বৃহস্পতিবার ৯ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ২৬শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

শাহবাজ শরিফ পাকিস্তানের ২৪তম প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত

নিজস্ব প্রতিবেদক   |   রবিবার, ০৩ মার্চ ২০২৪ | প্রিন্ট

শাহবাজ শরিফ পাকিস্তানের ২৪তম প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত

স্বাধীনদেশ অনলাইন : শাহবাজ শরিফ পাকিস্তানের ২৪তম প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছেন। এই নিয়ে দ্বিতীয় দফায় তিনি সে দেশের প্রধানমন্ত্রী হলেন। এর আগে ২০২২ সালে তিনি প্রথমবারের মতো প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছিলেন। তখন তার প্রধানমন্ত্রিত্বের মেয়াদ ছিল মাত্র ১৬ মাসের মতো। ২০২৩ সালের অগাস্টে তার সরকারের মেয়াদ পূর্ণ হয়ে যায়।

রোববার পাকিস্তানের পার্লামেন্টে প্রধানমন্ত্রী পদের জন্য ভোটাভুটি হয়। সেখানে ২০১ ভোট পেয়ে বিজয়ী হন শাহবাজ শরিফ। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী তেহরিকে ইনসাফ সমর্থিত প্রার্থী উমর আইয়ুব পান ৯২টি ভোট। নির্বাচিত হওয়ার পর শাহবাজ শরিফ যখন পার্লামেন্টে ভাষণ দিতে শুরু করেন, তখন বিরোধীদের তীব্র স্লোগানের মুখে পড়েন।

শুরুতে সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে তিনি বলেন, ‘সব নৃশংসতার পরও নওয়াজ শরিফ, আসিফ জারদারি এবং বিলাওয়াল ভুট্টো কখনোই পাকিস্তানের ক্ষতি করার কথা ভাবেননি।‘ বিরোধীদের হট্টগোলের মধ্যেও শাহবাজ শরিফ তার ভাষণ চালিয়ে যান। এ সময় তিনি পাকিস্তানের বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বৃদ্ধির বিষয়ে এবং জনগণের ওপর থেকে করের চাপ কমানোর বিষয়ে কথা বলেন।

সভায় ভোটাভুটির সময় শাহবাজ শরিফ যখন প্রধানমন্ত্রী পদের প্রার্থী হিসেবে হাজির হয়েছিলেন, তখন তার বড় ভাই নওয়াজ শরিফও পার্লামেন্টে উপস্থিত ছিলেন। এমন দৃশ্য তার দল পাকিস্তান মুসলিম লীগ নওয়াজের (পিএমএল-এন) ইতিহাসে প্রথমবারের মতো দেখা গেল।

১৯৯৭ সালের পর যখনই নওয়াজ শরিফের দল ক্ষমতায় এসেছে, এমন কখনও হয়নি যে নওয়াজ শরিফ দেশে ছিলেন, নির্বাচনে জিতেছেন কিন্তু তারপরও প্রধানমন্ত্রী হননি। তিনি প্রতিবারই প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন এবং শাহবাজ শরিফ পাঞ্জাব প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন।

পাঞ্জাবে শাহবাজ শরিফ প্রায় ১৩ বছর মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। ২০০৮ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত দশ বছরের শাসনামলে, তিনি একজন ‘কঠোর প্রশাসক’ হিসাবে পরিচিতি পান। এছাড়া ১৬ থেকে ১৭ মাসের মতো প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে তিনি তার দেশকে দেউলিয়া হওয়া থেকে বাঁচিয়েছেন বলেও দাবি করেন।

শাহবাজ শরিফ দাবি করেছিলেন তিনি যে পরিস্থিতিতে দেশের অর্থনীতি পেয়েছিলেন, নিজের স্বল্প মেয়াদে সেটাকে যতোটা সম্ভব মেরামত করেছেন। মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালে স্বল্প সময়ে উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন করে তিনি যেমন সুনাম অর্জন করেছিলেন তেমনি অরেঞ্জ লাইনের মতো বেশ কয়েকটি প্রকল্পের জন্য তিনি সমালোচনারও মুখোমুখি হন।

শাহবাজ শরিফ কীভাবে প্রাদেশিক ক্ষমতা থেকে দেশের শাসন ক্ষমতা পেলেন এবং নওয়াজ শরিফের উপস্থিতিতে দ্বিতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারে পৌঁছলেন, তার সেই রাজনৈতিক যাত্রাটাই এক নজরে দেখে নেয়া যাক।

ব্যবসায়ী থেকে রাজনীতিবিদ

সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের ছোট ভাই শাহবাজ শরিফ তার পড়াশোনা শেষ করে প্রথমে পারিবারিক ব্যবসার হাল ধরেন।পাকিস্তানের সাংবাদিক সালমান ঘানি দীর্ঘদিন ধরে শরিফ পরিবার ও তাদের দলের কর্মকাণ্ড নিয়ে প্রতিবেদন করে আসছেন।বিবিসির সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, শাহবাজ শরিফ ১৯৮৫ সালে লাহোর চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি হন।

‘সে সময়, আমার মনে আছে যে তার একটি শেরাড গাড়ি ছিল এবং তিনি নিজেই তার দলের কর্মীদের কাছে মালপত্র বহন করে নিয়ে যেতেন।‘ সালমান ঘানির মতে, নওয়াজ শরিফ এবং তার দলের রাজনীতির প্রচারে কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করেছেন শাহবাজ শরিফ।

ঘানি বলেছিলেন, ‘তিনি খুব পরিশ্রমী। এমনকি পরিবারেও শুরু থেকেই তাকে নিয়ে সবার একটাই ধারণা ছিল যে তিনি ভীষণ পরিশ্রমী এবং খুব ভালো প্রশাসক।’ ব্যবসা সম্প্রসারণের পরে তিনি পাকিস্তানের রাজনীতিতে প্রবেশের সিদ্ধান্ত নেন এবং শাহবাজ শরিফ প্রথমবারের মতো ১৯৮৮ সালের নির্বাচনে পাঞ্জাব অ্যাসেম্বলির সদস্য হন। ১৯৯০ সালে, তিনি পার্লামেন্টের সদস্য এবং ১৯৯৩ সালে আবার পাঞ্জাব পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। একই বছর তিনি প্রাদেশিক পরিষদের বিরোধী দলীয় নেতাও হন।

পারভেজ মোশাররফ তাকে নিয়ে যা বলেছিলেন

১৯৯৭ সালের নির্বাচনে পিএমএল-এন জয়লাভ করলে শাহবাজ শরিফ প্রথমবারের মতো পাঞ্জাব প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত হন। পাকিস্তানের সাংবাদিক ও প্রবীণ বিশ্লেষক মুজিবুর রহমান শামি সাম্প্রতিক রাজনীতির ওপর নজর রাখেন। বিবিসির সাথে কথা বলার সময় মুজিবুর রহমান শামি বলেন যে শাহবাজ শরিফ স্বভাবগতভাবেই একজন পরিশ্রমী ব্যক্তি ছিলেন এবং তিনি তার লক্ষ্য অর্জনে মগ্ন থাকতেন। তার কথায়, ‘একজন ভালো প্রশাসক হওয়ায় তিনি পাঞ্জাবে একটি ভালো দল গড়তে পেরেছিলেন।‘

শাহবাজ শরিফ পাঞ্জাব প্রদেশে বেশ কয়েকটি প্রকল্প শুরু করেছিলেন। কিন্তু তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল পারভেজ মোশাররফ ১৯৯৯ সালে সামরিক আইন জারি করলে পিএমএল-এন সরকার অকালে ক্ষমতাচ্যুত হয়। শাহবাজ শরিফের সাথে সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফকেও গ্রেফতার করা হয়। সাংবাদিক মুজিবুর রহমান শামি বলেছেন, সে সময় পরিস্থিতি যাই হোক, শেহবাজ শরিফের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগই প্রমাণিত হয়নি।

শামি বলছিলেন, ‘তিনি মৌলিকভাবে সংঘর্ষে বিশ্বাসী ছিলেন না। তিনি সব সময় একটি কথাই বলে এসেছেন যে, সামরিক সংস্থাসহ সবাইকে সাথে নিয়ে একযোগে কাজ করা উচিত।’ মুজিবুর রহমান শামি আরো জানান, একটি অনুষ্ঠানে খোদ পারভেজ মোশাররফও বলেছিলেন যে ‘তিনি (শাহবাজ শরিফ) প্রধানমন্ত্রী হলে ভালো হতো।‘ তবে সে সময় শরিফ পরিবারের দুই ভাইয়ের বিরুদ্ধে বিমান ছিনতাই এবং রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা হয়েছিল।

মোশাররফের সাথে চুক্তি ও নির্বাসন

২০০০ সালে সামরিক স্বৈরশাসক জেনারেল পারভেজ মোশাররফের সাথে শরিফ পরিবারের একটি কথিত চুক্তি হয়েছিল, যার পরে শাহবাজ শরিফ নির্বাসনে যান এবং সৌদি আরবে চলে যান। সাংবাদিক মুজিবুর রহমান শামির মতে, তারপরও নওয়াজ শরিফ ও অন্যান্য নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হলেও শাহবাজ শরিফের বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি।

শাহবাজ শরিফ দেশ থেকে নির্বাসিত হতে চাননি এবং তিনি খুব আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন যাতে তাকে বিতাড়িত করা না হয়।সাংবাদিক ও বিশ্লেষক সালমান ঘানি বলেছেন, শাহবাজ শরিফ জেলের ভেতর থেকেও তার বড় ভাই নওয়াজ শরিফকে বেশ কিছু চিঠি লিখেছিলেন।

এসব চিঠিতে তিনি নওয়াজ শরিফকে উপদেশ দিয়েছিলেন যে, সেনাবাহিনীর সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ জড়ানো উচিত হবে না।সালমান ঘানি বলেছেন, শাহবাজ শরিফের এরকম কয়েকটি চিঠি তার চোখে পড়েছে। এরপর পাঞ্জাবের সাবেক গভর্নর চৌধুরী সারওয়ারের প্রচেষ্টায় নওয়াজ শরিফ ও শাহবাজ শরিফ সৌদি আরব থেকে লন্ডনে চলে আসেন।

মুখ্যমন্ত্রীর আসন নিয়ে কাড়াকাড়ি

শরিফ পরিবার ২০০৭ সালে পাকিস্তানে ফিরে আসে এবং পরের বছর দেশে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ওই নির্বাচনে অংশ নিতে পারেননি শাহবাজ শরিফ। কারণ ১৯৯৮ সালে লাহোরের সবজাজার এলাকায় বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় তার বিরুদ্ধে একটি এফআইআর নথিভুক্ত করা হয়েছিল।

সেই এফআইআরে তিনি মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে ‘পুলিশ এনকাউন্টারের’ নির্দেশ দিয়েছিলেন বলে অভিযোগ করা হয়েছিল, যে কথিত এনকাউন্টারে বেশ কয়েকজন নিহত হয়েছিল।

২০০৩ সালে শাহবাজ শরিফের অনুপস্থিতিতে সন্ত্রাসবিরোধী আদালত তার বিরুদ্ধে নোটিশ জারি করে।

পরের বছর ২০০৪ সালে, শাহবাজ শরিফ এই মামলায় আদালতে হাজির হওয়ার জন্য পাকিস্তানে ফিরে আসার চেষ্টা করলেও তাকে বিমানবন্দর থেকেই ফেরত পাঠানো হয়। একই বছর আদালতে হাজির না হওয়ায় আদালত তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে।

২০০৭ সালে শাহবাজ শরিফ পাকিস্তানে ফিরে এলে ওই মামলায় তাকে আদালত থেকে জামিন নিতে হয়, তবে সাধারণ নির্বাচন পর্যন্ত তিনি মামলাটি থেকে খালাস পাননি।

তাই তিনি দেশটির উপনির্বাচনে অংশ নেন। তিনি আবারও পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত হন, কিন্তু পরের বছরই সুপ্রিম কোর্ট তাকে অযোগ্য ঘোষণা করেন। এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বৃহত্তর বেঞ্চে আবেদন করেন শাহবাজ শরিফ। দুই মাস পরে রায় তার পক্ষে হয় এবং তিনি মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ার পুনরুদ্ধার করেন।

মুখ্যমন্ত্রীর আসন নিয়ে কাড়াকাড়ি

শরিফ পরিবার ২০০৭ সালে পাকিস্তানে ফিরে আসে এবং পরের বছর দেশে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ওই নির্বাচনে অংশ নিতে পারেননি শাহবাজ শরিফ। কারণ ১৯৯৮ সালে লাহোরের সবজাজার এলাকায় বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় তার বিরুদ্ধে একটি এফআইআর নথিভুক্ত করা হয়েছিল। সেই এফআইআরে তিনি মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে ‘পুলিশ এনকাউন্টারের’ নির্দেশ দিয়েছিলেন বলে অভিযোগ করা হয়েছিল, যে কথিত এনকাউন্টারে বেশ কয়েকজন নিহত হয়েছিল।

২০০৩ সালে শাহবাজ শরিফের অনুপস্থিতিতে সন্ত্রাসবিরোধী আদালত তার বিরুদ্ধে নোটিশ জারি করে। পরের বছর ২০০৪ সালে, শাহবাজ শরিফ এই মামলায় আদালতে হাজির হওয়ার জন্য পাকিস্তানে ফিরে আসার চেষ্টা করলেও তাকে বিমানবন্দর থেকেই ফেরত পাঠানো হয়।

একই বছর আদালতে হাজির না হওয়ায় আদালত তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে। ২০০৭ সালে শাহবাজ শরিফ পাকিস্তানে ফিরে এলে ওই মামলায় তাকে আদালত থেকে জামিন নিতে হয়, তবে সাধারণ নির্বাচন পর্যন্ত তিনি মামলাটি থেকে খালাস পাননি।

তাই তিনি দেশটির উপনির্বাচনে অংশ নেন। তিনি আবারও পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত হন, কিন্তু পরের বছরই সুপ্রিম কোর্ট তাকে অযোগ্য ঘোষণা করেন। এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বৃহত্তর বেঞ্চে আবেদন করেন শাহবাজ শরিফ। দুই মাস পরে রায় তার পক্ষে হয় এবং তিনি মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ার পুনরুদ্ধার করেন।

‘চীনারা তাদের পছন্দ করে’

২০১৩ সালের নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর, শাহবাজ শরিফ টানা দ্বিতীয়বার এবং মোট তৃতীয়বারের মতো পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত হন। এই দশ বছরে তিনি একজন ‘কঠোর প্রশাসক’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। সাংবাদিক সালমান ঘানি বিবিসিকে বলেছেন যে তার মনে আছে যে সেসময় লাহোরে ডেঙ্গুর বিরুদ্ধে অভিযান চলছিল, তিনি সকাল ছয়টায় ডাক্তার এবং অন্যান্য দলকে ডাকতেন। কারো দেরি করা বা অনুপস্থিত থাকার কোনও অবকাশ ছিল না।

সাংবাদিক মুজিবুর রহমান শামির মতে, শাহবাজ শরিফ প্রথম পাঁচ বছরে নিজের জন্য একটি লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিলেন যে তাকে দেশের বিদ্যুতের ঘাটতি মেটাতে হবে। তারপরে তিনি চীনের সহযোগিতায় বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের কাজ শুরু করেন এবং খুব কম সময়ে কাজ সম্পন্ন করার রেকর্ড গড়েছিলেন।

‘এই সময়ে, ‘পাঞ্জাব স্পিড’ শব্দটিও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে‘, বলছিলেন মুজিবুর রহমান শামি। তার মতে, ‘বিশেষ করে চীনারা তাকে নিয়ে খুব খুশি ছিল কারণ তিনি সময়ের আগে প্রকল্পের কাজ শেষ করতেন।‘

সাংবাদিক সালমান ঘানি আবার বলেছেন, শাহবাজ শরিফ চীনাদের কাজের পদ্ধতিতে খুব মুগ্ধ ছিলেন। এজন্য তিনি বহুবার চীন সফর করেছেন। “চীনারা তাকে পছন্দ করে এবং তিনি চীনাদের পছন্দ করেন। চীনারা তার কাজের গতিতে খুব মুগ্ধ হয়েছিল এবং তার প্রশংসা করেছিল”, জানাচ্ছেন তিনি।

মেট্রো বাস ও অরেঞ্জ লাইন ট্রেন

শাহবাজ শরিফ শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে অনেক প্রকল্প সম্পন্ন করলেও তার সময়ের দুটি বড় প্রকল্প প্রাথমিকভাবে সমালোচিত হয়।তিনি লাহোরে যানবাহনের চাপ কমাতে শহরে মেট্রো বাস চালানোর পরিকল্পনা করেছিলেন। সে সময় ইমরান খান বিরোধী দলে থাকায় একে ‘জংলা বাস’ বলে সমালোচনা করা হয়েছিল।

সাংবাদিক সালমান ঘানির মতে, শাহবাজ শরিফ ‘সমস্ত সমালোচনা ও বিরোধিতা সত্ত্বেও’ মেট্রো বাস প্রকল্পটি সম্পন্ন করেন এবং সেটা সফলও হয়। এরপর রাওয়ালপিন্ডি ও ইসলামাবাদ ছাড়াও মুলতানে একই প্রকল্পের কাজ শুরু হয়।

ইমরান খানের সরকার নিজেরাই পরে খাইবার পাখতুনখাওয়া প্রদেশে একই ধরনের একটি প্রকল্প শুরু করেছিল। লাহোরে অরেঞ্জ লাইন ট্রেন চালানোর প্রকল্প নিয়েও বিরোধীদের সমালোচনার মুখে পড়েন শাহবাজ শরিফ। বিরোধীদের ধারণা ছিল যে প্রকল্পটি এতটাই ব্যয়বহুল যে এটি ভর্তুকি দিয়ে চালানো সরকারের জন্য একটি ‘বিশাল বোঝা’। যাই হোক, পরে এই প্রকল্পটি পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ সরকারের অধীনে চলতে শুরু করে এবং এখনও চলছে।

ট্র্যাজেডি মডেল টাউন

২০১৪ সালে মিনহাজ-উল-কুরআন নামে একটি এনজিওর কর্মীদের সাথে পুলিশের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। সংঘর্ষটি হয়েছিল শাহবাজ শরিফের খাসতালুক লাহোর শহরের মডেল টাউন এলাকায়। সেখানে মিনহাজ-উল-কুরআনের কার্যালয় এবং দলটির প্রধান আল্লামা তাহির-উল-কাদরির বাসভবনের বাইরে পুলিশ ও এনজিও কর্মীদের মধ্যে ওই সংঘর্ষ হয়েছিল।

এই সংঘর্ষের সময় পুলিশ মিনহাজ-উল-কুরআনের পুরুষ ও নারী কর্মীদের উপর টিয়ারশেল ও লাঠিচার্জ করে এবং পরে পুলিশ তাদের লক্ষ্য করে গুলিও চালায়। পুলিশের গুলিতে মিনহাজ-উল-কুরআনের ১৪ জন কর্মী নিহত এবং শতাধিক আহত হন। ঘটনাটি স্থানীয় টিভি চ্যানেলে সরাসরি সম্প্রচার করা হয় যা তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে।

সরকার ওই ঘটনার তদন্তের জন্য একটি বিচার বিভাগীয় কমিশন গঠন করে, ওই রিপোর্টে এই ঘটনার জন্য পাঞ্জাব সরকারকে ‘দায়ী’ করা হয়। মিনহাজ-উল-কুরআনের প্রধান ড. তাহির-উল-কাদরি এই ঘটনার জন্য মুখ্যমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ, প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ, পাঞ্জাবের আইনমন্ত্রী রানা সানাউল্লাহকে দায়ী করেন।

আদালতের নির্দেশে ২০১৪ সালে নওয়াজ শরিফ, শাহবাজ শরিফ, রানা সানাউল্লাহ এবং অন্যান্যদের বিরুদ্ধে ফয়সাল টাউন থানায় একটি এফআইআরও নথিভুক্ত করা হয়েছিল। যাই হোক, পরে পুলিশ ‘ঘটনার সাথে অভিযুক্তের সংযোগ’ প্রমাণ করতে না পারায় এই এফআইআর’টি বন্ধ হয়ে যায়। মডেল টাউন ট্র্যাজেডিতে পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তারা-সহ শতাধিক আসামির বেশির ভাগই পরে খালাস পান।

প্রদেশ থেকে কেন্দ্রে

বড় ভাই নওয়াজ শরিফের তুলনায় শাহবাজ শরিফ রাজনীতিতে সবসময় গৌণ ভূমিকা পালন করতেন। নওয়াজ শরিফ যখনই প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন, শাহবাজ শরিফ পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন। সাংবাদিক মুজিবুর রহমান শামির মতে, শাহবাজ শরিফ জননেতা নন, তিনি একজন ভালো প্রশাসক।

তার মতে, শরিফ ভাইরা ‘অপ্রয়োজনীয় সংঘর্ষে’ জড়াতে চাননি এবং তারা প্রতিরক্ষা সংস্থাগুলির সাথেও তাল মিলিয়ে চলতে চেয়েছেন।

যাই হোক, ২০১৭ সালে পরিস্থিতি পাল্টে যায় যখন নওয়াজ শরিফকে পানামা মামলায় সুপ্রিম কোর্ট আজীবনের জন্য অযোগ্য ঘোষণা করে। দলের সভাপতিত্ব শাহবাজ শরিফের হাতে গেলেও প্রধানমন্ত্রীর পদ যায় শহীদ খাকান আব্বাসির হাতে।

অন্যদিকে নওয়াজ শরিফ চিকিৎসার অনুমতি নিয়ে লন্ডনে যান আদালত তার সাজা ঘোষণার পর কিছুদিন কারাগারে কাটিয়ে। ২০১৮ সালের নির্বাচনে শাহবাজ শরিফ পাঞ্জাব ছেড়ে কেন্দ্রে আসার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি পার্লামেন্টের সদস্য নির্বাচিত হন এবং দ্বিতীয় বৃহত্তম দলের নেতা হওয়ার কারণে তিনি বিরোধী দলীয় নেতাও নির্বাচিত হন। তার বিরুদ্ধে কথিত দুর্নীতি ও অর্থ পাচারের মামলা দায়ের হলেও কোনও মামলায় তাকে শাস্তি দেওয়া হয়নি।

প্রথমবারের মতো প্রধানমন্ত্রী

২০২২ সালে, শাহবাজ শরিফ বাকি বিরোধী দলগুলোর সাথে যুক্ত হন এবং প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের বিরুদ্ধে পার্লামেন্টে অনাস্থা প্রস্তাব আনেন। অনাস্থা ভোটের ফলে ইমরান খানের সরকারের পতন হয়।

ইমরান খানের জায়গায় পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক মুভমেন্ট বা পিডিএম শাহবাজ শরিফকে প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী করে। পিডিএম হল পাকিস্তানের কয়েকটি রাজনৈতিক দলের জোট। যেখানে বিলাওয়াল ভুট্টোর দল পাকিস্তান পিপলস পার্টিও ছিল। ওই জোটে যোগ দেয়ার মাধ্যমে শাহবাজ শরিফ প্রথমবারের মতো পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হন।

সাংবাদিক সালমান ঘানির মতে, ‘শাহবাজ শরিফ প্রধানমন্ত্রীর পদ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন যে সেই সময়ে দেশে অবিলম্বে স্থিতিশীলতা প্রয়োজন।‘ ১৬ মাস পিডিএমের শাসনের পর তার এই সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল কি না এমন প্রশ্নের জবাবে সালমান ঘানি বলেন, ‘তিনি সঠিক প্রমাণিত হননি।‘

অর্থনৈতিক সংকট এবং ‘জোটের রাজনীতি’

শাহবাজ শরিফের পিডিএম সরকার ১৭ মাসে ক্রমাগত অর্থনৈতিক সংকটের সম্মুখীন হয়। এই সময়কালে সরকার ডলারের দাম ক্রমেই বেড়ে যাওয়া ঠেকাতে পারেনি বা ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। এতে রাজনৈতিকভাবে তার দল বেশ তাৎক্ষণিক ক্ষতির মুখে পড়ে।

পাকিস্তানের সাংবাদিক ও বিশ্লেষক মজিদ নিজামী মনে করেন, এ কারণেই তার দল পাঞ্জাবের উপনির্বাচনে বাজেভাবে হেরে যায় এবং এর প্রভাব সাম্প্রতিক নির্বাচনেও দেখা গিয়েছে।

মজিদ নিজামীর মতে, সরকার বাঁচাতে মিত্রদের স্বার্থ দেখাও শাহবাজ শরিফের জন্য জরুরি ছিল। ‘অতএব, তিনি তার পছন্দ মতো কাজ করতে পারেননি এবং এইভাবে একজন ভাল প্রশাসক হিসাবে তার ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয়েছে।‘ তিনি আরও বলেন, শাহবাজ শরিফ বরাবরই ‘সুসম্পর্কের রাজনীতি’ পছন্দ করতেন।

‘তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন যে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর সঙ্গে কোনও দ্বন্দ্বে জড়ানো ঠিক হবে না। বরং তিনি মনে করতেন তাদের সাথে কাজ করা উচিত।‘

সাংবাদিক মাজিদ নিজামীর মতে, শাহবাজ শরিফ ২০১৭ সালে তার ভাই নওয়াজ শরিফ, তার মেয়ে মরিয়ম নওয়াজ এবং সামরিক বাহিনীর মধ্যে নিজের জায়গা তৈরি করতে সক্ষম হন। যাই হোক, সমঝোতার নীতির অধীনে তিনি ২০২২ সালে সরকারের ক্ষমতা গ্রহণ করেন। কিন্তু এজন্য তার দলকে রাজনৈতিকভাবে মূল্য দিতে হয়েছিল।

দ্বিতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী

সাম্প্রতিক নির্বাচনে পিএমএল-এন তাদের প্রত্যাশা অনুযায়ী পার্লামেন্টে স্পষ্ট সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে পারেনি। পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ সমর্থিত স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ৯০টির বেশি আসনে জয়ী হয়ে বৃহত্তম শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। পিএমএল-এন দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে এবং কিছু স্বতন্ত্র প্রার্থী যোগ করায় তাদের আসন প্রায় ৮০টিতে দাঁড়িয়েছে। প্রাথমিক কিছু দ্বিধাদ্বন্দ্বের পর, শাহবাজ শরিফের দল এবং পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) জোট বেঁধে কেন্দ্রীয় সরকার গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়।

পিপিপি প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী শাহবাজ শরিফকে ভোট দেওয়ার আশ্বাস দেয় এবং বিনিময়ে তিনি তাদের প্রেসিডেন্ট-সহ কয়েকটি সাংবিধানিক পদ নিশ্চিত করেন। সাংবাদিক ও বিশ্লেষক মজিদ নিজামী বলেছেন, ‘অতীতের মতো এবারও শাহবাজ শরিফের জন্য ভালো ব্যাপার হল তিনি পাঁচ বছরের জন্য প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন, কিন্তু তার সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকায় তার সরকার খুব একটা শক্তিশালী নয়।

তবে তিনি বলেছেন, অতীতে যেমন নওয়াজ শরিফ ও ইমরান খানের সঙ্গে সামরিক শক্তির খারাপ সম্পর্ক হতে দেখা গেছে, শাহবাজ শরিফের সঙ্গে সেরকমটা ঘটার সম্ভাবনা খুবই কম। ‘শাহবাজ শরিফ রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে কখনোই বিদ্রোহী ছিলেন না। সামরিক শক্তির সঙ্গে তার কোনো লড়াই নেই।‘ ‘তারা আদর্শিকভাবে সামরিকপন্থী। দৃশ্যত তার কোন অহংবোধ আছে বলেও মনে হয় না‘, বলছিলেন মজিদ নিজামী।

সূত্র : বিবিসি

Facebook Comments Box
advertisement

Posted ১০:১৫ | রবিবার, ০৩ মার্চ ২০২৪

Swadhindesh -স্বাধীনদেশ |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

advertisement
advertisement
advertisement
Advisory Editor
Professor Abdul Quadir Saleh
Editor
Advocate Md Obaydul Kabir
যোগাযোগ

Bangladesh : Moghbazar, Ramna, Dhaka -1217

ফোন : Europe Office: 560 Coventry Road, Small Heath, Birmingham, B10 0UN,

E-mail: news@swadhindesh.com, swadhindesh24@gmail.com