বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার সাবেক রাজনৈতিক সচিব হারিস চৌধুরী মৃত্যু নিয়ে ধুম্রজাল কেটেছে দৈনিক মানবজমিনের প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরীর একটি বিশেষ প্রতিবেদনে। সেখানে তিনি হারিস চৌধুরীর মেয়েকে উদ্ধৃত করে খবরের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন। কিন্তু হারিস চৌধুরীর এই নীরব প্রয়াণ জন্ম দিয়েছে নানা প্রশ্নের।
১. হারিস চৌধুরীর মৃত্যুর বিষয়টি আমি জেনেছিলাম গত বছরের অক্টোবরে। যুক্তরাজ্য শাখা স্বেচ্ছাসেবক দলের একজন মধ্যসারির নেতা ৮ অক্টোবর, ২০২১ তারিখে বিষয়টি আমাকে জানিয়েছিলেন। ভদ্রলোক ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষার স্বার্থে সে কনভারসেশনের প্রমাণস্বরূপ স্ক্রীনশট দিতে পারছি না। যাই হোক, সেদিন তিনি হারিস চৌধুরীর ভাই আশিক চৌধুরীর সূত্রে তা নিশ্চিত করেছিলেন। হারিস চৌধুরীকে নিয়ে একজনের লেখা শোকগাঁথা ‘ফেরারীর জন্য ভালোবাসা‘ আমাকে পাঠিয়েছেন। তিনি বারবার বলেছিলেন খবরটি শতভাগ সত্য। কিন্তু খবরটি নিশ্চিত করে উদ্বৃত হবার মতো কেউ বা উদ্ধৃতি দেবার মতো কারো বক্তব্য ছিল না। হারিস চৌধুরীর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ একজনের কাছে জানতে চাইলে তিনি হেসে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন-‘খবরটি সম্পূর্ণ মিথ্যা‘। ফলে তখন সাংবাদিক হিসেবে এই নিয়ে কিছু লিখে বিভ্রান্তি তৈরি করতে চাইনি। যাই হোক, দীর্ঘদিন পর অবশেষে খবরটি নিশ্চিত করেছেন তার কন্যা।
২. হারিস চৌধুরীর কাজিন আশিক চৌধুরী এখন সামনে এসেছেন। হারিস চৌধুরীর সুবিধাভোগীদের শীর্ষে তার অবস্থান। এই লোকটি সত্য প্রকাশের নামে কেবল ধূম্রজালই তৈরি করেননি, করেছেন জঘন্য মিথ্যাচার। তিনি বলেছেন- “হারিস চৌধুরী যুক্তরাজ্যে মারা গেছেন। আমেরিকায় বসে তিনি হারিস চৌধুরীর মৃত্যুর খবর পেয়েছেন।” অথচ বাস্তবতা হচ্ছে বাংলাদেশে হারিস চৌধুরীর মৃত্যুর সময় আশিক চৌধুরী দেশে ছিলেন। বরং নিজের বিপদ এড়াতে তিনি পরদিনই চলে যান আমেরিকা। আশিক চৌধুরী যে দেশে ছিল সেটা হারিস চৌধুরীর মেয়ের বক্তব্যে পরিস্কার। কারন হারিস চৌধুরীর লাশ গ্রামে নিতে মানা করেছেন তিনি। প্রশ্ন হচ্ছে- লাশ গ্রামে নিলে বা দাফন করলে কি ক্ষতি হতো! হারিস চৌধুরীতো যুদ্ধাপরাধীও নন যে তার লাশ গ্রামে নিলে সমস্যা হবে। তিনি এমন কোনো অপরাধী নয় যে মৃত্যুর পর উনার লাশ গ্রামে নেয়া যাবে না। এটা পরিস্কার হলো যে, আশিক চৌধুরী মিথ্যুক, কাপুরুষ।
৩. হারিস চৌধুরী কোথায় মৃত্যুবরণ করেছেন? কোথায় উনার লাশ দাফন করা হয়েছে? আশিক চৌধুরী বলেছেন, উনার মৃত্যু হয়েছে যুক্তরাজ্যে। দাফন হয়েছে লন্ডনে। উনি শুনেছেন। তবে উনি কনফার্ম করেছেন। এটা তিনি ভুলে গেছেন, আর যাই হোক লন্ডনে গোপনে দাফন করার সুযোগ নেই। এইখানে বিভ্রান্তি দূর করেছেন হারিস চৌধুরীর মেয়ে। তিনি পরিস্কার বলেছেন- তার বাবার মৃত্যু হয়েছে বাংলাদেশে। বাংলাদেশেই ছিলেন তিনি। তবে তার মেয়ে বলতে পারেননি কোথায় দাফন হয়েছে? বলেছেন- অনেক দূরে। কিন্তু কত দূরে? তিনি কি বলতে পারছেন না কোনো কঠিন চাপের কারণে? প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।
৪. হারিস চৌধুরী কোথায় ছিলেন? দীর্ঘ দেড় দশক ধরে নানাগুজব ডালপালা ছড়িয়েছে। কখনো ভারতের আসামে, কখনো ইরানে, কখনো যুক্তরাজ্যে। এখন উনার মৃত্যুর পর মেয়ে বলছেন- বাংলাদেশেই ছিলেন আত্মগোপনে। বাংলাদেশে দীর্ঘ এই আত্মগোপনে থাকার কথা কতোটা যৌক্তিক! তিনি মুক্ত থাকলে কোথাও না কোথাও, কখনো না কখনো আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজরে পড়তেন। দলীয় নেতাকর্মীদের নজরে পড়তেন। যেখানে অবস্থান নিয়েছেন সেখানে প্রতিবেশীদের নজরে পড়তেন। তাবলীগে আত্মগোপন সম্ভব না। তাবলীগে গোয়েন্দা সংস্থার লোক গিজগিজ করে। সেখানে দীর্ঘ সময় আত্মগোপন অসম্ভব।
৫. হারিস চৌধুরী যদি আত্মগোপনে থাকতেন তাহলে তিনি দলের সঙ্গে কোনোভাবে যুক্ত ছিলেন না কেন? তার মতো একজন লোক পুরো রাজনীতি থেকে দূরে থাকবে এটা স্বাভাবিক না। তিনি যুক্ত ছিলেন না বলেই দলের পদপদবীতে নেই। তিনি তো প্রকাশ্যে বিএনপির সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেননি। তাহলে দল কেন তাকে খুজেঁনি। আর দীর্ঘ এই সময়ে দল ও শীর্ষ নেত্রীর এমন দুর্যোগে তিনি নীরবে আত্মগোপনে থাকবেন এটা কিভাবে বিশ্বাসযোগ্য। দলের নেতাদের প্রায় সবাই বারবার গ্রেপ্তার হয়েছেন, বছরের পর বছর কারাভোগ করেছেন। হারিস চৌধুরীর ভাগ্যেও তাই হতো নিশ্চয়। অন্যরা জেলে যেতে পারলে উনি পারবেন না কেন? তাহলে কি উনি ভীতু-কাপুরুষ ছিলেন? তাহলে কি তিনি এমন কোনো অপরাধে জড়িত ছিলেন বা জড়ানো হতে পারে এমন ভয়ে ছিলেন? সেটা যদি হয় উনার তো বাংলাদেশে থাকার কথা নয়। পুলিশ-র্যাব-গোয়েন্দাবাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে বাংলাদেশে দীর্ঘ দেড়দশক আত্মগোপন মোটেই বিশ্বাসযোগ্য নয়।
৬. উনার মেয়ে যুক্তরাজ্য সরকার আইন বিভাগে কাজ করতেন। বাবা অসুস্থ হলে তাকে দেখতে যাবার জন্য তো চাকরি ছাড়ার প্রয়োজন হয় না। তাহলে কেন তিনি বৃটিশ সরকারের চাকরি ছেড়ে দিলেন? কেনই বা হারিস চৌধুরীর ছেলে বাবার মৃত্যুর খবর পেয়ে দেশে আসেননি? এখানে নিশ্চিতভাবেই প্রশ্ন থেকে যায়, প্রশ্ন থেকে যাবে।
৭. হারিস চৌধুরী কি তাহলে সরকারের তত্ত্বাবধানে বা আশ্রয়েই ছিলেন? এমন বার্তাই মিলেছে দায়িত্বশীল সূত্রে। এবং এটা উড়িয়ে দেয়ার সুযোগ নেই। বরং এটাই যৌক্তিক। সরকার তাকে নিজেদের তত্ত্বাবধানে রেখেছে। তার কাছে তথ্য নিয়েছে বাধ্য করে। জীবন রক্ষার তাগিদে বাধ্য হয়েছেন তিনি। হয়তো সেখান থেকেই পরিবারের সাথে কখনো কখনো কথা বলার সুযোগ পেয়েছেন। তার জীবন রক্ষায় হয়তো পরিবার সেটা প্রকাশ করেনি। একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে বিএনপি স্থায়ী কমিটির একজন নেতার সাথে কথা হয়েছিল। দলের শীর্ষ নেতারা জানেন সরকার হারিস চৌধুরীকে ব্যবহার করেছে, তাই হয়তো তারা মৃত্যুর পর শোকবার্তাও দেয়নি। নইলে বিএনপি শোকবার্তা দেবে না কেন? তার ভাই আশিক চৌধুরী তো বিএনপি করে, দলকে তো তারই জানানোর কথা।
যাই হোক, নিজেদের তত্ত্বাবধানে থাকাকালে যখন হারিস চৌধুরী মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছেন তখন হয়তো তার মেয়েকে ডেকে এনেছে সরকার। হয়তো মৃত্যুর পর মেয়েকে ডেকে আনা হয়েছে। সে জন্য তার মেয়ে বলতে পারছেন না বাবাকে কোথায় দাফন করা হয়েছে। নইলে প্রকাশ্যে লাশ দাফনে সমস্যা কোথায়? এখানে তার খোলাসা না করার কারন নিশ্চিতভাবেই ভয়। সে সরকার ছাড়া আর কাকে ভয় পাওয়ার কথা। সে জন্যই আশিক চৌধুরী মৃত্যুর খবর পেয়ে হারিস চৌধুরীর লাশ গ্রামে নিতে মানা করেছেন। কারণ গ্রামে নিলে বা প্রকাশ্যে দাফন করলে প্রশ্ন উঠতো হারিস চৌধুরী কোথায় ছিলেন, কিভাবে মৃত্যুবরণ করলেন, কোথায় মৃত্যুবরণ করেছেন। তখন বিষয়টি লুকিয়ে রাখা যেতো না। সরকারের তত্ত্বাবধানে সে ছিল এবং মারা গেছে এটা জানাজানি হলে তার মতো তথাকথিত আত্মগোপনে থাকা বা গুম হওয়া নেতাকর্মীরা যে সরকারের তত্ত্বাবধানে আছে বা ছিল সেটা প্রকাশ হতো। ফলে তাদের পরিবারসহ বা দেশের সর্বস্তরের মানুষ এই নিয়ে প্রশ্ন তুলতো। তাদের ফেরত চাইতো। এই নিয়ে স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে আন্দোলন তৈরি বা নৈরাজ্যময় পরিস্থিতি তৈরি হতে পারতো।
আন্তর্জাতিক মহল প্রশ্ন তুলতো এবং চাপ প্রয়োগ করতো। সরকার সে ঝুঁকি কেন নেবে? ফলে গোপনেই দাফন করতে হয়েছে লাশের। তখন তার কাজিন আশিক চৌধুরী সে ধরনের পরিস্থিতি এড়াতেই পরদিন আমেরিকা চলে যান। এখনো স্বৈর সরকারের ভয়েই তারা প্রকাশ করতে পারছেন না আসল ঘটনা। এমন তথ্য্যই পাওয়া গেছে দায়িত্বশীল কিছু সূত্রে। এবং এটাই যৌক্তিক।
প্রশ্নগুলোর উত্তর মিলবে একদিন। কেবল সামান্য সময়ের অপেক্ষা।
১৫ই জানুয়ারী ২০২২, যুক্তরাজ্য