ঢাকা: ‘বঙ্গবন্ধু ঢাকায় সংসদ বন্ধের ঘোষণা দিলেন। খবর শুনে আমরা মিছিলের প্রস্তুতি নিলাম। তখন থাকি মালিবাগে। সেখান থেকে মিছিল নিয়ে আসি। ওইদিন ২ মার্চ আবুজর গিফারি কলেজের ভিপি ফারুককে হত্যা করা হয়। তার লাশও আনা হয় বায়তুল মোকারমের দক্ষিণ গেটে। সেখানে একটি টিনের ঘর ছিল। সেখানে অস্থায়ী মঞ্চে ফারুক ভাইয়ের লাশের সামনে শপথ হয়। শেখ মজিবুর রহমান ফারুক ভাইয়ের লাশ ছুঁয়ে কসম দিয়ে বলেন, এ সংসদ আর চলবে না। আমরা আতঙ্কিত হলাম, এটি কীভাবে সম্ভব। তখন আমরাও শপথ নিলাম। পরে বঙ্গবন্ধুর আর সংসদ যাওয়া হয়নি। তিনি শপথ বাস্তবায়ন করতে পেরেছেন।’
মূলত সেই দিন থেকেই দেশকে শত্রু মুক্ত করতে দেশ রক্ষার যুদ্ধ শুরু করেন এক কিশোর মুক্তিযোদ্ধা। তার নাম আওলাদ হোসেন। এখন বয়স ৫৯। মাত্র ১৬ বছর বয়সে দেশ রক্ষার আন্দোলনে যোগ দেন। বিনিয়োগ বোর্ডের সহকারী বিনিয়োগ বিভাগের কর্মকর্তা তিনি। বিজয়ের এ মাস উপলক্ষে আমাদের সঙ্গে তিনি কথা বলেছেন। আলাপচারিতায় তিনি যুদ্ধের সময় তাদের প্রেরণা, যুদ্ধ কৌশল, অনাহারের দিন, সম্মুখ যুদ্ধসহ যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে নিজের অবস্থার বর্ণনা করেছেন। আমাদের পক্ষ থেকে এ বীর সেনানীর কিছু কথা তুলে ধরা হলো।
২ মার্চ ভোরের দিকে ফারুক ভাইকে রামপুরা রেডিও অফিসের সামনে হত্যা করে পাকিস্তানিরা। তার কবর মৌচাক চত্বরে। সেখানে তসলিম ভাইয়েরও কবর রয়েছে। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিকেলে বাড়ি ফেরার পথে তাকে হত্যা করে পাকিস্তানিরা। তিনিও ওই চত্বরে ঘুমিয়ে আছেন। এর পরে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে (রেসকোর্স ময়দান) ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ডাক দেন। আমরাও তার ঘোষণায় প্রস্তুতি নিই। তার ঘোষণার পর থেকে পাকিস্তানি ও তাদের সহযোগীরা সারাদেশে আওয়ামী লীগ সমর্থক ও কর্মীদের ওপর নির্যাতন শুরু করে দেয়। অনেককে হত্যা করে। ঢাকা, রংপুর, খুলনা, রাজশাহী, চট্টগ্রামে হত্যাকাণ্ড চালায়। অনেক সময় তারা স্বাধীনতা প্রত্যাশীদের বাড়িতে আগুন দিয়ে আতঙ্ক ছড়ায়।
২৫ মার্চ রাতের আঁধারে পাকিস্তানি হায়েনারা আমাদের ঘুমন্ত পুলিশের ওপর হামলা করে। তখন আমি মালিবাগে থাকি। তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতেও গণহত্যা চালায়। এরপরে আর ঘরে থাকা সম্ভব হয়নি। রাজাকাররা আমাদের তালিকা তৈরি করে পাকিস্তানিদের হাতে তুলে দেয়। তখন থেকে আমি পলাতক। দুই মাস ঢাকা ও তার পাশের জেলাগুলোতে আত্মগোপনে ছিলাম।
মে মাসের প্রথম দিকে আমি (আওলাদ) লোকাল ট্রেনিং নিয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করি। ২ নং সেক্টরে খালেদ মোশারফের সেক্টরে যোগ দিই। আমার এরিয়া কমান্ডার ছিলেন ক্যাপ্টেন হারুন চৌধুরী।
আমাদের শপথ ছিল ‘একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি’। বঙ্গবন্ধুকে বাঁচানোর যুদ্ধ করি। এর পর বাকি ৭ মাস যুদ্ধে ছিলাম। একবার ঢাকায় আসি নানার বাসায়। ফেরার পথে নানী আমাকে পান কিনে দিতে বলেন। আমি বাজারে যাই নানীর পান কেনার জন্য। এ সময় তারা আমাকে (পাকিস্তানি মিলিটারি) আটক করে ট্রাকে তোলে। ট্রাকে আরো কয়েকজন (১৫ থেকে ২০) ছিল। সবার হাত বাঁধা। আমারও বাঁধা হয়। তারা আমাকে জিজ্ঞেস করে (তোম কন হে) তুই কে? (তোম মুক্তিহো) তুমি মুক্তি! আমি বললাম না। তখন তারা আমার দু’হাতের কুনই পরীক্ষা করে বলে এ খাতারনা লাড়কা হে! ও মুক্তি হে। আমি বলাম আবার দাবি করলাম আমি মুক্তি না। আমি নানুর বাসায় থাকি। ফুটবল খেলার গোল রক্ষক। তাই হাতে দাগ পড়েছে। মিলিটারিরা আমাকে জিজ্ঞেস করলো। তোকে কেউ চেনে। আমি পরিচিত দোকান দেখিয়ে ট্রাক থেকে লাফ দিই। তখন এক পাকিস্তানি আমাকে রাইফেল দিয়ে আঘাত করে। আমি দৌড়ে ওই দোকানে যাই। দোকানী আমাকে ছাত্র বলে পরিচয় দেয় এবং পাকিদের জানায় আমি একটি দোকানে টাইপ রাইটারের কাজ করি। এরপর তারা আমাকে ছেড়ে দেয়। পরে খোঁজ নিয়ে জেনেছি ওই ট্রাকে যারা ছিলেন সবাইকে মেরে ফেলা হয়েছে।
যুদ্ধের সময় আওলাদ সাহেবদের সহযোগিতা করতো স্কুলের ছোট ছোট ছাত্ররা। সেই স্মৃতি তুলে তিনি বলেন, ‘মুক্তিবাহিনী ও রাজাকারদের খবর আমাদের পৌঁছাতো কয়েকটি ছোট্ট বাচ্চা। চারটি বাচ্চা রাতের বেলায় আমাদের খবর দিয়ে যেত। তাদের খবরের ভিত্তিতে আমরা স্থান ত্যাগ বা যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতাম।
সম্মুখ যুদ্ধের বিষয়ে তিনি বলেন, যুদ্ধের সময় দোহার থানার সুতার পাড়া মোল্লা বাড়িতে ছিলাম। সেখান থেকে যুদ্ধ করি। আমাদের নেতৃত্বে ছিলেন, ক্যাপ্টেন হারুন চৌধুরী। কোম্পানি কমান্ডার ছিলেন। বায়েজিদসহ আমরা ২৭ জন এ যুদ্ধে অংশ নিই। ৭১ সালের কার্তিক মাসের দিকে আমরা সরাসরি পাকিস্তানী হায়েনাদের সঙ্গে যুদ্ধ করি। আমরা পানি থেকে তারা উপরে থেকে যুদ্ধ চালায়। আগের দিন সন্ধ্যা থেকে পরের দিন দুপুর পর্যন্ত টানা যুদ্ধ চলে, ওই সময় আমরা পানিতেই ছিলাম। এতে আমাদের কোনো সৈনিকই শহীদ হয়নি। তারা অনেকে মারা গেছে এবং পোশাক খুলে পালিয়েছে। আর কখনো ওই এলাকায় আসেনি। মূলত সেই দিন থেকে ওই এলাকা রাজাকার ও পাকিস্তানি সেনামুক্ত ছিল।
এরপর লৌহজং থানার গোরালি মান্দ্রায় পাক বাহিনীর সঙ্গে একটি যুদ্ধ হয়। ওই যুদ্ধে আমি অংশগ্রহণ করতে পরিনি। যুদ্ধে আমাদের ৬৭ জন বীর মুক্তিসেনা শহীন হন। তবে সে যুদ্ধেও মুক্তিসেনার জয়ী হয়।
যুদ্ধ চলার সময়ে আমাদের খাবারের ব্যবস্থা করতেন পাশের এলাকার মুক্তিযুদ্ধের সমর্থকরা। কার্তিক মাসের যুদ্ধের সময় সারারাত কিছু খাই নাই। অনেকটা ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। সকাল শেষ হয়ে দুপুরের দিকে যাচ্ছে সময়। এমন সময় একজন বুড়ি, (নাম মনে নাই) একটা পাতিলে অনেকগুলো পান্তাভাত আর পিঁয়াজ, কাঁচামরি নিয়ে আসেন। ওনাকে আমি প্রথম দেখতে পাই। সঙ্গে সঙ্গে কমান্ডার বায়েজিদকে দেখাই। বায়েজিদ সাহেব আমাকে বলেন, বুড়ির কি মরার সখ হয়েছে নাকি। ওকে থামাও। কয়েকজন তার কাছে গেলে তিনি তাদের খাবার দিয়ে অপেক্ষা করতে থাকেন। খাবার শেষ হলে তিনি বাটি নিয়ে চলে যান। এরপর ওই নারীকে আর দেখিনি। তিনি কে ছিলেন তাও জানি না। তবে ওই পান্তা ভাত যে এত মধুর ও তৃপ্তির ছিল তা আজও ভুলতে পারিনি।
রাজাকার বা পাকিস্তানি সহযোগীদের প্রসঙ্গে আওলাদ সাহেব বলেন, ‘তারা সব সময় মুক্তিযোদ্ধাদের খোঁজ খবরে ব্যস্ত থাকতো। আওয়ামী লীগ সমর্থকদের বাড়িতে আগুন দিয়ে এলাকায় আতঙ্ক সৃষ্টি করতো। টাকা পয়সা লুট করতো। মা বোনদের পাকিস্তানিদের হাতে তুলে দিতো।
দেশ স্বাধীন হওয়ার অনুভুতি প্রকাশ করে তিন বলেন, আমরা তো কখনো চিন্তাও করিনি যে এত দ্রুত পাকিস্তানিদের তাড়াতে পারবো। আর তা সম্ভব হয়েছে আমাদের (মুক্তিযোদ্ধাদের) মনবলের জন্য। আমাদের সাহসের জন্য। সে সময় মুক্তিযোদ্ধার নেতা বা কমন্ডারের আনুগত ছিল বলেই আমরা স্বাধীন হতে পেরেছি।
১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আমরা লাল সবুজের পতাকা উড়িয়ে আনন্দ মিছিল করতে লাগলাম। আর বাংলার বাতাস আমাদের সঙ্গে বন্ধু হয়ে লাল সবুজের পতাকা উড়তে সহযোগিতা করলো। মায়াভরা মাঠভরা সবুজের ঢেউ বিশ্বের দরবারে পৌছে দিল, আমরা স্বাধীন।
স্বাধীন বাংলায় আওলাদ সাহেব এখনও আছেন। কিন্তু তিনি যে কারণে যুদ্ধ করেছেন তা এখনো তিনি পাননি বলে আক্ষেপ করেন। তিনি বলেন, ‘যুদ্ধ করেছি। আমরা মুক্তিযোদ্ধারা ভাই হারিয়েছি। মা বোন আত্মীয় হারিয়েছি। অনেক কিছু হারিয়েছি। কিন্তু কী পেলাম। স্বাধীনতা পেলাম এটি আমাদের মহাসফলতা। কিন্তু আজো সেই ঘাতকদের বিচার পেলাম না। আজো জনগণের অধিকার পেলাম না। শোষণমুক্ত সমাজ পেলাম না। নাগরিক অধিকার পেলাম না।
Like this:
Like Loading...
Related