বৃহস্পতিবার ২৫শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১২ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ভেজাল ও দুর্নীতি সমাজকে কুরে কুরে খাচ্ছে

নিজস্ব প্রতিবেদক   |   বৃহস্পতিবার, ১২ জানুয়ারি ২০২৩ | প্রিন্ট

ভেজাল ও দুর্নীতি সমাজকে কুরে কুরে খাচ্ছে

নূরে আলম সিদ্দিকী : রাষ্ট্রীয় বিনির্মাণের দিকে দৃষ্টি নিপাত করলেই সাদামাটা চোখে অবলোকন করা যায়, যথাযথভাবেই উন্নয়ন কাজ এগিয়ে চলেছে। ঢাকা শহর আজ মেট্রোরেল যুগে প্রবেশ করেছে। সন্দেহাতীতভাবে নগরবাসী যাতায়াতের ক্ষেত্রে অনেকটাই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবেন। এটা স্বস্তিদায়ক এবং অর্থনৈতিকভাবেও সাশ্রয়ী হবে নিঃসন্দেহে। নগরবাসী এতে অনেকটাই উৎফুল্ল, আবেগাপ্লুত এবং হৃষ্টচিত্ত। এর পাশাপাশি দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি এবং অভূতপূর্ব মুদ্রাস্ফীতি জনমনে দুঃসহ যন্ত্রণার সৃষ্টি করেছে। এটা বলাই বাহুল্য, এ উন্নয়নের স্বাদ গ্রহণে তাদের মানসিক স্বস্তি এবং একে যথার্থ হৃদয়ঙ্গম করার সাধ্য আজ আমজনতার নেই বললেই চলে। দ্রব্যমূল্যের এ ঊর্ধ্বগতি নিঃসন্দেহে মধ্যস্বত্বভোগীদের মুনাফা অর্জনের ভিন্ন অভিলাষেরই তীক্ষ্ম নেতিবাচক প্রভাব। ইউক্রেন যুদ্ধ ইউক্রেনের মাটিতে সংঘটিত। এ ইউক্রেন যুদ্ধের হোতা পুতিনের রাশিয়ায় মুদ্রাস্ফীতি এতটা ভয়াবহভাবে প্রতিভাত হয়নি। পুতিন কী কৌশল প্রয়োগ করে সেখানে সর্বোচ্চ স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছেন এবং সমাজে ও রাষ্ট্রীয়ব্যবস্থার সব ক্ষেত্রে এমন চমৎকার শৃঙ্খলা রক্ষা করে চলেছেন, তা আজ অনেকের কাছেই পরিষ্কার নয়। ইউক্রেনের যুদ্ধকে অজুহাত ধরে বাংলাদেশের সুবিধাভোগীরা অভ্যন্তরীণ বাজারকে কুক্ষিগত করে এখানকার বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে আকাশচুম্বী প্রলোভনের উদগ্র তৃষ্ণা মেটাচ্ছেন। সেটা মানবতার দিক থেকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলেই প্রতীয়মান হয়। এ প্রচ্ছন্ন আধিপত্যকে সাদামাটা চোখে দেখা না গেলেও চোখ বুজলেই উপলব্ধি করা যায়, এটা সব সামাজিক বিশ্লেষকই স্বীকার করবেন। যদিও এটা প্রচণ্ড শাস্তিযোগ্য অপরাধ, কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, এ শাস্তিযোগ্য অপরাধীরাই সমাজে আধিপত্য বিস্তার করে কেউকেটা সেজে বসে আছেন। এ দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনেও আজ তাদের আধিপত্য এবং দৌরাত্ম্য সর্বজনবিদিত।

 

কাঁচাবাজার থেকে শুরু করে নিত্যপ্রয়োজনীয় সব পণ্যের এ লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধি আজ রোখার যেন কেউ কোথাও নেই। সবাই আজ নির্বাক। বিচারের বাণী আজ নীরবে নিভৃতে কাঁদে। এ বাংলায় প্রতিবাদমুখর দৃপ্ত কোনো উদ্দীপ্ত মুখ ভেসে ওঠে না। আজ কোথাও কোনো ভিসুভিয়াসের অগ্নি উদগিরণ দেখা যায় না, কোথাও কোনো মিছিলের প্রতিধ্বনি শোনা যায় না, কোথাও কোনো প্রতিবাদের পদচারণাও লক্ষ্য করা যায় না। যেটুকু শোনা যায়, সেটা সাদামাটা নিস্পৃহ নিষ্ক্রিয় প্রাণহীন দায়সারা গোছের একটা নিয়মমাফিক বিরোধিতা। কথার জন্য কথা বলা, জবান আছে তাই কথা বলা।

 

বিএনপি দেশের প্রধান বিরোধী দল হওয়া সত্ত্বেও ঘরে বসে বিবৃতি দেওয়া ছাড়া আর কোনো কার্যকরী প্রতিবাদ তারা সৃষ্টি করতে পেরেছেন বলে প্রতীয়মান হয় না। আমি বারবার বলেছি, নির্যাতন-নিগ্রহকে ভয় পেলে আন্দোলন করা যায় না। বিদেশের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে বসে নসিহত করলে তা জনগণের ওপর কোনো প্রভাব ফেলে না, জনগণ উজ্জীবিত হয় না, রাজপথেও নামতে পারে না। আর এটা সর্বজনস্বীকৃত যে, জনগণকে রাজপথে নামাতে না পারলে সরকারের লাগাম ধরে টানা যায় না, সরকারকে কোনো দাবি মানতেও বাধ্য করা যায় না।

 

কালক্রমে নানা ঘটনাপ্রবাহে, অনেকটাই বিরোধী দলের নিস্পৃহতার কারণে আজকে যে সরকার দীর্ঘ এক যুগেরও অধিককাল ধরে ক্ষমতাসীন, তাকে শুধু একদলীয় নয়, এক ব্যক্তির শাসন বললেও অত্যুক্তি হবে না। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ তো বটেই, গোটা দেশই আজ এক ব্যক্তির অঙ্গুলি হেলনে চলছে। এখানে কোনো ব্যত্যয় নেই, কোনো ব্যতিক্রম নেই। এক ব্যক্তির শাসনের বিরুদ্ধে হয় তো টুঁ-শব্দটি করারও কারও অস্তিত্ব নেই। রাজনৈতিকভাবে এটাকে শুধু অস্বস্তিকরই নয়, একদলীয় শাসনব্যবস্থাও নয়, এক ধরনের একনায়কতন্ত্র বললেও বেশি বলা হয় না। কিন্তু স্বাধীনতার ৫১ বছর অতিক্রম হওয়ার পর এরকম একটা অবস্থা তো কারোরই কাম্য ছিল না। কী সরকারি দল, কী বিরোধী দল, কী আমজনতা, কী সাংবাদিক বুদ্ধিজীবী, কী সুশীল সমাজ, কী ছাত্রসমাজ- যাদের বিবেকের জাগ্রত দেবতা হিসেবে ধরা হতো, তারা সবাই আজ এমন নীরব, নিথর, নিস্তব্ধ কেন হয়ে গেল? কোন সম্মোহনী গানের সুরে সমগ্র জাতি আজ নিদ্রাচ্ছাদিত হয়ে গেল, এটা উদ্ভাবন করাই দুষ্কর। পাকিস্তানের ২৩টি বছরে সামরিক শাসন থাকলেও সব স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে সেখানে একটা প্রচণ্ড প্রতিবাদ ছিল। বিরোধীদলীয় রাজনৈতিক অঙ্গন প্রতিবাদে সোচ্চার ছিল। ছাত্রসমাজ তখন হিমাচলের গিরিশৃঙ্গমালার মতো মাথা তুলে দাঁড়াত, সগৌরবে এবং উন্নত শিরে প্রতিবাদ করত। জনতার হৃদয়ের ধড়কানিকে রাজনৈতিক স্বরলিপিতে রূপান্তরিত করে প্রতিবাদের ভাষায় তারা তুলে ধরত। পাকিস্তানের স্বৈরাচারী ক্ষমতার প্রতিভু আইয়ুব খানসহ সামরিক জান্তারা সর্বদাই সন্ত্রস্ত অবস্থায় দেশ শাসন করতেন। নির্যাতন-নিগ্রহ তারা অব্যাহত রাখলেও প্রতি মুহূর্তে তাদের বক্ষ কম্পমান হতো, কখন তাদের ক্ষমতার মসনদ থেকে সরে যেতে হয়। পাকিস্তানি কায়েমি স্বার্থে নেই এহেন কোনো নির্যাতন করেনি। অসংখ্য রাজনৈতিক কর্মীকে তারা কারারুদ্ধ করেছে, বেত্রাঘাত করে কারও দৃষ্টিশক্তিকে অন্ধ করেছে, কারও কর্ণকে বধির করেছে। তাদের নির্যাতন-নিগ্রহ অনেক কর্মীকে বিকলাঙ্গ করে সারা জীবনের জন্য তার চলার শক্তিকে অকেজো করে দিয়েছে। কিন্তু চলমান আন্দোলনকে থামাতে পারেনি। এ আন্দোলনের চলন্ত প্রবাহের জ্বলন্ত স্রোতধারায় আন্দোলন দোল খেতে খেতে স্বায়ত্তশাসন থেকে স্বাধিকার, স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতার আন্দোলনে রূপ নিয়েছে এবং পরাধীনতার বক্ষ বিদীর্ণ করে স্বাধীনতার সূর্যকে ছিনিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে।

 

আজ একটা অদ্ভুত বিষয় আমাকে নিতান্তই মর্মাহত করেছে। আমাদের সময়ে অনেক প্রগতিশীল ছাত্র নেতৃত্বের পুরোধা ও তাদের উত্তরসূরিরা সম্পূর্ণ বিপরীত মুখে ঘুরে অর্থাৎ ইউটার্ন নিয়ে চরম প্রতিক্রিয়াশীল, সুবিধাবাদী, আত্মভোগী এবং প্রচণ্ড আমেরিকায় শান্তির নিবাস গড়ে তুলতে দেখা গেছে। সেদিনের বামপন্থি ছাত্র নেতাদের অনেকের পুত্র-কন্যারা আজ আমেরিকায় স্থায়ীভাবে বসবাস করছে।

 

দুর্নীতি আজ আমাদের দেশে বিভীষিকার রূপ নিয়েছে। আর ভেজাল, সে তো আরও ভয়াবহ। নিত্যনতুন ভয়াবহ উদ্ভট ও ভয়ংকর পদ্ধতি আবিষ্কার করে ভেজাল মেশানো হচ্ছে। বিবেক যেন এখানে সম্পূর্ণ মৃত, মনুষ্যত্বও বিলুপ্তপ্রায়। ভেজাল মিশিয়ে যারা প্রতিনিয়ত প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী বাজারজাত করছেন তারা একটুও ভেবে দেখেন না, খাদ্যে মিশ্রিত এ বিষাক্ত দ্রব্য মানবজীবনে কী বিষক্রিয়া তৈরি করছে। এর প্রতিক্রিয়ায় কী কঠিন দুরারোগ্যে একটা মানুষ কালক্রমে নিপতিত হতে পারেন। সেটি ভাবার কোনো ফুরসতই তাদের নেই। অন্যদিকে সরকারি নিয়ন্ত্রণের অবস্থাও বেহাল। যে কোনো সভ্য দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যে ভেজাল মেশালে ক্ষেত্রবিশেষে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়। অথচ আমাদের দেশে ভেজাল মিশ্রণকারীদের সমাজে কী অবাধ ঔদ্ধত্য! লজ্জাশরম ও বিবেক তাদের তো নিঃশেষিত, শাস্তির ভয়ও বিন্দুমাত্র পেতে হয় না। কারণ শাস্তি দেওয়ার যারা তারাই তো আজ অজ্ঞাত কারণে চোখ বন্ধ করে বসে আছে। ক্ষেত্রবিশেষে বেড়াই খেত খাচ্ছে। আমি অনেক পশ্চিমা দেশে ঘুরেছি, সেখানে খাদ্যে ভেজাল মেশানো একটা ভয়ংকর অপরাধ, চুরি-ডাকাতি রাহাজানি এমনকি খুনের অপরাধের চেয়েও বেশি। অথচ আমাদের দেশে এর কোনো প্রতিকার নেই। কোনো কিছুর কোনো প্রতিবিধান নেই। কেউ যেন এটাকে রোধ করার কোনো তাগিদ বোধ করেন না। পার্শ্ববর্তী ভারতেও হয়তো দুর্নীতি আছে, কিন্তু বাংলাদেশের দুর্নীতি যেন সব দেশকেই ছাপিয়ে যাচ্ছে। আর সব ক্ষেত্রে ভেজালের তো কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। আমরা মেট্রোরেল যুগে প্রবেশ করেছি, কিন্তু ভেজাল প্রতিরোধের ট্রেনটি সিগন্যালের বাইরেই দাঁড়িয়ে আছে। রাষ্ট্রীয়ভাবে ভেজালের বিরুদ্ধে জনমত সৃষ্টি করার ব্যবস্থা আজও পরিলক্ষিত হয় না। সাধারণ ভোক্তা, সামগ্রিকভাবে সমগ্র জনতাই ভেজাল মিশ্রিত দ্রব্যের দায়ে মূলত পরোক্ষভাবে বিষপানই করে চলেছেন। এর বিরুদ্ধে সতর্কতা নেই, কোনো আইনি পদক্ষেপও নেই। ভেজাল মেশানোর দায়ে কারও কোনো শাস্তি হয়েছে, তেমন নজিরও নেই। নিজের আপাত সুবিধার জন্য তারা বুঝতেই পারছেন না এ ভেজাল মেশানো কতটা আত্মঘাতী। সমাজ বিধ্বস্ত হচ্ছে, বিষাক্ত দ্রব্য গ্রহণে মানবতা নীরবে নিভৃতে কাঁদছে কিন্তু তাদের কোনো বোধোদয় হচ্ছে না। শুধু লাভ এবং লাভই যেন জীবনের একমাত্র লক্ষ্য।

 

পৃথিবীর অন্যান্য দেশ এমনকি পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, থাইল্যান্ড, মিয়ানমার, মালয়েশিয়া কোথাও দুর্নীতি এত প্রচণ্ডভাবে ব্যাপকতা লাভ করেনি। খাদ্যে ভেজাল মেশানোর মতো অভিশপ্ত চিন্তাধারা থেকে বাংলাদেশ ছাড়া প্রায় সবাই আজ মুক্ত। খাদ্যে প্রচণ্ড ভেজাল, এমনকি মানুষের জন্য বিষাক্ত সামগ্রী খাদ্যে মেশানো, এ কলঙ্কজনক কর্মকাণ্ড আর কোথাও দেখা যায় না। দুধে ভেজাল, ওষুধে ভেজাল, চিকিৎসায় ভেজাল, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যে ভেজাল, ভোজ্য তেলে ভেজাল, একি দুর্বিষহ অভিশাপ! এর জন্য কি এত রক্তদান? এর জন্য কি এত আত্মত্যাগ? এর জন্য কি এত মানুষের এ প্রাণপণ লড়াই? আজকে সমাজের যেদিকেই তাকাই প্রচণ্ডভাবে মূল্যবোধের অবক্ষয়। মানবতা যেন আজ কঙ্কালের বীভৎসরূপ পরিগ্রহ করেছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে উন্নয়নের কোনো স্বাদই তো জনগণ পাবে না। ঘুণেধরা বাঁশের মতো গোটা জাতি আস্তে আস্তে বিকলাঙ্গ হয়ে যাবে। আজকে যারা সরকারের নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তাদের অবশ্যই বুঝতে হবে- শুধু উন্নয়ন করলেই হবে না, দেশকে সব ধরনের দুর্নীতি থেকে মুক্ত করতে হবে। জনগণকে বুকভরে স্বাধীনতার স্বাদ নিতে হলে দুর্নীতিবিমুক্ত রাষ্ট্র ও সমাজ নির্মাণ অত্যাবশ্যক। দুর্নীতি ঘুণপোকার মতো সব উন্নয়নকে কুরে কুরে খেয়ে ফেলে। একে অবশ্যই প্রতিরোধ করতে হবে এবং এর দায়িত্ব সরকারের। যারা সৃজনশীল বস্তুনিষ্ঠ কার্যকরী বিরোধিতা করেন তাদেরও এগিয়ে আসতে হবে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে জড়িয়ে পড়া এ দুর্নীতিকে উৎপাটন করার লক্ষ্যে। এ যুদ্ধ সমগ্র জাতির, গোটা সমাজের ছাত্র-শিক্ষক, শ্রমিক-কৃষক প্রতিটি জাগ্রত জনতার। একে অন্যের প্রতি দোষ চাপালে অথবা অন্যে কী করে গেছেন সেই অভিশপ্ত কার্যক্রমের দিকে বারবার অঙ্গুলি প্রদর্শন করে নতুন করে সেই অন্যায়ের পুনঃপ্রবর্তন বা নতুন করে চালু করার কোনো যুক্তি নেই। এসব ভেজালই দূর করা সম্ভব হতো, রাজনীতি নির্ভেজাল হলে। সেখানেও তো ভেজালের অভিশপ্ত দূত অক্টোপাসের মতোই সর্বত্র জড়িয়ে রয়েছে। রাজনীতির এ ভেজাল দূর করবে কে? দেশের সরকার ও বিরোধী দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত বর্তমান সময়ের রাজনীতিকরা কি এটা নিয়ে ভাববেন?

 

ছাত্রজীবনে যারা আমায় প্রতিনিয়ত গালিগালাজ করতেন, আমাকে সিআইএর দালাল, আমেরিকাপন্থি বলে কি গালমন্দই না তারা আমাকে করেছেন এবং তারা প্রচণ্ডভাবে তারস্বরে চিৎকার করে সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার কথা বলতেন। জানি না, কী অজানা মন্ত্রে তাদের অনেকেরই জীবনের ভোল পাল্টে গেল। এ দেশের মাটিতে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য যারা তারস্বরে চিৎকার করেছেন এবং সমাজতান্ত্রিক সামাজিক বিপ্লবের স্বপ্ন দেখতেন, তারা নিজস্ব জীবনধারার খোলনলচে বদলে ফেললেন। তাদের অনেকেই জেনারেল এরশাদকে শুধু সমর্থনই দেননি, সন্তর্পণে জেনারেল জিয়া-এরশাদের দলে এবং সরকারে সগৌরবে অবস্থান করেছেন। তাদের চালচলন ও কথোপকথনে এতটুকু দ্বিধা-সংকট, লাজ-শরমের বালাই দেখা যায়নি। সংবাদমাধ্যমেও তাদের আধিপত্য বিরাজমান। এককালের প্রগতিশীলরা অতি প্রতিক্রিয়াশীলদের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছেন। কী অদ্ভুত এ বামপন্থিদের ইউটার্ন! সামরিক জান্তার সহযোগী ও সহযাত্রী হয়ে মিলেমিশে কী অদ্ভুত সেই বিপ্লবীদের ক্ষমতার যাত্রাবিলাস!

 

আমার জীবনের সবচেয়ে কঠিন সত্য হলো- এই আমি কখনো নীতি-বিবর্তনের ভ্রান্তিবিলাসে উন্মত্ত হইনি বা প্রতিটি ক্ষমতার পটপরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে রংধনুর মতো রং বদলে মিলেমিশে একাকার হয়ে যেতে পারিনি। আমি যা বলেছি বা ভেবেছি সেটিই শেষ সত্য, তা কখনই মনে করি না। কিন্তু আমার বিশ্বাসকে অকপটে তুলে ধরতে কুণ্ঠিত হইনি এবং সেই বিশ্বাসের পথ থেকে কখনো সরে দাঁড়াইনি। জীবনসায়াহ্নে এসে তিলে তিলে, মর্মে মর্মে উপলব্ধি করি, বাকশালের বিরোধিতা করে বাকশালকে রুখতে পারিনি কিন্তু যে নেতাকে সত্যের অর্ঘ্য প্রদান করেছি, যে নেতা চাইলে দুই চোখ উপড়ে রক্তজবার মতো তার পদতলে অর্ঘ্য দিতে পারতাম, যে নেতার নির্দেশে গণতান্ত্রিক সংগ্রামের সেনানী হিসেবে বছরের পর বছর অকাতরে, অনায়াসে কারাগারের নিঃসঙ্গ যন্ত্রণা ভোগ করেছি, যে নেতার নির্দেশে মৃত্যুর ভ্রুকুটিকে উপেক্ষা করে নিঃসংকোচে পথ হেঁটেছি, সেই নেতারই সম্মুখে দাঁড়িয়ে অকুতোভয়ে একদলীয় বাকশালি শাসনব্যবস্থার প্রতিবাদ করে আমার রাজনৈতিক জীবনকে, আমার ছিল যে দিন, তাকে নিঃসঙ্গতার অন্তরালে ঠেলে দিয়েছি। কিছুই রয়নি বাকি। আজ নিঃসঙ্গ জীবনের দুঃসহ ক্রান্তিকালে বসে দীপ্তিহীন আগুনের দহনে তিলে তিলে দগ্ধিভূত হয়েও মনের দিক থেকে পরিতৃপ্ত এক সত্তা।

 

শত প্রাপ্তির মাঝেও মেট্রোরেলের তীব্র হুইসেলের শব্দকেও ভেদ করে একটি কথাই আর্তনাদ করে ওঠে- হায় গণতন্ত্র, তুমি কি মরীচিকার মতো হারিয়ে গেলে? কেন আজ তুমি এ মাটির বুকে অধরা হলে? অনেক সাধনা, অনেক রক্তের চড়া মূল্যে তোমাকে যে আমরা ক্রয় করেছিলাম। হে গণতন্ত্র, তোমাকে হারানোর দায়ভার কে নেবে? বিরোধী দল, সরকার নাকি কালের অনন্ত প্রবাহ? কালস্রোতে ভেসে গেল রক্তের চড়া দামে কেনা মৌলিক অধিকারের হীরকখচিত স্বপ্নের গণতন্ত্র।

লেখক : স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক ও ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ।  সূএ: বাংলাদেশ  প্রতিদিন

Facebook Comments Box
advertisement

Posted ০৭:০১ | বৃহস্পতিবার, ১২ জানুয়ারি ২০২৩

Swadhindesh -স্বাধীনদেশ |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

অবাধ্য ভাবনা
(517 বার পঠিত)
advertisement
advertisement
advertisement
Advisory Editor
Professor Abdul Quadir Saleh
Editor
Advocate Md Obaydul Kabir
যোগাযোগ

Bangladesh : Moghbazar, Ramna, Dhaka -1217

ফোন : Europe Office: 560 Coventry Road, Small Heath, Birmingham, B10 0UN,

E-mail: news@swadhindesh.com, swadhindesh24@gmail.com