| শুক্রবার, ১৩ জুন ২০১৪ | প্রিন্ট
আজ আরবী বছরের ১৪ শাবান। বিশ্বব্যাপী মুসলিম সম্প্রদায়ের নিকট মহিমান্বিত দিন। আরবিতে একে বলে পবিত্র লাইলাতুল বরাত বা শবে বরাত। বাংলায় যার অর্থ সৌভাগ্যের রজনী। মহান আল্লাহ তাআলা এ রাতে বান্দাদের জন্য তাঁর অশেষ রহমতের দরজা খুলে দেন। আজ দিবসের সূর্য অস্ত গেলেই এক অপার্থিব পবিত্রতায় আবৃত রজনীর আবির্ভাব ঘটবে। কাল সূর্যোদয় অবধি এ রাতের মহিমাময় ফজিলত অবিরত থাকবে। পাপ থেকে ক্ষমা প্রার্থনা করে নিষ্কৃতি লাভের পরম সৌভাগ্যের রজনী।
বিশেষ এ রাতে মহান আল্ল¬াহ সুবহানাহুওতায়ালা পরবর্তী বছরের হায়াত, মউত, রিজিক, দৌলত, আমল প্রভৃতি যাবতীয় আদেশ-নিষেধ ফয়সালা করেন। তাত্পর্যপূর্ণ এই রাতে বিশেষ বরকত হাসিলের নিয়তে মুসলমানরা রাত জেগে ইবাদত-বন্দেগি, জিকির-আসকার, মিলাদ-মাহফিল, নফল নামাজ আদায় ও কোরআন তেলাওয়াতে মশগুল থাকেন। আর পরবর্তী দিন রোজা রাখেন।
শবে বরাতকে ‘লাইলাতুল বারাআত’ নামে অভিহিত করা হয়। ‘লাইলাতু’ আরবী শব্দ, আর ‘শব’ শব্দটি ফারসী। দুইটি শব্দ-বন্ধের অর্থই হল রাত। অপরপক্ষে ‘বারাআত’ শব্দের অর্থ হল নাজাত, নিষ্কৃতি বা মুক্তি। এ রাতে বান্দারা মহান আল¬াহ তা’য়ালার নিকট থেকে মার্জনা লাভ করে থাকেন। এ কারণে এ রাতকে ‘লাইলাতুল বারাআত’ বা শবেবরাত বলা হয়। শাবান মাসের মধ্যবর্তী রাতে পবিত্র শবেবরাত পালিত হয়। এ ব্যাপারে কুরআন শরিফে সুস্পষ্টভাবে উল্লে¬খ না থাকলেও হাদীস শরীফে এটাকে ‘লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান’ বা মধ্য শাবানের রাত্রি নামে অভিহিত করা হয়েছে। আর পক্ষকাল পরেই আসবে মাহে রমজান। লাইলাতুল বারায়াত মাসব্যাপী সেই প্রশিক্ষণের পূর্বপ্রস্তুতিস্বরূপ। এজন্য একে বলা হয় রমজানের মুয়াজ্জিন বা পতাকাবাহী।
বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও ভারতে এ রাতটি শবেবরাত হিসাবে অধিক পরিচিত। ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রকাশিত ‘ইসলামী বিশ্বকোষ’ গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে যে, ‘ইরান ও ভারতীয় উপমহাদেশে এ মাসের একটি রজনীকে ‘শব-ই-বরাত’ বলা হয়। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কোন কোন দেশের কোন কোন অঞ্চলে শবেবরাত ভিন্ন নামে পরিচিত। আরব বিশ্বের মানুষ এ রাতকে ‘লাইলাতুন নিসফে মিন শাবান’ বলেন।
সূর্য অস্তমিত হওয়ার পরক্ষণ থেকে আল্ল¬াহ রাব্বুল আলামিনের নূরের তাজাল্লি¬ পৃথিবীর কাছাকাছি আসমানে প্রকাশ পায়। তখন আল্ল¬াহপাক বলতে থাকেন, আছে কি কেউ ক্ষমাপ্রার্থী, যাকে আমি ক্ষমা করবো, আছে কি কেউ রিজিকপ্রার্থী, যাকে আমি রিজিক প্রদান করব? আছে কি কেউ বিপদগ্রস্ত যাকে আমি বিপদমুক্ত করব? আল্ল¬াহপাকের মহান দরবার থেকে প্রদত্ত এ আহ্বান অব্যাহত থাকে ফজর পর্যন্ত। বস্তুত শবেবরাত হলো আল্ল¬াহপাকের মহান দরবারে ক্ষমা প্রার্থনার বিশেষ সময়। আল্ল¬াহপাকের নৈকট্য লাভের এক দুর্লভ সুযোগ এনে দেয় শবেবরাত।
অতএব প্রতিটি কল্যাণকামী মানুষের প্রধানতম কর্তব্য হলো এ সুযোগের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করা। আল্ল¬াহপাকের ইবাদত-বন্দেগিতে পূর্ণ রাত অতিবাহিত করা। সাধ্যমত দান-খয়রাত করা। হযরত আয়েশা (রা.) বলেন, একবার রাসুলুল্লাহ (দঃ) রাতে নামাজে দাঁড়ান এবং এত দীর্ঘ সেজদা করেন যে, আমার ধারণা হল তিনি হয়ত মৃত্যুবরণ করেছেন। আমি তখন উঠে তার বৃদ্ধাঙ্গুলি নাড়া দিলাম। তার বৃদ্ধাঙ্গুলি নড়লো। যখন তিনি সেজদা থেকে উঠলেন এবং নামাজ শেষ করলেন তখন আমাকে লক্ষ্য করে বললেন, হে আয়েশা তোমার কি এই আশংকা হয়েছে যে, আল্লাহর রাসুল তোমার হক নষ্ট করবেন? আমি উত্তরে বললাম, না, ইয়া রাসূলুল্লাহ। আপনার দীর্ঘ সেজদা থেকে আমার এই আশংকা হয়েছিল, আপনি মৃত্যুবরণ করেছেন কিনা।
নবীজী জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি জান এটা কোন্ রাত? আমি বললাম, আল্ল¬াহ ও তার রাসুলই ভাল জানেন। রাসুলুল্ল¬াহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম তখন ইরশাদ করলেন, ‘এটা হল অর্ধ শাবানের রাত (শাবানের চৌদ্দ তারিখের দিবাগত রাত)। আল্ল¬াহ তাআলা অর্ধ-শাবানের রাতে তার বান্দার প্রতি মনোযোগ দেন এবং ক্ষমা প্রার্থনাকারীদের ক্ষমা করেন এবং অনুগ্রহ প্রার্থীদের অনুগ্রহ করেন আর বিদ্বেষ পোষণকারীদের ছেড়ে দেন তাদের অবস্থাতেই।’ [শুআবুল ঈমান, বাইহাকী ৩/৩৮২-৩৬৮] হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ¬ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম বলেছেন, পনের শাবানের রাত (চৌদ্দ তারিখ দিবাগত রাত) যখন আসে তখন তোমরা এ রাতটি ইবাদত-বন্দেগীতে কাটাও এবং দিনের বেলা রোজা রাখ। কেননা এ রাতে সূর্যাস্তের পর আল্ল¬াহতাআলা প্রথম আসমানে আসেন এবং বলেন, কোন ক্ষমাপ্রার্থী আছে কি? আমি তাকে ক্ষমা করবো। আছে কি কোন রিজিক প্রার্থী? আমি তাকে রিজিক দেব। এভাবে সুবেহ সাদিক পর্যন্ত আল্ল¬াহ তাআলা মানুষের প্রয়োজনের কথা বলে তাদের ডাকতে থাকেন। [সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ১৩৮৪] এই বর্ণনাটির সনদ যয়ীফ। এরূপ ঘোষণার সময় যদি কোন বান্দা হাত তুলে মুনাজাত করে, তবে আল্ল¬াহপাক তার মুনাজাত কবুল করে নেন। মুহাম্মাদ ইবনে আলী (রা.) বর্ণনা করেছেন, এই রাত শবে কদরের পর সর্বোত্তম রাত। এই রাতে আল্ল¬াহ তাঁর বান্দাদেরকে নিজ করুণায় ক্ষমা করেন।
সারাদেশে যথাযথ মর্যাদায় ধর্মীয় ভাবগম্ভীর পরিবেশে আজ পবিত্র শবেবরাত উদযাপিত হবে। এ উপলক্ষে রাজধানীসহ দেশের প্রতিটি মসজিদে ওয়াজ মাহফিল, জিকির-আজকারের আয়োজন করা হয়েছে। বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগঠন আলোচনা এবং মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করেছে। ইসলামিক ফাউন্ডেশন বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদে আজ রাতভর ওয়াজ মাহফিল, জিকির-আজকারের ব্যবস্থা করেছে। ফজরের নামাজ শেষে ভোরে মোনাজাত পরিচালনা করা হবে। এ রাতের তাত্পর্য তুলে ধরে রেডিও-টেলিভিশনে বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচার করা হবে। সংবাদপত্র প্রকাশ করবে বিশেষ ক্রোড়পত্র।
আমরা অবশ্যই পবিত্র শবেবরাতের বা নিসফে-শাবানের ফযীলত ও ক্ষমা প্রার্থনা করবো। তবে সাথে সাথে আমাদের চেষ্টা করতে হবে শিরক ও বিদ্বেষ থেকে মুক্ত থাকার। কারণ শবেবরাতের শিক্ষা এটাই। আর শবেবরাত উপলক্ষে যারা আলোকসজ্জা, আতসবাজি ও পটকাবাজি চর্চা করেন তারা খুবই ভুল কাজ করেন। কারণ এসব শবে বরাতের আদর্শ ও শিক্ষার পরিপন্থী কাজ। তাই এইসব কাজ থেকে দূরে থাকাই সমীচীন। আল্লাহ আমাদের সকলকে পবিএ এই রজনীর ফজিলত ও বরকত দান করুন।
Posted ০৭:৩১ | শুক্রবার, ১৩ জুন ২০১৪
Swadhindesh -স্বাধীনদেশ | admin