| মঙ্গলবার, ১০ জুন ২০১৪ | প্রিন্ট
নোমান বিন আরমান : বিশ্বের সেরা পাঁচটির অন্যতম। এশিয়ার প্রথম গ্রিন গ্যালারি। দেশের গৌরব। সিলেটের আইকন। এই রকমের গালভরা নানা অভিধা সিলেট আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামের। এতসব গৌরবের কপালে কলঙ্কের তিলক হয়ে দেখা দিল তিন কোমল প্রাণের করুণ মৃত্যু। চা পাতার সবুজেঘেরা লাক্কাতুরার ইতারে ইতারে, সারি সারি উঁচু-নিচু টিলার ছন্দে ছন্দে এখন কেবলই হাহাকার। চাপাতল পল্লীতে শুধুই কান্না আর শোকের ছায়া। কণ্ঠে কণ্ঠে বেদনার দীর্ঘশ্বাস! খেলার স্টেডিয়াম খেললো মানুষের জীবন নিয়ে। প্রাণ বিসর্জন দিয়ে নিজেদের জীবন বিপন্নের খবর দিল তিন ভাইবোন। একসঙ্গে তিন ভাইবোনোর এমন মৃত্যুর দাগ গৌরবের স্টেডিয়ামের গায়ে রক্ত-তিলক হয়েই রইবে বলে মনে করছেন সপ্রাণ মানুষেরা।
এই করুণ মৃত্যুর পর প্রশ্ন ওঠেছে স্টেডিয়াম নির্মাণের মান ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানসহ সংশ্লিষ্টদের সততা, দক্ষতা ও দায়িত্বশীলতা নিয়ে। জনতা থেকে নিয়ে জনপ্রতিনিধি- সবাই বলছেন, নি¤œমানের কাজের ফলেই নির্মম মৃত্যুর ঘাতক হলো স্টেডিয়ামের প্রতীরক্ষা দেয়াল। দেয়ালটির ভিত এতোই দুর্বল ছিলো, নিজের প্রতীরক্ষায় না লেগে অন্যের প্রাণ সংহার করলো।
স্থানীয়রা অভিযোগ করেছেন, ২০১৪ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ খেলার আয়োজনের জন্যে তাড়াহুড়ো করে স্টেডিয়ামের কাজ শেষ করার হয়। খেলাটি হয়েছেও। কিন্তু খেলার উন্মাদনায় মত্ত কেউই এমন বিপজ্জনক নির্মাণ ত্রুটির ব্যাপারটি গুরুত্ব দিয়ে দেখেননি। বিপদ মাথায় নিয়ে বাস করা চাপাতল পল্লীর চা-জনগোষ্ঠীর ‘মূল্যহীন’ মানুষেরা বারবার এ নিয়ে অভিযোগ করেছেন। তাদের নিরাপত্তার প্রতি নজর দেওয়ার আকুতি করেছেন। কিন্তু গরিব মানুষের কথা কে শোনে! কেউ শোনেনি। তাই প্রাণ দিয়ে তাদের জীবন বিপন্নের খবর দিয়ে গেলো তিন-ভাইবোন।
স্টেডিয়াম সূত্র জানায়, সিলেটে আইসিসি টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপ আয়োজনের অংশ হিসাবে ২০১২ সালের ডিসেম্বর জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদ একনেক-এর বৈঠকে সিলেট বিভাগীয় স্টেডিয়ামের উন্নয়নের জন্য ৮৭ কোটি টাকার প্রকল্প অনুমোদিত হয়। দরপত্র আহ্বান করা হয় ২০১৩ সালের এপ্রিলে। কার্যাদেশ দেয়া হয় একই বছরের জুনে। ২০১৩ সালের ৮ জুলাই ‘সিলেট বিভাগীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামটিকে’ আন্তর্জাতিক মানে উন্নীতকরণ প্রকল্পের ভিত্তি প্রস্তুর স্থাপন করেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত ও তৎকালীন ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী আহাদ আলী সরকার। শুরুর দিকে আইসিসির একটি প্রতিনিধি দল সিলেট বিভাগীয় স্টেডিয়াম পরিদর্শনকালে উন্নয়নকাজের অগ্রগতি নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে। আর এই বিলম্বকে পুষিয়ে নিতে দিনে রাতে নির্মাণ কাজ করা হয়।
স্থানীয়দের অভিযোগ, এভাবে তাড়াহুড়ো করে নির্মাণ কাজ শেষ করায় অনেক ত্রুটিই সেখানে রয়ে যায়। কিন্তু কিক্রেট উন্মাদনায় মত্ত কেউই সেদিকে নজর দেননি।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ‘বসতি আর্কিটেক্ট’ নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে স্টেডিয়ামের নির্মাণ কাজ দেওয়া হয়। কিন্তু, বিভাগীয় ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক ও আওয়ামীলীগের প্রভাবশালী নেতা শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল প্রকল্পের ডিজাইনে অনেক পরিবর্তন করেন। এমনকি দৃষ্টি নন্দন গ্রীণ গ্যালারীর ডিজাইন তার প্রভাবে পরিবর্তন করা হয়।
অভিযোগ রয়েছে, নিজের পছন্দের ঠিকাদার নিয়োগ করে নাদেল সীমানা প্রাচীর, রাস্তাসহ অনেক কাজ করিয়েছেন। কিন্তু তার পছন্দের ঠিকাদার কোনো কাজই ভালোভাবে করেননি। নিম্নমানের কাজের ফলে মঙ্গলবার রাতে দেয়াল ধসে তিন ভাইবোনের নিহতের ঘটনা ঘটলো।
কাজে অনিয়মের অভিযোগ এনে টুকেরবাজার ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. শহিদ আহমদ বলেন, এখানের প্রায় ২০টি পরিবারের শতাধিক সদস্য এখনও মৃত্যুর ঝুঁকিতে রয়েছেন। কিন্তু তাদের নিরাপত্তার দিকটি কেউই কোনো গুরুত্ব দিচ্ছেন না। উল্টো নি¤œমানের কাজ করে স্টেডিয়ামের টাকা লুটপাট করা হয়েছে। তিনি বলেন, স্টেডিয়াম আমাদের গৌরব। কিন্তু পাহাড়-প্রকৃতি আর বাগানের পরিবেশও আমাদের রক্ষা করতে হবে। এখানে বসবাসকারী চা-জনগোষ্ঠীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। সেটি হচ্ছে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, অবাধে পাহাড় কেটে এখানে পরিবেশ ধংস করা হচ্ছে। চা-জনগোষ্ঠীর জীবনকে বিপন্ন করে তোলা হয়েছে।
সিলেট সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামীলীগের সহসভাপতি আশফাক আহমদও দুর্ঘটনায় মৃত্যুর জন্যে নি¤œমানের কাজকেই দায়ী বলে মনে করছেন। নিহতদের সম্ভব সবরকমের সরকারি সহায়তা ও ঝুঁকিপূর্ণ পরিবারগুলোকে পুনর্বাসনের আশ্বাসও তিনি দিয়েছেন।
সিলেট বিভাগীয় ক্রীড়া সংস্থার একটি সূত্র জানায়, আন্তর্জাতিক এই ক্রিকেট স্টেডিয়ামটি বর্তমানে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের নিয়ন্ত্রনে রয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী একজন ভেন্যু ম্যানেজার নিয়োগ দেয়ার কথা। কিন্তু সরকারি দলের স্থানীয় নেতাদের কারণে ভেন্যু ম্যানেজারের পদটিও শূন্য পড়ে আছে।
এ ব্যাপারে বিভাগীয় ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক শফিউল আলম চৌধুরী নাদেলের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি। তিনি বর্তমানে প্রধানমন্ত্রীর সাথে চীন সফরে রয়েছেন বলে তার সাথে ঘনিষ্টরা জানিয়েছেন।
প্রকল্পে স্টেডিয়ামে চারতলা বিশিষ্ট গ্র্যান্ড স্ট্যান্ড নির্মিাণ ব্যয় ধরা হয় ২২ কোটি টাকা। ৬৫ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত হয় গ্যালারি, জায়ান্ট স্ক্রিন, ফ্লাড লাইট, মিডিয়া সেন্টার, স্কোর বোর্ড, সীমানা প্রাচীর, রাস্তা ও ইনডোর জিমনেসিয়াম।
প্রসঙ্গত, মঙ্গলবার বৃষ্টিতে সিলেট আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামের দেয়াল ধসে নিহত হয়েছেন চাপাতল পল্লীর আজান মিয়ার মেয়ে নাসিমা বেগম (১৮), ছেলে জাহেদ মিয়া (১৩) ও ভাতুষ্পুত্র (পিতা মৃত কুতুব মিয়া) রুহুল মিয়া (১২)। এঘটনায় সিলেটের জেলা প্রশাসক মো. শহিদুল ইসলামের উদ্যোগে ৩০ হাজার টাকার অনুদান সংগ্রহ করে নিহতদের পরিবারকে দেওয়া হয়েছে। সরকারি সাহায্য হিসেবে জেলা প্রশাসকের ত্রাণ তহবিলের বর্তমান ফান্ডের (পুরো) ৩৫ হাজার টাকা তাদের দেওয়া হবে বলে তিনি জানিয়েছেন। এছাড়া সরকারি ক্ষতিপূরণ পেতে সময় লাগবে বলে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক মো. শহিদুল ইসলাম।
Posted ১০:২৭ | মঙ্গলবার, ১০ জুন ২০১৪
Swadhindesh -স্বাধীনদেশ | admin