শুক্রবার ১৯শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ৬ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ভক্ষকই জেনেভা ক্যাম্পের রক্ষক!

  |   রবিবার, ০৩ জুন ২০১৮ | প্রিন্ট

ভক্ষকই জেনেভা ক্যাম্পের রক্ষক!

ডেস্ক রিপোর্ট : মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্প লাগোয়া মোস্তাকিম রেস্তোরাঁর সামনে হঠাৎ ভিড়। মাঝখানে পুলিশের একটি পিকআপ। জানতে চাইলে ভিড় করা ব্যক্তিদের কয়েকজন জানাল, ক্যাম্প থেকে এক মাদক বিক্রেতাকে ধরে পুলিশে দেওয়া হয়েছে।

কে বা কারা ধরিয়ে দিল, এমন প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে না কেউ। এক ব্যক্তি পরিচয় জানতে চাইলেন। সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে পাশে গিয়ে কথা শোনার ইশারা করেন তিনি। একটু দূরে যেতেই বলেন, “ওই দাড়ি-পাঞ্জাবি পরা নেতা টাইপের লোকটাকে দেখছেন, তার নাম সাহিদ—মাছুয়া সাহিদ। সে তার লোকজন নিয়া ধরে দিছে। তার নামও লিস্টে আছে। তার লোকজনই তো ‘ইয়াবা কম্পানি’। তাকে গত শনিবার র্যাব ধরেছিল। ছেড়ে দিছে। এখন সে আইসা ফেরেশতা সাজতাছে। নিজের লোকজন সরাইয়া অন্যদের ধরতাছে…।”
সেই মাছুয়া সাহিদের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘লালার ছেলে সাব্বিররে পাবলিক লিয়া ধইরা দিছি। সে বাবা বেচে। আমি আইজও ডিসি স্যারের অফিসে গেছি। প্রশাসনকে হেল্প করতাছি।’

পাশেই দাঁড়ানো মোহাম্মদপুর থানার এসআই অপূর্ব জানান, সাব্বিরের কাছে কিছু (মাদক) পাওয়া যায়নি। অভিযোগ যাচাই করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ গত মঙ্গলবার বিকেল পৌনে ৪টার দিকে জেনেভা ক্যাম্প এলাকার চিত্র এটি। গত শনিবার এই ক্যাম্পে র‌্যাব সাঁড়াশি অভিযান চালিয়ে ৫০০ জনকে আটকের পর ১৫৩ জনকে গ্রেপ্তার করে। গত দুই দিন ক্যাম্পে সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, সেখানকার পরিবেশ স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। গাঢাকা দিয়েছে তালিকাভুক্ত শীর্ষ মাদক কারবারিরা। তবে এলাকায় ফিরে বীরদর্পে ঘুরছে কজন তালিকাভুক্ত মাদক কারবারি ও পৃষ্ঠপোষক। তাদের মধ্যে অন্যতম মাছুয়া সাহিদ। যার নাম ঢাকার মাদক কারবারিদের সম্মিলিত তালিকায় ৭৭৮ নম্বরে আছে।

মঙ্গলবার সরেজমিনে সহযোগীদের নিয়ে তাকে মাদকবিরোধী কর্মকাণ্ডে অংশ নিতে দেখা গেছে। স্থানীয়রা বলছে, অভিযানে ক্যাম্পের শীর্ষ কোনো মাদক কারবারি গ্রেপ্তার হয়নি। মাছুয়া সাহিদ ও তার সহযোগীরা এলাকায় প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কিছু মাদক কারবারি রাতে তাদের বাসায় আসছে। তবে মাদক বেচাকেনা কমে গেছে বলে জানায় স্থানীয়রা।
মঙ্গলবার দুপুরে ক্যাম্পের ভেতর দুই ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী বলল, দিনে অভিযান চালানোর কারণে বড় কারবারিদের পায়নি র‌্যাব। রাতে তালিকাভুক্ত কারবারিদের বাসায় তল্লাশি চালালে মাদকদ্রব্যসহ তাদের ধরা যেত। কারবারিরা অনেকে গাঢাকা দিয়েছে আগেই। অভিযানের সময় বোরকা পরে পালিয়ে গেছে বলেও দাবি করে দুই দোকানি। তারা বলল, কমিউনিটি পুলিশের নেতা হওয়ার কারণে মাছুয়া সাহিদের সঙ্গে পুলিশ ও র্যাবের অনেকের যোগাযোগ। কাউন্সিলরসহ রাজনৈতিক দলের ব্যক্তিদের সঙ্গেও সম্পর্ক আছে তার। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে ক্যাম্পের সব মাদক বিক্রেতার কাছ থেকে নিয়মিত মাসোয়ারা নিত সাহিদ। একপর্যায়ে কয়েকজনকে দিয়ে নিজস্ব সিন্ডিকেট গড়ে তোলে সে। স্থানীয়রা ইয়াবা বিক্রেতা দলকে ‘ইয়াবা কম্পানি’ বলে। অভিযানের পর ছাড়া পেয়ে ক্যাম্পে সহযোগীদের নিয়ে মহড়া দিচ্ছে মাছুয়া সাহিদ।

ফাতেমা নামে এক নারী বলেন, ‘শনিবারের পর পুলিশ আর র‌্যাব আসে নাই। মাগার মাছুয়ার লোকজন বলে তারাই সব কিছু দেখতাছে।’ স্থানীয়দের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে অনুসন্ধান চালিয়ে জানা গেছে, জেনেভা ক্যাম্পের মাদকের সবচেয়ে বড় কারবারি ইশতিয়াক এখন সাভারের আমিনবাজারে থাকে। অভিযানের পর কিছু কারবারি টাউন হল ও মার্কেট ক্যাম্প এলাকায় আস্তানা গেড়েছে। সব সংস্থার তালিকায় থাকা জেনেভা ক্যাম্পের ৮২ জনের মধ্যে ইশতিয়াক ওরফে কামরুল শীর্ষ কারবারি। এর পরই আছে নাদিম ওরফে পচিশ। এদের সহযোগীদের মধ্যে মোল্লা আরশাদ ও তানভীর আদনান, ফারজানা আক্তার পাপিয়া, পাপিয়ার স্বামী জয়নাল আবেদীন পাচু, সেলিম আশরাফী ওরফে চুয়া সেলিম ওরফে ভাইয়া, রাব্বী রানা, ফয়সাল, জনি, ভুলু, তাওয়া, মাছুয়া সাহিদ, রাজু, চুসতা সেলিম উল্লেখযোগ্য।

কয়েকজন বাসিন্দা জানায়, ক্যাম্পের বি-ব্লকের শেখ দুলাল ওরফে দোলারা মিস্ত্রির ছেলে শেখ সাহিদ মাছ বিক্রির ব্যবসা করত। এ কারণে তার নাম হয় মাছুয়া সাহিদ। শনিবার অভিযানের সময় সাহিদকে র‌্যাব আটক করে। ওই দিন সন্ধ্যায় তাকে এলাকায় দেখা যায়। দুই বছর ধরে ক্যাম্পের কমিউনিটি পুলিশের সভাপতি সে। এ সময়ের মধ্যে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছে সে। ক্যাম্পের বাজার কাপড় পট্টিতে ও গজনবী রোডে চারটি ইয়াবা ও গাঁজার স্পট নিয়ন্ত্রণের অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে। তার দুটি মোটরসাইকেল, ১২টি সিএনজি অটোরিকশা, দুটি প্রাইভেট কার, তিনটি দোকান ও জেনেভা ক্যাম্পে অন্তত ১০টি ঘর রয়েছে। সম্প্রতি সিলিকন হাউজিংয়ে পাঁচ কাঠার প্লট কিনেছে এবং বসিলায় তিন কাঠা জমির ওপর বাড়ি নির্মাণ করেছে। মোহাম্মদপুর তিন রাস্তার মোড় বসিলা রোডে মেহেদী নামে হোটেল ও ক্যাটারিং সার্ভিস চালু করেছে।

স্থানীয় সূত্র জানায়, কয়েক বছর আগে সাহিদের সহযোগী রাজু খুন হয়েছিল। যে মামলার আসামি সহিদ। আরেক আসামি ওয়াশি আলম বশির ওরফে মোল্লা বশিরও কমিউনিটি পুলিশে সাহিদের সঙ্গে ছিল। মাছুয়া সাহিদের বিরুদ্ধে নারী ও শিশু পাচারের অভিযোগও আছে। গত বছর ৭ মার্চ সীমান্ত জেলা জয়পুরহাটে তার বিরুদ্ধে নারী ও শিশু পাচার আইনে মামলা হয়। এ মামলার গ্রেপ্তারি পরোয়ানা মোহাম্মদপুর থানায় এলে সে কৌশলে তার নাম ও বাবার নামের সঙ্গে মিল থাকায় জেনেভা ক্যাম্পের ৩ নম্বর সেক্টরের বাসিন্দা অন্য এক সাহিদকে গ্রেপ্তার করিয়ে নিজে মামলা থেকে দায়মুক্ত হয়। সাহিদের বিরুদ্ধে আরো কয়েকটি মামলা রয়েছে। গত বছর মাদক কারবারি পঁচিশের মেয়ের জন্মদিনের অনুষ্ঠানে সাঈদের অশ্লীল-মদ্যপ নৃত্যের ভিডিও বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়। এরপর সে নিজের বেশভূষা বদল করে দাড়ি-টুপি পরে ঘুরতে শুরু করে।

স্থানীয়রা জানায়, ৩২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর হাবিবুর রহমান মিজান ও আটকে পড়া পাকিস্তানিদের নেতা আব্দুল জব্বার খানের ঘনিষ্ঠ হওয়ায় কেউ তার বিরুদ্ধে মুখ খোলার সাহস পায় না। সাহিদ প্রায়ই পাকিস্তানে যায় এবং সেখানকার করাচি ওরাঙ্গি শহরে জমি কিনে ছয়তলা ফাউন্ডেশন দিয়ে বাড়ি নির্মাণ করেছে।

সূত্র জানায়, সাহিদের মতোই বেশ পাল্টে ঘুরে বেড়াচ্ছে সহযোগী মোল্লা বশির। সম্প্রতি তার ভাড়া দেওয়া বাসার গোডাউন থেকে আট বস্তা গাঁজা উদ্ধার করেছে মোহাম্মদপুর থানা-পুলিশ। গত বছর মাদকসম্রাট নাদিম ওরফে পঁচিশের সঙ্গে মতিঝিল ঘরোয়া হোটেলে তার সহযোগী কুরাইশসহ খিচুড়ি খাওয়ার ভিডিও বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছিল। ওই ঘটনা ধামাচাপা দিতে সে রাতারাতি মাছুয়া সাহিদের সহযোগিতায় পঁচিশকে মোহাম্মদপুর থানায় আত্মসমর্পণ করিয়ে ওই ঘটনাকে আত্মসমর্পণে উদ্বুদ্ধকরণের চেষ্টা বলে চালিয়ে দিয়ে কৌশলে দায়মুক্ত হয়। স্থানীয়রা জানায়, কলিম ওরফে জাম্বু কসাই ব্যবসার আড়ালে তাদের মতোই মাদকের পৃষ্ঠপোষক। সাহিদের ছত্রচ্ছায়ায় এলাকায়ই আছে বিরানি হীরা, গাঁজা তোতা, আসাদ ও বিরানি আখতারের ছেলে।
আব্দুর রহমান নামে এক বাসিন্দা বলেন, ‘ক্যাম্পে ৪০ হাজার মানুষ থাকে। সবাই তো কারবারি নয়। যারা কারবারি তাদের ধরেন। সাধারণ মানুষকে পুলিশও হয়রানি করে। দালালরাও করে।’

এদিকে মাদক কারবারে জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করে মাছুয়া সাহিদ বলে, ‘আমি সব সময় মাদকের বিরুদ্ধে। মাদক কারবারিরা ষড়যন্ত্র করে তালিকায় আমার নাম দিছে। প্রশাসন এটা জানে।’

মোহাম্মদপুর থানার ওসি মীর জামাল উদ্দিন বলেন, ‘সে (সাহিদ) কমিউনিটি পুলিশ না। এটা স্থানীয়দের কমিটি। যার বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকবে তাকে অবশ্যই ধরা হবে।’ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ মঙ্গলবার দুজনকে সেখান থেকে আনা হয়েছে। তাদের নিয়ে রাতে অভিযান হবে। ক্যাম্পে আমাদের নজরদারি আছে।’ সূত্র : কালের কন্ঠ

Facebook Comments Box
advertisement

Posted ১৩:২৩ | রবিবার, ০৩ জুন ২০১৮

Swadhindesh -স্বাধীনদেশ |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

advertisement
advertisement
advertisement
Advisory Editor
Professor Abdul Quadir Saleh
Editor
Advocate Md Obaydul Kabir
যোগাযোগ

Bangladesh : Moghbazar, Ramna, Dhaka -1217

ফোন : Europe Office: 560 Coventry Road, Small Heath, Birmingham, B10 0UN,

E-mail: news@swadhindesh.com, swadhindesh24@gmail.com