| বুধবার, ২৪ অক্টোবর ২০১৮ | প্রিন্ট
সালেহ্ বিপ্লব : রিপোর্টিং-এ যারা নবীন, সেই ভাইবোনদের বলছি। কিছু কথা বলতে ইচ্ছে করে, কাউকে কাউকে বলিও। তবে বলার চেয়ে লিখা ভালো। লিখলে অনেককেই রিচ করা যায়, আর সিনিয়রদের লিখাই উচিত। অগ্রজেরা যাপিত জীবনের শিলালিপি না রেখে গেলে ইতিহাস অনুজদের শেখাবে কী করে? সিনিয়র শুধু না, আসলে সব রিপোর্টার, সব সাংবাদিক; এমনকী সব পেশাজীবীর লিখে যাওয়া উচিত। এটাও নতুনদের জন্য একটা কারিকুলাম।
তো নতুন রিপোর্টারদের একটা কথা সবার আগে বলতে চাই। অন্তত একটা বাড়তি কলম রাখবেন। আর সেটা ভিন্ন কালারের হলে ভালো হয়। যারা ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় কাজ করেন, তারা বাড়তি মেমোরি, আর ব্যাটারি। এখন তো আর ক্যাসেট নেই। টিভি রিপোর্টারদের ক্যাসেট পাঠানোর জন্য সাথে খাম রাখতে হয় না। মুন্নী আপা দেখা হলেই বলতেন, ‘বিপ্লব, আমার খাম দেন।’ আমি শাহনাজ মুন্নীর কথা বলছি। হাস্যময়ী মিষ্টি বোন আমার, দীর্ঘদিন ভিভিআইপি বিটে আমরা একসাথে কাজ করেছি। বঙ্গভবন যাওয়া হত খুব কম, আমরা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়েই ডিউটি করতাম। ঢাকা ও ঢাকার বাইরে সব অনুষ্ঠান কাভার করতাম। ঢাকার বাইরে কখনো কখনো হেলিকপ্টারে যাওয়ার সুযোগ মিলতো, তবে বেশির ভাগ সময় নিজস্ব পরিবহন। যেবার আমাদের জন্য হেলিকপ্টার নেই, সেবার অনেক টেনশন! মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অনুষ্ঠান শেষ, তিনি হেলিকপ্টারে ওঠার আগেই ক্যাসেট দিতে হবে প্রেস অফিসারদের কারো হাতে। সেই কয়েক মিনিট জীবনের ওপর কী যে ঝড় বয়ে যায়, পিএম বিটের বন্ধুরা জানেন। সে আরেক কাহিনী, আমরা খাম নিয়ে বলছিলাম। ঢাকার বাইরে চ্যানেল আই-এটিএন প্রথম সাক্ষাতেই মুন্নী আপার সরল বিবৃতি। নিশ্চিন্ত-নির্ভার সংলাপ প্রক্ষেপন। ‘বিপ্লব তো আমার জন্য খাম নিয়ে আসছেন। দেন আমার খাম দেন।’ এই নিয়ে মজা হত অনেক। খাম শুধু না, স্কচ টেপ-স্টেপলার-গাম থাকত আমাদের কাছে। এক বিন্দু অবহেলা একদিকে যেমন কাজের বিঘ্ন ঘটায়, অন্যদিকে প্রোডাকশন কোয়ালিটি কমিয়ে দেয়। আবার প্রি-প্রোডাকশনে এক বিন্দু সতর্কতা একজন রিপোর্টারকে পোস্ট প্রোডাকশনে ‘মোর স্মার্ট’ করে তোলে। রিপোর্টার মানেই একজন স্মার্ট মানুষ। ল্যাপটপ বা মোবাইলে নোট নেয়ার মত স্মার্টনেস আমাদের অর্থাৎ রিপোর্টারদের আছে। তবে কাগজ কলমের বিকল্প কখনোই হবে বলে আমার মনে হয় না। ‘জটিংস’ শব্দটা আমার কানে খুব মধুর শোনায়। নোট বুকে টুকে নেয়া কথাগুলো দিয়ে ভালো একটা স্ক্রিপ্ট বানাবেন, সেখানে সুপাঠ্য রিপোর্ট তৈরি করতে কলমের একাধিক রং একটা নির্মাণ-কৌশল। ভালো স্ক্রিপ্ট লেখার পদ্ধতিটা আমার কাছ থেকে আর কেউ নিয়েছিলো কিনা জানি না, তবে আমার আরেকটা মিষ্টি বোন রিয়া এটা শিখে নিয়েছিলো। শাহরিয়া হোসেন রিয়া, খুব ভালো রিপোর্টার। অসাধারণ গান করে, ব্যক্তিত্বে আভিজাত্য টনটনে অথচ ব্যবহার খুবই মিষ্টি। এখন কানাডায় থাকে। রিয়া আর আমার টিম সেদিন এক গাড়িতে ফিরছিলাম, সচিবালয় থেকে। আমি বরাবরই সামনে বসি, চ্যানেল আইর সাদা একটা স্টেশন ওয়াগন আমার এক দশকের সঙ্গী ছিলো। আর ছোট মাইক্রো, যেটাকে আমরা টমটম বলতাম, সেগুলোতেও চড়েছি বেসুমার। তো আমার নোট নেয়া হত এ ফোর কাগজ চার ভাঁজ করে। সচিবলায় থেকে অফিসে ফেরার সময় আমি জটিংস পড়ছি, কালো কালির লেখাগুলোর মাঝে মাঝে সবুজ বা নীল কালি দিয়ে মার্ক করছি। একবার পুরো নোটস এভাবে পড়ে গেলাম। আবার পড়তে শুরু করলাম, এবার হাতে লাল কলম। শাইখ ভাই আমাদের শিখিয়েছিলেন, টিভি রিপোর্টের স্মার্ট ডিউরেশন দেড় মিনিট। ৯০ সেকেন্ড। এই ৯০ সেকেন্ডের মধ্যে ৪৫ সেকেন্ড থাকবে বক্তা বা বক্তাদের জন্য। ৪৫ সেকেন্ড স্ক্রিপ্ট। ৪৫ সেকেন্ড মানে ৯০ শব্দ। প্রতি সেকেন্ডে দুই শব্দ বলা একটা ভিজুয়াল রিপোর্টের বিশেষ দিক। তো ১০০ শব্দ নিজের স্ক্রিপ্টে লিখতে হবে আর ১০০ শব্দ বক্তার মুখে শোনাতে হবে। আর ৫০ শব্দ তুলে ধরতে হবে ফুটেজের মাধ্যমে। রিপোর্ট আড়াইশ’ শব্দের হলে পত্রিকার জন্যও ভালো। অনেকে বলেন, পত্রিকার রিপোর্ট আর টিভির রিপোর্ট ভিন্ন, আমি জেনেশুনেই বলি, দুই মাধ্যমের স্ক্রিপ্টিং আসলে একই। যাক, এ নিয়ে আলোচনা পরে কখনো হবে, এখন ওই নানান রঙের কলমের কথায় ফিরি। দ্বিতীয়বার নোটস পড়ার সময় আমি লাল কালি ব্যবহার করি। এই লাল কালি দিয়ে মার্ক করা কথাগুলোই ফাইনাল। এবার আরেকটা কাগজে লাল মার্ক করা বাক্যগুলো একের পর এক লিখে ফেলি। ততক্ষণে গাড়ি পৌঁছে গেছে অফিসে, পিসি অন করতে যতক্ষণ, এরপর ফাইল সাবমিট করতে মিনিট পাঁচেক লাগে। আমার লক্ষ্মী বোন ও সহকর্মী রিয়া আমার ‘রংবাজি’ দেখে জিজ্ঞেস করেই বসলো, ‘ভাইয়া, কী করছেন?’ তাকে জানালাম, কালো রঙে নোট নিয়েছি ৫০ লাইন। সবুজ কালিতে সেটা ৩০ লাইনে আনলাম। লাল কালিতে আনলাম ১৫ লাইনে। এক লাইন মানে ৬ থেকে আট শব্দ। নিউজ প্রেজেন্টারকে তিন কি চার লাইন দেব। মানে পত্রিকার ভাষায় যেটা ইনট্রো, সেটা নিউজ প্রেজেন্টার পড়ে শোনাবেন, সেকেন্ড প্যারা দিয়ে আমার প্যাকেজ শুরু হবে। আর এই পুরো কাজটাতে নানান রঙের কলমের ভূমিকা অনেক বিশাল, মানতেই হবে এমন নয়। তবে চর্চা করে দেখলে শুধু রিপোর্টার নন, নতুন লেখকরাও উপকৃত হবেন। পাঠক ও দর্শকের খুব কাছে যেতে পারবেন। আর যত সহজ ভাষায় লিখবেন ততোই জনপ্রিয়তা পাবেন। যত পারা যায় ছোট বাক্যে লিখবেন, প্রশংসিত হবেন। লেখক : সিনিয়র বার্তা সম্পাদক, দৈনিক আমাদের অর্থনীতি।
Posted ১৪:০৩ | বুধবার, ২৪ অক্টোবর ২০১৮
Swadhindesh -স্বাধীনদেশ | Athar Hossain