহাসের পাতায় তার অসংখ্য উদাহরণ থাকা সত্ত্বেও বিএনপির নেতা-নেত্রীরা তা থেকে কোনো শিক্ষা নিচ্ছেন না।
সম্প্রতি বিএনপি তিন দিনের হরতাল দিয়েছিল। দেশের বুক থেকে তার ধ্বংস ও রক্তপাতের চিহ্ন না মুছতেই আবার চার দিনের হরতাল দিয়েছে। আজ (১২ নভেম্বর, মঙ্গলবার) বিএনপির ডাকা হরতালের তৃতীয় দিন। এই ধরনের নামকাওয়াস্তে হরতাল বিএনপি কেন, বিকল্পধারা বা গণফোরামের মতো সাইনবোর্ডসর্বস্ব দলও ডাক দিলে অনুষ্ঠিত হবে। সাধারণ নাগরিকদের অনেকে ভয়ে রাস্তায় বেরোবে না এবং গাড়ি-ঘোড়া বের করবে না। যারা বের করবে তাদের ওপর হামলা হবে, গাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হবে।
গত তিন দিন ঢাকাসহ দেশের কোনো কোনো স্থানে এই কাণ্ডই করা হয়েছে। অতীতে বিএনপি-জামায়াত এই কাণ্ড করেছে, ভবিষ্যতেও হরতাল ডাকলে তা করবে। এ ব্যাপারে তাদের অবৈধ ও আপত্তিকর ভূমিকা হচ্ছে, সরকারের সঙ্গে শক্তি পরীক্ষায় তারা পেয়ে উঠবে না- এটা জেনে যেদিন থেকে হরতাল ডাকা হয় তার আগের দিন অপ্রস্তুত নাগরিকদের ওপর অবৈধ হামলা চালায়, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। তাতে নিরীহ মানুষের মৃত্যুও হয়। এ জন্য হিংস্রতা কোনো রাজনৈতিক আন্দোলনের অংশ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে না।
এবারের হরতালেও বিএনপির দাবি আদায় হবে না। সরকারের পতন ঘটবে না- এ কথা পাঁজিপুঁথি না ঘেঁটেও বলা চলে। অন্যদিকে সরকার তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী সর্বদলীয় অন্তর্বর্তীকালীন মন্ত্রিসভা গঠনের কাজে এগিয়ে যাচ্ছে। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রার্থীরা তো ইতিমধ্যেই মনোনয়ন লাভের আবেদনপত্র কেনার জন্য বিপুল সংখ্যায় দলের অফিসের সামনে লাইন দিয়েছেন। নির্বাচন কমিশন নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি নিচ্ছে।
এ অবস্থায় বিএনপি ও তার সঙ্গের জোটবদ্ধ অধিকাংশ সাইনবোর্ডসর্বস্ব দল কী করবে? ১৩ নভেম্বর বুধবার চলতি হরতাল শেষ হলে তারা আরো কঠোর কর্মসূচির নামে আবার হরতাল ও সন্ত্রাস সৃষ্টির ডাক দেবে এবং তারপর আবার হরতালের ডাক দেবে? চড়ুই পাখির গল্পের এই অশেষ ধারাবাহিকতা চলতে থাকবে কি? তাতে সাধারণ মানুষের জানমালের গুরুতর ক্ষতি, দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনীতির সর্বনাশ করা ছাড়া সরকারকে নতিস্বীকার করানো বা তার পতন ঘটানো যাবে কি?
বিএনপি কি আশা করে, তারা দেশে এই অশেষ সন্ত্রাস চালাতে থাকলে তৃতীয় শক্তির আবির্ভাব ঘটবে এবং তারা আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে অপসারণ করবে? যদি করে, তাতেই কি বিএনপি-জামায়াতের তৃপ্তি? এ ব্যাপারেও বিএনপি বোকার স্বর্গে বাস করছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে বর্তমান বিশ্বপরিস্থিতির কারণেই বাংলাদেশে তৃতীয় শক্তির ক্ষমতা দখলের আশঙ্কা দেখি না। বাংলাদেশ নিয়ে ভারত ও আমেরিকার মধ্যে মনোমালিন্যের খবর যাঁরা প্রচার করছেন, খবর-ভাষ্য লিখছেন, তাঁদের উৎসাহের আধিক্য দেখেও এই আশঙ্কার কথা ভাবছি না। আমাদের এলিট ক্লাসের চ্যাটরিং ক্লাব তাহলে এ সংকট মুহূর্তে এত নীরব কেন?
তর্কের খাতিরে যদি ধরে নিই, কোনো ধরনের তৃতীয় শক্তির আগমন ঘটবে; তারা কি বিএনপি-জামায়াতের প্রতি পক্ষপাতিত্ব দেখাবে, না এক-এগারোর মতো ভূমিকা নেবে? যদি সেই ভূমিকা নেয়, তাহলে শুধু শেখ হাসিনার ভাগ্যে নয়, খালেদা জিয়ার ভাগ্যেও কী ঘটবে তা কি তিনি বুঝতে পারছেন না? তাঁর জন্য আবার সাবজেল তৈরি না হলেও স্থায়ীভাবে তাঁর সৌদি-যাত্রা এবার ঠেকাবে কে?
বিএনপির উচিত, হাসিনা সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত পাঁচটি সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে বিশাল জয়লাভের পর প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক ঘোষিত সর্বদলীয় সরকারের প্রস্তাব মেনে নিয়ে ওই সরকারে ও নির্বাচনে অংশ নেওয়া। তাতেই বরং তার নির্বাচনে জেতা ও ক্ষমতায় যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। সিটি করপোরেশনগুলোর নির্বাচনে হাসিনা সরকার যেমন কোনো কারচুপির আশ্রয় নেয়নি, তেমনি আগামী সাধারণ নির্বাচনেও তা নেবে না বলে দৃঢ় আশা পোষণ করা যায়। তাহলে মিথ্যাবাদী রাখাল বালকের মতো তারা আগেই বাঘ আসছে-বাঘ আসছে (নির্বাচনে কারসাজি হবে) বলে চিৎকার জুড়েছে কেন? অতীতে নিজেরা যা করেছে, সেটাই তাদের মনে সন্দেহের মেঘ সৃষ্টি করছে কি? এখনো সময় আছে, বিএনপি সন্ত্রাস ও জামায়াতের সংশ্রব ছেড়ে গণতান্ত্রিক পথেই ক্ষমতায় যাওয়ার চেষ্টা সফল করতে পারে।

Facebook Comments Box
advertisement

Posted ১৪:৪৭ | বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর ২০১৩

Swadhindesh -স্বাধীনদেশ |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

advertisement
advertisement
advertisement
Advisory Editor
Professor Abdul Quadir Saleh
Editor
Advocate Md Obaydul Kabir
যোগাযোগ

Bangladesh : Moghbazar, Ramna, Dhaka -1217

ফোন : Europe Office: 560 Coventry Road, Small Heath, Birmingham, B10 0UN,

E-mail: news@swadhindesh.com, swadhindesh24@gmail.com