| সোমবার, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২২ | প্রিন্ট
শাহরিয়ার মিল্টন,শেরপুর : একসময় কাঠমিস্ত্রি ছিলেন রহমান ফার্নিচার মার্টের স্বত্বাধিকারী আবদুর রহমান। পরে তিনি শেরপুরের পশ্চিমশেরী এলাকায় নিজেই কারখানা ও দোকান দেন। এরপর ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে পুঁজি। এখন এ ব্যবসায় তার বিনিয়োগ ২৫ লাখ টাকা। তার তৈরি আসবাব শেরপুরসহ বিভিন্ন জেলায় বিক্রি হয়। এতে বদলে গেছে তার জীবন। দোতলা বাড়ি করেছেন শহরে।সন্তানদের পড়াশোনা করাচ্ছেন।
শুধু আবদুর রহমানই নন, শেরপুরের আসবাবশিল্প এভাবে আরও অনেক মানুষেরই জীবন বদলে দিয়েছে, যারা একসময় দিনমজুর ছিলেন। এ জেলার দারিদ্র্যবিমোচনে আসবাবশিল্পের বড় ভূমিকা রয়েছে। শেরপুর সদর উপজেলার সাতটি গ্রামে গড়ে উঠেছে আসবাব তৈরির প্রায় ৩০০ কারখানা। এসব কারখানার সঙ্গে জড়িত রয়েছেন প্রায় পাঁচ হাজার মানুষ। এ খাত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, প্রয়োজনীয় সহযোগিতা পেলে এখানকার আসবাব বিদেশেও রপ্তানি করা সম্ভব।
এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রায় দুই দশক আগে শেরপুর সদরের শেরীপাড়া, পূর্বশেরী, পশ্চিমশেরী, অষ্টমীতলা, মধ্যবয়ড়া, বয়ড়াপরানপুর ও কুসুমহাটি গ্রামের অধিকাংশ মানুষ পেশায় দিনমজুর ছিলেন। স্বল্প আয়ে সংসার চালাতে হিমশিম খেতেন তাঁরা। এসব মানুষের পড়াশোনাও তেমন ছিল না। তবে কিছু মানুষের প্রধান পেশা ছিল কাঠের কাজ। এসব গ্রামে ওই সময় দুই থেকে তিনটি কাঠ চেরাইয়ের স মিল ছিল।
এসব স মিলে কাঠ চেরাই করে কিছুসংখ্যক মিস্ত্রি কাঠের খড়ম (জুতা), আম কাঠের পিঁড়ি, টুল, চেয়ার-টেবিল ইত্যাদি বানিয়ে শেরপুর শহরের বিভিন্ন স্থানে বিক্রি করে সংসার চালাতেন। তবে ২০০৭ সালের পর থেকে এ চিত্র পাল্টে যেতে থাকে। কয়েকজন কাঠমিস্ত্রি শেরপুরেরঝিনাইগাতী, শ্রীবরদী ও নালিতাবাড়ী উপজেলার গারো পাহাড়ের বনে রোপিত আকাশমণি কাঠ স্বল্পমূল্যে কিনে শেরীপাড়া গ্রামে গড়ে তোলেন আসবাব তৈরির ৮ থেকে ১০টি কারখানা।
এসব কারখানায় যুক্ত হন শতাধিক কাঠ, নকশা ও রংমিস্ত্রি। ক্রমান্বয়ে কারখানার সংখ্যা বাড়তে থাকে। বর্তমানে জেলা সদরের শেরীপাড়া, পূর্বশেরী, পশ্চিমশেরী, অষ্টমীতলা, মধ্যবয়ড়া, বয়ড়াপরানপুর ও কুসুমহাটি গ্রামে গড়ে উঠেছে আসবাব তৈরির প্রায় ৩০০ কারখানা। এসব কারখানায় কাঠ জোগান দেওয়ার জন্য স্থাপন করা হয়েছে ২০ থেকে ২৫টি স মিল।
বর্তমানে এসব কারখানায় তৈরি হচ্ছে বক্স খাট, সেমি বক্স খাট, সাধারণ খাট, সোফা সেট, ডাইনিং ও ড্রেসিং টেবিল, আলমারি, ওয়ার্ডরোব, ফাইল ক্যাবিনেট, ওয়াল সেট, সিঁড়িসহ বিভিন্ন ধরনের খেলনাসামগ্রী। আকাশমণি কাঠ দিয়েই তৈরি হয় অধিকাংশ আসবাব। চমৎকার কারুকাজ ও ডিজাইন থাকায় দিন দিন মানুষের কাছে এসব আসবাবের কদর বাড়ছে।
সম্প্রতি সরেজমিনে শেরীপাড়া, পূর্বশেরী, পশ্চিমশেরী ও অষ্টমীতলা এলাকায় দেখা যায়, আসবাব তৈরির কারখানাগুলোয় বিভিন্ন ধরনের আসবাব তৈরি করছেন শ্রমিকরা। কেউবা করাত দিয়ে কাঠ চেরাই করছেন, কেউবা হাতুড়ি-বাটালি দিয়ে কাঠের ওপর খোদাই করে নকশা করছেন, আবার কেউ আসবাবে রং দিচ্ছেন। প্রস্তুত আসবাবগুলো বিক্রির জন্য বিক্রয়কেন্দ্রে রাখা হয়েছে।
পূর্বশেরী এলাকার মাসুদ ফার্নিচার মার্টের মালিক মাসুদ রানা বলেন, তাদের কারখানায় তৈরি আসবাবের মান ভালো হওয়ায় চাহিদা আছে বেশ। বর্তমানে ফুল বক্স খাট ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকায়, সেমিবক্স খাট ৭ থেকে ১৩ হাজার টাকায়, লতা খাট ৩ থেকে ৪ হাজার টাকায়, বিভিন্ন ধরনের সোফা সেট ১৫ থেকে ২৫ হাজার টাকায়, ওয়ারড্রোব ৯ থেকে ১৫ হাজার টাকায়, ডাইনিং টেবিল ৮ থেকে ১২ হাজার টাকায়, ড্রেসিং টেবিল ৫ থেকে ১০ হাজার টাকায় এবং আলনা ৩ থেকে ৫ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বর্তমানে এখানকার আসবাব ঢাকা, গাজীপুর, ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, টাঙ্গাইল, জামালপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সিলেট, বগুড়াসহ দেশের বিভিন্ন অ লে বিক্রি হচ্ছে।
করোনা পরিস্থিতির কারণে প্রায় দুই বছর ধরে ব্যবসায়ীরা কিছুটা মার খাচ্ছেন। করোনার প্রভাবে যখন পরিবহন বন্ধ ছিল, তখন দূরবর্তী জেলা থেকে পাইকাররা আসতে পারতেন না। তখন এসব আসবাব দোকানে অবিক্রীত পড়ে ছিল। পর্যাপ্ত মূলধনের অভাবে অনেক ব্যবসায়ী নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে কম মূল্যে আসবাব বিক্রি করতে বাধ্য হন। এতে তাঁরা আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েন। এ শিল্পের উন্নয়নে সহজ শর্তে ব্যাংকঋণ দরকার বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
এদিকে ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, গত কয়েক বছরে আসবাব তৈরির বিভিন্ন উপকরণের দাম অনেক বেড়েছে, কিন্তু সে তুলনায় আসবাবের বিক্রয়মূল্য বাড়েনি। করোনার কারণে দাম বাড়ানোও যাচ্ছে না। এ পরিস্থিতিতে দেশীয় বাজারের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বাজারে রপ্তানির সুযোগ পেলে আসবাবশিল্পে গুণগত পরিবর্তন আসত বলে মনে করেন তারা। বিশেষ করে শেরপুরের অবস্থান ভারতের উত্তর-পূর্বা লীয় রাজ্য মেঘালয়ের সীমান্তবর্তী হওয়ায় ওই অ লে এসব আসবাব রপ্তানির সম্ভাবনা খতিয়ে দেখা দরকার বলে মনে করেন শেরপুরের আসবাব ব্যবসায়ীরা। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলেন, এখানকার কাঠের মান ভালো। এখন নকশা আরও উন্নত করতে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও বিনিয়োগ দরকার। সে জন্যসরকারি নীতি সহায়তা জরুরি।
শেরপুর শিল্প ও বণিক সমিতির সভাপতি আসাদুজ্জামান রওশন বলেন, আসবাবশিল্পের সঙ্গে জড়িত সদরের কয়েকটি গ্রামের মানুষের উন্নতি চোখে পড়ার মতো। সরকারি সাহায্য-সহযোগিতা ছাড়াই কয়েক শ পরিবারের হাজারখানেক মানুষ অতিদরিদ্র অবস্থা থেকে স্বাবলম্বী হয়েছেন। এ শিল্পের উন্নয়নে সহজ শর্তে ও কম সুদে ব্যাংকঋণের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। তাহলে আরও বেশিসংখ্যক উদ্যোক্তা এ শিল্পে যুক্ত হবেন। পাশাপাশি বেকার তরুণদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে।
Posted ১২:৩৯ | সোমবার, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২২
Swadhindesh -স্বাধীনদেশ | admin