| বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর ২০১৩ | প্রিন্ট
আমিনুল ইসলাম মিঠু
“ভাই আমারে আটকে রাইখা নির্যাতন করতাছে। অমানুষিক নির্যাতন চালায়। বাড়িতে ফোন করতে দেয় না। আমাকে এ জায়গা থেকে উদ্ধার করেন, নাইলে আমি মইরা যামু। আমারে নিয়া যান। এরা মানুষ না।”
টেলিফোনে কান্নাজড়িত কণ্ঠে জর্ডান থেকে এভাবেই আকুতি জানালেন রোমানা আক্তার। তার বাড়ি বাংলাদেশে, কুমিল্লার দাউদকান্দির বোয়ালমারি ইউনিয়নের জামালপুর গ্রামে।
মাত্র সাড়ে চার মাস আগেই তিনি জর্ডানের একটি হাসপাতালে কাজের উদ্দেশে দেশ ছাড়েন। রাজধানীর ফকিরাপুলের উইন ইন্টারন্যাশনাল নামে একটি রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে তিনি পাড়ি জমান। কিন্তু জর্ডানে তাকে করতে হচ্ছে গৃহপরিচারিকার কাজ, আর প্রতিদিন সহ্য করতে হচ্ছে অমানবিক নির্যাতন।
রোমানার স্বামী সাদ্দাম হোসেন এ বিষয়ে পরষ্ট্রমন্ত্রণালয়ে অভিযোগও করেছেন। কিন্তু এখনো কোনো প্রতিকার পাননি। জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো-বিএমইটির পক্ষ থেকেও এখনো কোনো কার্যকরী উদ্যোগ নেয়া হয়নি। প্রতারণার পরও রিক্রুটিং এজেন্সি রয়েছে বহাল তবিয়তে।
অভিযোগপত্রে রোমানার স্বামী সাদ্দাম হোসেন বলেন, “তার স্ত্রী চলতি বছর ২৬ জুন এক দালাল চক্রের ফাঁদে পড়ে জর্ডানের এক হাসপাতালে কাজের উদ্দেশে রওনা হয়। কিন্তু তার স্ত্রী সেখানে গৃহপরিচারিকার কাজ পায় এবং তাকে অনেক নির্যাতনের শিকার হতে হচ্ছে। রোমানা সেখানে খুব অসুস্থ অবস্থায় আছে।”
সাদ্দাম বলেন, “রোমানাকে নিয়ে পরিবারের সবাই দুঃশ্চিন্তায় আছি। তাকে দেশে ফেরত আনতে আমরা নিরূপায়।”
রোমানার মামাত ভাই রুবেল তার বোনকে উদ্ধারের জন্য সরকার ও মানবাধিকার সংগঠনগুলোর কাছে আকুতি জানিয়েছেন।
রুবেল বলেন, নতুন বিয়ে হয়েছিল তার। অভাব-অনটনের সংসার ছিল। এক পর্যায়ে নিজেই সিদ্ধান্ত নেন বিদেশ যাবেন। অভাব দূর করবেন। জর্ডানে অবস্থানরত এক ফুফাত বোনের সাথে যোগাযোগ করলে তার মাধ্যমে যোগাযোগ করেন রিক্রুটিং এজেন্সির সাথে। পড়ে যান দালাল চক্রের খপ্পরে।
টেলিফোনে রোমানা জানান, মালিক তাকে প্রথম মাসের বেতন দিলেও এখন আর তাকে একটি টাকাও দেয় না।
তিনি বলেন, “আমাকে পানিও খেতে দেয় না। সকাল ৬টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত অমানুষিক খাটুনি খাটায়।”
প্রসঙ্গত, প্রবাসে নারীকর্মীদের ওপর নির্যাতনের অভিযোগ দিন দিন বাড়ছেই। শারীরিক, মানসিক ও অর্থনৈতিক নির্যাতন চলে তাদের ওপর। কর্মীর সাথে নিয়োগকর্তারা কৃতদাসের মতোই আচরণ করেন। ঠিকমতো খাবার, সুপেয় পানি দেয় না। চুক্তি অনুযায়ী বেতনও পান না তারা। বহু নিয়োগকর্তার বিরুদ্ধে যৌন নির্যাতন চালানোর অভিযোগও পাওয়া গেছে ।
গড়ে প্রতি মাসে ৪০টির মত কর্মী নির্যাতনের অভিযোগ জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো-বিএমইটির কাছে আসছে।
দেশে প্রবাসী নারী কর্মীদের নিয়ে কাজ করে এমন কয়েকটি বেসরকারি সংগঠনের কর্মকর্তারা জানান, দুবাই, লেবানন, ওমান, জর্ডান, বাহরাইন ও সৌদি আরব থেকে নারী কর্মীদের ওপর নির্যাতনের অভিযোগ বেশি আসে।
রোমানাকে জর্ডানে পাঠানোর কাজে জড়িত রিক্রুটিং এজেন্সি উইন ইন্টারন্যাশনালে গেলে সেখানকার কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেন স্বীকার করেন রোমানা জর্ডানে সমস্যায় পড়েছেন। তিনি বলেন, রোমানা বাংলাদেশ দূতাবাসে গিয়ে সমস্যার কথা বললে সাহায্য পাবেন।
আনোয়ার জানান, রোমানা যে বাসায় কাজ করে, সেই বাসার ম্যাডাম ১৫দিন আগে আমাকে ফোন করেছিলেন। তিনি বলেছেন, “রোমানা কাজ করতে চাচ্ছে না, দেশে ফেরত যেতে যায়। তাই নানান ধরণের মিথ্যা অভিযোগ করছে।”
“রোমানা হয়ত কোনো সমস্যা পড়েছে, তিনি তো অনেক আশা করে বিদেশে কাজ করতে গেছেন, তাহলে তিনি কেন অজুহাত দেখিয়ে চলে আসতে চাইবেন?” -এমন প্রশ্নের জবাবে আনোয়ার হোসেন সুর পাল্টিয়ে এড়িয়ে যান।
এ সময় তিনি বলেন, “রোমানাকে আমরা পাঠাইনি। তার এক আত্মীয়ের মাধ্যমে সে সেখানে গেছে। আমরা শুধু প্রসেসিং করেছি।”
কী কী প্রসেসিং করেছে উইন ইন্টারন্যাশনাল -জানতে চাইলে আনোয়ার বলেন, “বাংলাদেশ সরকারের নিয়ম অনুযায়ী প্রসেসিং করেছি। বিএমইটির ছাড়পত্রসহ আমরা তাকে ট্রেনিং করিয়েছি।”
রোমানার মামাত ভাই রুবেল জানান, জর্ডানে পারভিন নামে রোমানার এক ফুফাত বোন শুধু ভিসা পাঠিয়েছিলেন। পরে উইন ইন্টারন্যাশনালে যোগাযোগ করতে বললে তারা যোগাযোগ করেন। এ এজেন্সিই রোমানাকে কাজের সন্ধান দেয়।
রুবেল অভিযোগ করেন, তারা যখন রোমানাকে ফেরত আনতে উইন ইন্টারন্যাশানালের সাথে যোগাযোগ করেন, তখন আনোয়ার হোসেন তাদের বলেন, রোমানার বিপরীতে অন্য একজন মেয়ে ঠিক করে দিতে হবে। এরর পাশাপাশি ৭০ হাজার টাকা দিলে তবেই রোমানাকে ফেরত এনে দেবেন।
গত সোমবার রুবেলের সাথে উইন ইন্টারন্যাশানালের কার্যালয়ে যান এ প্রতিবেদকও। এ সময় এজেন্সির কর্মকর্তা আনোয়ারের কাছে জানতে চাওয়া হয়, নতুন মেয়ে এবং দাবিকৃত টাকা দেওয়ার পরও যদি রোমানাকে আনতে না পারেন তবে কী হবে?
এ সময় আনোয়ার হোসেন চেচিয়ে উঠে বলেন, “আমার কাছে আসলেনই এখন। যান, সরকার বা রাষ্ট্রকে বলেন ব্যবস্থা নিতে।”
তার কাছে রোমানার মালিকের ফোন নম্বর আছে কিনা জানতে চাইলে আনোয়ার উত্তেজিত হয়ে বলেন, “আমাদের কাছে নম্বর নাই, রাষ্ট্রের কাছে আছে। আপনারা আমাদের কী বোঝাতে চাচ্ছেন?” এরপর তিনি কেটে পড়েন।
জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর অতিরিক্ত মহাপরিচালক (কর্মসংস্থান) জাবেদ আহমেদ প্রবাসে নারীকর্মীদের এ ধরনের অভিযোগের কথা স্বীকার করেন।
তিনি বলেন, “অনেক সময় আমাদের দূতাবাস তাদের সেভ হোমে নিয়ে আসে। ক্ষেত্রবিশেষে দেশে ফেরতও আনা হয়। দূতাবাসকে এ বিষয়ে নির্দেশনা দেয়া আছে। শিক্ষার অভাবে তারা দালাল ও নিয়োগকর্তার হাতে বৈষম্যের শিকার হন। এক কাজের কথা বলে নিয়ে যায় কিন্তু যাওয়ার পর তাকে দিয়ে গৃহস্থালির কাজ করান। নারীকর্মীরা বিদেশে ফ্রি ভিসায় যাওয়ার কথা থাকলেও যেতে পারেন না।”
রোমানাকে ফেরত আনার ব্যাপারে বিএমইটির মহাপরিচালক বলেন, “আমাদের একটি প্রতিনিধি দল বর্তমানে জর্ডানে অবস্থান করছে। আমরা দ্রুতই এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের করবো।”
এদিকে জর্ডানে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে সেখানের টেলিফোনটি কেউ রিসিভ করেনি।
বিএমইটির পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বর্তমানে বিশ্বের ৬০টি দেশে বাংলাদেশি নারীকর্মী কর্মরত আছেন। ১৯৯১ সাল থেকে ২৩ জুন ২০১৩ পর্যন্ত বিদেশগামী নারীকর্মীর সংখ্যা ২ লাখ ৪৫ হাজার ৪৬৬ জন। এর মধ্যে জর্ডানে কর্মরত আছেন প্রায় ১৮ হাজার ৬৬ জন।
তবে বিএমইটির কাছে বিভিন্ন দেশ থেকে ফেরত আসা কর্মীদের হিসাব নেই বলে জানান মহাপরিচালক জাবেদ আহমেদ।
উক্ত লেখাটি প্রকাশ হওয়ার পর যুক্তরাজ্যের নিউক্যাসেল আপনটাইন এ বসবাসরত কনজারভেটিভ পাটির নর্থ-ওয়েষ্ট রিজনের নেতা আলী আলী হায়দার স্বাধীনদেশ পত্রিকার নিউজ রুমে যোগাযোগ করে তার ক্ষুদ্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন ।
তিনি বলেন, অতি দ্রুত সরকার এবং বিদেশে অবস্থানরত মিশনগুলোকে রোমানাকে উদ্ধারের ব্যবস্থা গ্রহন করতে হবে। তিনি প্রবাসে বসবাসরত সকল প্রবাসীদের অনুরোধ করে বলেন, যার যার সাধ্যমত রোমানাকে উদ্ধার পক্রিয়া শুরু করতে বিশেষভাবে অনুরোধ জানান।
Posted ২২:০২ | বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর ২০১৩
Swadhindesh -স্বাধীনদেশ | admin