| সোমবার, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৮ | প্রিন্ট
ডেস্ক রিপোর্ট : সব ভিক্ষুক রাতে মাজার গেট এলাকার ফুটপাতে না ঘুমালেও অনেকেই থাকে। এ সময়টিকেই কাজে লাগায় মাদক ব্যবসায়ীরা। কম টাকায় গাঁজাসহ অন্যান্য মাদকদ্রব্য বিক্রি করে তারা। ভিক্ষুকদের মধ্যে সিরিঞ্জে করে নেশাজাতীয় দ্রব্য নিতেও দেখা যায়
কেউ জন্ম থেকে হারিয়েছে শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হাত, পা অথবা চোখ। কেউ আবার দুর্ঘটনার শিকার হয়ে পরিবারের শেষ সম্পদ বিক্রি করেও সুস্থ হতে না পেরে এখন মানুষের কাছে হাত পেতেই জীবন চালাচ্ছে। তাদের একেকজনের ভিন্ন গল্প যেমন আছে, তেমনি অনেকের আছে মানুষকে মিথ্যা বলে প্রতারণা করে অর্থ উপার্জনের গল্পও। নিজের জীবনের নির্মমতা ভুলতেই নাকি এরা আবার কম খরচে সব নেশা নিয়ে থাকে। তাদের ধোঁয়ায় অন্ধকার করে দেওয়া নেশার আসর সমাজে অন্য ভিক্ষুকদের প্রতি বাড়ায় সন্দেহ। তবে যা-ই হোক, এরা ভিক্ষুক, এদের বিশেষ বিশেষ জায়গায় ভিক্ষা করার বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও সময়-অসময়ে কিনে নিয়ে যায় অনেক টাকার মালিকরা। এমন শত শত ভিক্ষুক দেখা যায় রাজধানীর হাইকোর্ট মাজার গেটে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, রাজধানীর শিক্ষা ভবনের বিপরীতে হাইকোর্ট মাজারের গেট এলাকায় বটগাছের নিচে বসে আছে পঙ্গু, দৃষ্টিশক্তিহীন ৩০ জনের মতো প্রতিবন্ধী। যারা ভিক্ষা করেই জীবন চালায়। কেউ কেউ এ পেশায় কয়েক যুগ হলেও অনেকেই নতুন। মাজার গেট ও ভেতরের মসজিদের আশপাশ মিলিয়ে এখানে থাকে দুই শতাধিক ভিক্ষুক। সাদেক মিয়া নামে এক ভিক্ষুক অন্য এক ভিক্ষুক রফিক মিয়ার সঙ্গে ঝগড়া করতে দেখে সামনে যেতেই সাদেক বলে উঠলেন—‘দেখেন ভাই, আমরা কতজন ভিক্ষা করছি। এর মধ্যে সে নিজের পোলা দুইটারে নিয়ে আইছে। আমরা ঠিকমতো টাকা পাই না, আরো লোক বাড়াইতে আসছে।’ এভাবে নিজেদের মধ্যে নাকি প্রায়ই এমন ঝগড়ার ঘটনা ঘটে। সব ভিক্ষুক রাতে মাজার গেট এলাকার ফুটপাতে না ঘুমালেও অনেকেই থাকে। রাত ৮টা পর্যন্ত থাকে কেউ কেউ। এ সময়টিকেই কাজে লাগায় মাদক ব্যবসায়ীরা। কম টাকায় গাঁজাসহ অন্যান্য মাদকদ্রব্য বিক্রি করে তারা। ভিক্ষুকদের মধ্যে সিরিঞ্জে করে নেশাজাতীয় দ্রব্য নিতেও দেখা যায়। রংপুর থেকে ঢাকায় কাজ করে পরিবার চালানোর উদ্দেশ্যে আসে সেলিম। কিন্তু এখন সে ভিক্ষা করে পরিবারের খরচ চালাচ্ছে। কথা বলতে গেলে প্রথমে কথা বলছিল আকার-ইঙ্গিতে, পরক্ষণে কথা বলে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে। সে জানায়, তার কোনো শারীরিক সমস্যা নেই। তবে ভিক্ষা করার জন্য রাতে না ঘুমিয়ে নেশা করে আর রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে কাটায়। আর দিনের বেলা নিজেকে বাক্প্রতিবন্ধী হিসেবে মানুষের সামনে উপস্থাপন করে ভিক্ষা করে। সেলিম বলে, ‘শুধু আমি নই, এখানে এমন ৩০ জনের মতো আছি। বাইরের ভিক্ষুকরাও এখানে আসে।’ জানা যায়, দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে প্রতিদিন সকাল থেকে সারা দিনই শত শত মানুষ হাইকোর্ট মাজারে আসে। তারা এসব ভিক্ষুককে শারীরিক অক্ষমতা এবং আকুতির কারণে টাকা-পয়সা দিয়ে যায়।
দেখা যায়, সন্ধ্যার পর এখানে বটগাছের নিচে নেশাগ্রস্ত ভিক্ষুকদের সঙ্গে একত্র হয়ে নেশা করছে রিকশাওয়ালারাও। পুলিশের সামনেও হরহামেশা চলছে নেশা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশের এক সদস্য বলেন, ‘কী করব বলেন। এদের চালচুলা নেই, সারা দিন ভিক্ষা করে যা পায় তা নেশা করে শেষ করে ফেলে। ঠিকমতো খাওয়াদাওয়াও করে না। এদের যে মারব বা দৌড়ানি দেব, সেই সুযোগও নেই। মাঝেমধ্যেই ভয় দেখাই। তার পরও নেশা করা বন্ধ হয় না।’ ১৪ বছরের শিউলি। তার বাঁ পায়ের হাঁটুর নিচের অংশ কেটে ফেলা হয়েছে। শিউলি জন্ম থেকে এমন ছিল না। তার কোনো দুর্ঘটনাও ঘটেনি। তাহলে কিভাবে তার পায়ের এ অবস্থা জানতে চাইলে কান্নাজড়িত কণ্ঠে সে বলে, ভিক্ষা করানোর জন্যই একটি চক্র এমন অবস্থা করেছে। আরো কিছু বলতে যেতেই অন্য একজন এসে তাকে নিয়ে যায়। ধানমণ্ডি এলাকা থেকে আব্দুল লতিফ তার মা-বাবার রুহের মাগফিরাতের জন্য কয়েকজন ফকির খাওয়াবেন বলে এসেছেন মাজার গেটে। উদ্দেশ্য এখানে নাকি ফকির পাওয়া যায়। এসে একটু অবাকই হতে হয়েছে তাঁকে। একজনের সঙ্গে কথা বলতেই অন্য একজন এসে বলে বসল—‘ভাই, আমার কাছে ৪০ জন আছে। খালি ভাড়াটা দিয়া দিয়েন। আর মাথাপ্রতি ১২০ টাকা দিলেই হইব।’ আর সামনে থাকা সেলিম বলেন, ‘কোনো ভাড়া দেওয়া লাগব না। কয়জন লাগব, কন। আজ শুক্রবার বইল্লাই এই জায়গায় একটু কম আছে। সবাই বিভিন্ন জায়গায় ভিক্ষা করতাছে। রাইতে আইলে সব ফাইনাল কইরা দিমু। ১০০ টাকা কইরা দিলেই হইব।’
দু-একজন নয়, বিচ্ছিন্নভাবে দুই শতাধিক ভিক্ষুক প্রতিদিনই এখানে বসে। এখান থেকে গিয়ে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ভিক্ষা করে। এদের বেশির ভাগ বিকলাঙ্গ হলেও দেখতে অসুস্থ, কিন্তু সুস্থ এমন ভিক্ষুকের সংখ্যা প্রায় ৫০ জন। যারা চাইলেই কোনো একটা কাজ করে জীবন চালাতে পারে। অনেকের হাত নেই, কারো পা হারিয়ে অসহায়, কেউ হুইলচেয়ারে, কেউ ঠেলাগাড়িতে শুয়ে-বসে ভিক্ষা করছে। সবার সঙ্গেই রয়েছে দু-একজন করে সহযোগী। দিন শেষে যাদের বেতন দেয় ভিক্ষুকরাই। মুন্নি আক্তার নামে একজনের কোমর থেকে নিচের অংশ অবশ হয়ে আছে। একজন সহযোগী নিয়ে ভিক্ষা করে। সহযোগীর বেতন দুই হাজার টাকা দিয়ে আবার তাকে তিন বেলা খাওয়াতে হয়। তার পরও রেখেছে নিজে চলতে পারে না বলে। তবে মুন্নি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলে, ‘কত কষ্ট কইরা ভিক্ষা করে টাকা উপার্জন করি। সেই টাকা থাইকা অনেক পুলিশ ভাই আছে, যারা আইসা ভাগ চায়। টাকা না দিলে এইখানে থাকতে দিব না কইছে।’ ভিক্ষুকদের জন্য আল্লাহর ওয়াস্তে বড় লোকেরা নানা ধরনের খাবার নিয়ে আসেন। এক ভিক্ষুক বলছিল, ‘আমাগো জইন্য কেউ মুরগি কাইটা নিয়া আহে, কেউ বিরিয়ানি, ভাত রাইন্দা নিয়া আহে। আবার মাঝে মাঝে আমরা বাসায় গিয়া খাইয়া আই। এহানে যারা থাহে, তারা বিভিন্ন বাসাবাড়িতে দাওয়াত খায়।’
তবে চিন্তার বিষয় হচ্ছে, এদের মধ্য থেকে কেউ কেউ নেশা থেকে ধীরে ধীরে অপরাধকর্মের সঙ্গে জড়িয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। মাজার গেট এলাকায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে থাকা পুলিশ সদস্য হামিদ মিয়া বলেন, ‘আমরা সব সময় এদের মায়ার নজরে দেখি। কখনো মারধর করি না। এরা এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে যদি কোনো অপরাধকর্মে জড়িয়ে পড়ে, তবে সেটা দুঃখজনক। শুনেছি, সন্ধ্যার পর এখানে নেশার আসর বসে। বিষয়টা সত্য নয়। হয়তো কয়েকজন বিচ্ছিন্নভাবে নেশা করে।’-কালের কণ্ঠ
Posted ১৩:৩৪ | সোমবার, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৮
Swadhindesh -স্বাধীনদেশ | Athar Hossain