শুক্রবার ২৯শে মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১৫ই চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

ক্যান্সার কি কোনো একক রোগ

নিজস্ব প্রতিবেদক   |   শনিবার, ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ | প্রিন্ট

ক্যান্সার কি কোনো একক রোগ

 ডা. গুলজার হোসেন উজ্জ্বল :বিশ্বজুড়ে মানুষের মৃত্যু হয় যেসব রোগে তার প্রথম তিনটির একটি ক্যান্সার। ক্যান্সার তাই একবিংশ শতাব্দীতে মানবসভ্যতার প্রধানতম শত্রুর একটি। আগামী শতাব্দীতে স্বাস্থ্যখাতের অন্যতম প্রধান চ্যালেঞ্জ ‘ক্যান্সার প্রতিরোধ ও তার চিকিৎসা’। প্রাণঘাতক এই রোগ সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি করতে প্রতিবছর পালিত হচ্ছে বিশ্ব ক্যান্সার দিবস। ২০০০ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি প্যারিসে বিশ্ব ক্যান্সার সামিট আয়োজিত হয়। সেখানেই ঠিক হয়, এই দিনটি বিশ্ব ক্যান্সার দিবস বা বিশ্ব ক্যান্সার সচেতনতা দিবস বা বিশ্ব ক্যান্সার প্রতিরোধ দিবস হিসাবে পালন করা হবে। এরপর থেকে প্রতিবছর নিয়মিত পালিত হয়ে আসছে দিবসটি।

 

ক্যান্সার সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি এবং এই ঘাতক ব্যাধির প্রতিকারে ব্যবস্থা নিতে রাষ্ট্র, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিপর্যায়ে তাগিদ সৃষ্টি করতে বাংলাদেশেও দিবসটি পালিত হয়ে আসছে নানা আয়োজনে। এ বছর ক্যান্সার দিবসের প্রতিপাদ্য হচ্ছে ‘ক্যান্সার পরিচর্যায় বৈষম্য দূর করি’। ২০২২ সাল থেকে তিন বছরের জন্য এই প্রতিপাদ্য গ্রহণ করা হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেবে বিশ্বে প্রতিবছর ৮২ লাখ মানুষ ক্যান্সারে মৃত্যুবরণ করে। ২০২০ সালে মারা গেছেন প্রায় এক কোটি মানুষ। পৃথিবীতে মানুষ মারা যায় যেসব রোগে ক্যান্সার রয়েছে তার মধ্যে দ্বিতীয় অবস্থানে। এ মরণব্যাধিতে আক্রান্তদের মধ্যে অধিকাংশই হচ্ছে বাংলাদেশসহ তৃতীয় বিশ্বের নাগরিক।

 

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে বর্তমানে ১২ লাখ ক্যান্সার রোগী রয়েছে। প্রতি বছর ২ লাখ মানুষ এই ব্যাধিতে আক্রান্ত হয় এবং দেড় লাখ মৃত্যুবরণ করে। সচেতনতা ও শিক্ষার অভাব এবং অর্থনৈতিক অবস্থা তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে ক্যান্সার ও এ রোগে মৃত্যুর হার বৃদ্ধির মূল কারণ। 

 

ক্যান্সার কি? 
ক্যান্সার একধরণের অসংক্রামক ব্যাধি যে রোগে মানুষের শরীরে অস্বাভাবিক এবং অনিয়ন্ত্রিত কোষ বিভাজন ও বৃদ্ধি হয়ে থাকে। আমাদের শরীরে কোষ বিভাজনের উদ্দেশ্য হলো মাতৃ কোষ থেকে নতুন কোষ সৃষ্টি করা। এর মাধ্যমে শরীরের বৃদ্ধি, ক্ষয় পূরণ ও দেহের বিভিন্ন অংগের স্বাভাবিক কার্যক্রম নিশ্চিত হয়। শরীরে একদিকে যেমন কোষ বিভাজনের ব্যবস্থা রয়েছে অন্যদিকে রয়েছে একে নিয়ন্ত্রণে রাখারও ব্যবস্থা। কোনো কারণে এই নিয়ন্ত্রণ ব্যাবস্থায় ত্রুটি দেখা দিলে শরীরে অস্বাভাবিক কোষ বিভাজন হতে থাকে। তখন শরীরে নানা ধরণের প্রতিক্রিয়া ও শারীরিক উপসর্গ দেখা দেয়। এই অবস্থাটাই হলো ক্যান্সার।

 

ক্যান্সার কি কোন একক রোগ?
অনেকেই ক্যান্সার বলতে বিশেষ একটি রোগ বলে ধরে নেন। কিন্তু ক্যান্সার কোন একক রোগ নয়। এটি সমষ্টিগত রোগের একক সাধারণ নাম। শরীরের বিভিন্ন অংগে ও বিভিন্ন কোষে  ক্যান্সার হতে পারে। একেক রকম ক্যান্সারের ধরণ, কারণ ও উপসর্গ একেক রকম। রোগ নির্ণয়ের পদ্ধতি, চিকিৎসা, রোগের ভয়াবহতা ও পরিণতিও ভিন্ন ভিন্ন। পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন রকমের ক্যান্সারের প্রকোপ দেখা যায়। বাংলাদেশে পুরুষের মধ্যে ফুসফুস, প্রস্টেট, মুখগহবর, কলোরেক্টাল, পাকস্থলী ও লিভার ক্যান্সারের হার বেশি। নারীদের মধ্যে জরায়ু মুখ, স্তন, মুখগহবর, থাইরয়েডের ক্যান্সার বেশি। ক্যান্সারের ভয়াবহতা নির্ভর করে এর ধরণ এবং কতটুকু জায়গা ছড়িয়েছে তার উপর।

 

ক্যান্সার কেন হয়? 
ক্যান্সারের সুনির্দিষ্ট কারণ খুঁজে পাওয়া যায়নি। ক্যান্সারের সুনির্দিষ্ট কোন কারণ নেই। তবে বেশ কিছু বিষয়কে ক্যান্সারের সম্ভাব্য কারণ বা ফ্যাক্টর বলে ধরে নেওয়া হয়। এগুলোকে ক্যান্সারের উদ্দীপকও বলা হয়। মেডিকেলের পরিভাষায় ক্যান্সারের উদ্দীপককে বলে কারসিনোজেন। নিচে কিছু ক্যান্সারের উদ্দীপকের কথা উল্লেখ করা হলো।

-রেডিয়েশন ও আল্ট্রাভায়োলেট রে।
-কৃত্রিম রঙ, কারখানার রাসয়নিক বর্জ্য, বেনজিন জাতীয় রাসায়নিক পদার্থ, এসবেস্টস, কীটনাশক, বায়ুদুষণ।
-আফ্লাটক্সিন
-কিছু ক্ষেত্রে জীবাণু যেমন হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস, হার্পিস ভাইরাস, এইচ আইভি, এইচ পাইলরি ইত্যাদি।
-তামাক, এলকোহল।
-ভেজাল খাবার ও খাবারের প্রিজারভেটিভ।
-উচ্চ ক্যালরি যুক্ত, অস্বাস্থ্যকার, ট্রান্সফ্যাট যুক্ত (যেমন ফাস্টফুড) খাবার।
-অতিরিক্ত ওজন।
-নিষ্ক্রিয় জীবন যাপন।

ক্যান্সারের লক্ষণ কি? 
যেহেতু ক্যান্সার কোন একক রোগ নয় তাই এর লক্ষণও বিভিন্ন ক্যান্সার ভেদে ভিন্ন ভিন্ন। তবে সামষ্টিকভাবে কিছু লক্ষণকে ক্যান্সারের সাধারণ বিপদ সংকেত হিসেবে ধরে নেওয়া হয়। সেগুলো হলো :
-হঠাৎ শরীরের ওজন কমতে শুরু করেছে কিন্তু তার তেমন কোন ব্যাখ্যা নেই।
-রক্তস্বল্পতা ও ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া।
-অস্বাভাবিক দুর্বলতা।
-মল-মূত্র ত্যাগের অভ্যাসে পরিবর্তন হওয়া। যেমন কিছুদিন ডায়রিয়া আবার কিছুদিন কোষ্ঠকাঠিন্য।
-বেশ কিছুদিন ধরে (২ সপ্তাহের বেশি) জ্বর যা এন্টিবায়োটিক বা অন্যান্য সাধারণ চিকিৎসায় সারছে না।
-খুসখুসে কাশি যা ঠিক যাচ্ছেই না।
-শরীরের কোথাও কোন পিণ্ড বা চাকার উপস্থিতি।
-ভাঙা কণ্ঠস্বর যা কোন চিকিৎসায় ভালো হচ্ছে না।
-তিল বা আঁচিলের সুস্পষ্ট পরিবর্তন।
-শরীরের কোন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ থেকে অস্বাভাবিক রক্তক্ষরণ।

উপরের এই লক্ষণগুলো দেখলে সতর্ক হতে হবে। দ্রুত চিকিৎসকের শরন নিতে হবে। প্রয়োজনীয় পরীক্ষা করে রোগের কারণ বিষয়ে নিশ্চিত হতে হবে। মনে রাখতে উপরের লক্ষণগুলো সতর্ক সংকেত মাত্র। এই লক্ষণগুলো থাকলেই ক্যান্সার হয়েছে এমনটা নিশ্চিত করে বলা যাবে না।

ক্যান্সার প্রতিরোধে করণীয় কি? 
ক্যান্সার প্রতিরোধে নিচের অভ্যাসগুলো রপ্ত করতে হবে।
-নিয়মিত ব্যায়াম ও কায়িক পরিশ্রম করা।
-পরিমিত স্বাস্থ্যকর আহার।
-নিরাপদ ও নিয়ন্ত্রিত যৌন জীবন।
-শাকসবজি, ফলমূল ও বিভিন্ন ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার পর্যাপ্ত পরিমাণে খাওয়া।
-অধিক ক্যালরি ও ফ্যাটযুক্ত খাবার পরিহার করা।
-ধূমপান,তামাক ও মদ্যপান পরিহার করা।
-নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও নিয়ম অনুযায়ী ক্যান্সার স্ক্রিনিং করা।
-হেপাটাইটিস, HPV এর ভ্যাক্সিন সময়মত নিয়ে নেওয়া।
-বিপদ সংকেত দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের কাছে যাওয়া।

ক্যান্সার চিকিৎসার চ্যালেঞ্জ?
ক্যান্সার চিকিৎসার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো সঠিক সময়ে রোগটি নির্ণয় না হওয়া। রোগ যখন বেশি দূর ছড়িয়ে পড়ে তখন এই চিকিৎসায় সফল হবার সম্ভাবনা কমে যায়। চিকিৎসা সম্পর্কে অহেতুক ভীতি ও সচেতনতার অভাবও একটি বড় সমস্যা।

 

ক্যান্সারের চিকিৎসা হলো মূলত সার্জারি, কেমোথেরাপি, ইমিউনোথেরাপি ও রেডিওথেরাপি। প্রায় সব ধরণের ক্যান্সারেই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে এই চিকিৎসাগুলোই দেওয়া হয়। কখনো যেকোন একটি, কখনো একাধিক চিকিৎসা পালা করে দেওয়া হয়। দীর্ঘ মেয়াদে চিকিৎসা করতে হয়। পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া তুলনামূলক বেশি। এর ব্যয়ও সাধারণ চিকিৎসার চেয়ে বেশি। চিকিৎসার এই উচ্চ ব্যয় ক্যান্সার চিকিৎসার অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ। সেই সাথে আছে অপচিকিৎসার দৌরাত্ম। এইসব চ্যালেঞ্জ দূর করতে হলে সরকার, বিভিন্ন সংস্থা, সংগঠন ও ব্যক্তিকে সম্মিলিতভাবে এগিয়ে আসতে হবে। ক্যান্সার ভাল হয় না এমন একটি ধারণা রয়েছে সব শ্রেণির মানুষের মধ্যে। অথচ সূচনায় ধরা পড়লে অধিকাংশ ক্যান্সার ভাল করা সম্ভব।

 

আমরা করবো জয় 
বিশ্বে প্রতিবছর ৮০ লক্ষ থেকে ১ কোটি মানুষ মারা যায় বিভিন্ন রকম ক্যান্সারে। প্রতিরোধের ব্যবস্থা না নিলে এই সংখ্যা দ্বিগুন হয়ে যাবে ২০৩০ সালের মধ্যে। প্রতিবছর সমস্ত বিশ্বে ক্যান্সারে যে পরিমাণ মানুষ মারা যায় তার এক তৃতীয়াংশ প্রতিরোধ করা সম্ভব। পৃথিবীতে তামাক না থাকলে ৭১ শতাংশ ফুসফুসের ক্যান্সার এবং ২২ শতাংশ অন্যান্য ক্যান্সার প্রতিরোধ করা সম্ভব হতো। তাই প্রতিরোধই হওয়া উচিত ক্যান্সারের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রধান পদক্ষেপ। ক্যান্সার চিকিৎসায় মনোবল ধরে রাখাটা খুব জরুরি। দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা নিতে হয় বলে অনেকে মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে। তাই ক্যান্সার রোগীকে মানসিক সহায়তা  প্রদান অত্যন্ত জরুরি। এক্ষেত্রে সামাজিক সচেতনতার বিকল্প নেই। প্রতিরোধ ও সূচনায় ক্যান্সার নির্ণয়ের ক্ষেত্রেও সামাজিক সচেতনতা জরুরি। রাষ্ট্র, সংস্থা ও ব্যক্তির উদ্যোগই পারে ক্যান্সারে সেবার বৈষম্য দূর করতে।

লেখক : রক্তরোগ বিশেষজ্ঞ, জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইন্সটিটিউট ও হাসপাতাল।    সূএ; বাংলাদেশ প্রতিদিন

Facebook Comments Box
advertisement

Posted ০৬:৩০ | শনিবার, ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

Swadhindesh -স্বাধীনদেশ |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

advertisement
advertisement
advertisement
Advisory Editor
Professor Abdul Quadir Saleh
Editor
Advocate Md Obaydul Kabir
যোগাযোগ

Bangladesh : Moghbazar, Ramna, Dhaka -1217

ফোন : Europe Office: 560 Coventry Road, Small Heath, Birmingham, B10 0UN,

E-mail: news@swadhindesh.com, swadhindesh24@gmail.com