নিজস্ব প্রতিবেদক | শুক্রবার, ০৭ জুলাই ২০২৩ | প্রিন্ট
আজ ৭ জুলাই, শোলাকিয়া জঙ্গি হামলার সাত বছর। ২০১৬ সালের ৭ জুলাই। দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার। ঈদুল ফিতরের দিন। সময় সকাল পৌনে ৯টা। কিশোরগঞ্জ শহরের প্রতিটি রাস্তা, অলিগলিতে জনস্রোত। সবাই শোলাকিয়ার দিকে যাচ্ছিল। ১০টায় শুরু হবে ঈদজামাত। মাঠে চলছে সহকারী ইমামের বয়ান। এর মধ্যেই হঠাৎ বিস্ফোরণের শব্দ। এ ঘটনা ঈদগাহ থেকে ২০০ গজ দূরে আজিমউদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ের পাশে। ঈদগাহমুখী জনস্রোতের সামনেই চেকপোস্টে বাধা পেয়ে পুলিশের টহল চৌকি লক্ষ্য করে বোমার বিস্ফোরণ ঘটায় জঙ্গিরা। জঙ্গি হামলার সেই দুঃসহ স্মৃতি আজও ভুলতে পারেনি স্থানীয়রা। মনে পড়লে আঁতকে ওঠে তারা।
ভয়াবহ সেই বোমা হামলায় নিহত হন দুই পুলিশ কনস্টেবল। এ সময় একটি গুলি পাশের বাড়ির জানালা ভেদ করে গৃহবধূ ঝর্ণা রানী ভৌমিককে বিদ্ধ করে। এতে ঘটনাস্থলেই তিনি মারা যান। রাজধানীর গুলশানের হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলার ছয়দিন পর শোলাকিয়ায় এ ঘটনা ঘটে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সবুজবাগ গলির মাথায় মুফতি মোহাম্মদ আলী মসজিদের সামনে টহলরত ছিলেন ১০-১২ জন পুলিশ সদস্য। সেখান দিয়ে জঙ্গিরা ভেতরে ঢোকার সময় তাদের ব্যাগ তল্লাশি করতে যায় পুলিশ। এর মধ্যেই হাতবোমা ছুড়ে মারা হয় পুলিশকে লক্ষ্য করে। বোমার বিস্ফোরণে কয়েকজন পুলিশ সদস্য মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। আক্রান্ত অন্য পুলিশ সদস্যরা আত্মরক্ষার্থে পিছু হটেন। চেকপোস্ট আক্রান্ত হওয়ার খবরে অন্য পুলিশ সদস্যরা ঘটনাস্থলে গিয়ে জঙ্গিদের ধরতে অভিযানে নামেন। এ সময় জঙ্গিরা পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ শুরু করে। পুলিশও পাল্টা গুলি ছোড়ে। চেকপোস্ট দিয়ে ঈদগাহমুখী মুসল্লিরা তখন আত্মরক্ষার্থে দিগ্বিদিক ছুটতে থাকেন।
জঙ্গি হামলার পুরো বিষয়টি পাঁচতলার বাসা থেকে প্রত্যক্ষ করেন সবুজবাগ এলাকার বাসিন্দা হাফিজুর রহমান রেনু। তিনি জানান, ঘুম থেকে উঠে জামাতে যেতে গোসলের প্রস্তুতি নেন তিনি। এমন সময়ই বোমার বিস্ফোরণ। ঘটনার বিবরণ এবং জঙ্গিদের অবস্থান জানিয়ে তিনি সদর থানার ওসিসহ জেলা পুলিশের ঊর্ধ্বতন একাধিক কর্মকর্তাকে ফোনে অবহিত করেন। এরপরই পুলিশ জঙ্গিদের ধরতে অভিযান শুরু করে। পুলিশের সঙ্গে জঙ্গিদের গোলাগুলিতে তখন কান ঝালাপালা অবস্থা। জঙ্গিরা ঢুকে পড়ে রেনুর বাসার সামনে সবুজবাগ গলিতে। ভয়ে বাসার সবাই দরজা-জানালা বন্ধ করে মেঝেতে শুয়ে পড়েন। নিচের গেট লাগিয়ে দেওয়া হয়। তিনি চারতলায় গিয়ে জানালার পাশে অবস্থান নেন। পাশের বাসার বাইরে ঘুপচিতে দুই জঙ্গি অবস্থান নেয়। তাদের ধরতেই গুলিবিনিময়।
রেনু জানান, পুলিশ গুলি ছুড়তে ছুড়তে যখন ঘুপচির দিকে এগিয়ে যায়, তখন এক হামলাকারী পুলিশকে লক্ষ্য করে হাতবোমা নিক্ষেপ করে। ঘুপচির ওপাশে দেয়াল দিয়ে বন্ধ থাকায় দুই হামলাকারী আটকা পড়ে। এক হামলাকারী এ সময় হাতে থাকা চাপাতি ঘোরাতে ঘোরাাতে পুলিশকে আক্রমণ করতে আসে। একপর্যায়ে সে সময়ের কিশোরগঞ্জ সদর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মোহাম্মদ মুর্শেদ জামানসহ (বর্তমানে অষ্টগ্রাম থানার ওসি) কয়েকজন পুলিশ সদস্য একের পর এক গুলি করে চাপাতি হাতে থাকা জঙ্গিকে মাটিতে ফেলে দেন। সবুজবাগ গলি থেকে পুলিশের ওপর জঙ্গিরা গুলি ছুড়ছে। নিক্ষেপ করছে হাতবোমা। বিপরীত দিক থেকে পুলিশও পাল্টা গুলি ছুড়ছে। এ সময় একটি গুলি ঝর্ণা রানী ভৌমিকের মাথায় গিয়ে লাগে। সঙ্গে সঙ্গে তিনি মেঝেতে লুটিয়ে পড়েন এবং মারা যান। জঙ্গি হামলায় আহতদের কিশোরগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথে কনস্টেবল জহিরুল ইসলাম তপু আর কনস্টেবল আনসারুল হক ময়মনসিংহ সিএমএইচে ওইদিন দুপুরে মারা যান।
মামলার তদন্তে শোলাকিয়া জঙ্গি হামলায় ২৪ জঙ্গির সংশ্লিষ্টতা পায় পুলিশ। ঘটনার পর দেশের বিভিন্ন স্থানে পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে মারা যায় শীর্ষ পাঁচ জঙ্গিসহ ১৯ জন। ২০১৮ সালের ১২ সেপ্টেম্বর পাঁচ জঙ্গিকে আসামি করে আদালতে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। চার্জশিটভুক্ত আসামিরা হচ্ছে জেএমবির শীর্ষ নেতা মিজানুর রহমান ওরফে বড় মিজান, মো. আনোয়ার হোসেন, সোহেল মাহমুদ, রাজীব গান্ধী ও জাহিদুল হক তানিম। বর্তমানে তারা দেশের বিভিন্ন কারাগারে বন্দি।
জানা গেছে, ঘটনাস্থল সবুজবাগ গলির নাম এখন ‘ঝর্ণা রানী ভৌমিক সড়ক’। যদিও পৌরসভার সংস্কারকাজ করতে গিয়ে নামফলকটি সরিয়ে রাখার পর আর প্রতিস্থাপন করা হয়নি। গলির ভেতরে বিভিন্ন বাসার দেয়ালে এখনও গুলির চিহ্ন। এসব এখনও মোছেনি। সাত বছরেও এলাকাবাসী ভুলতে পারেননি সেই দুঃসহ স্মৃতি। সেই ভৌমিক নিবাসে আজও শোকের আবহ। যে জানালাটা ভেদ করে গুলি ভেতরে গিয়ে ঝর্ণা রানী মারা যান, জানালাটার পাশে স্মৃতি হিসেবে টানানো আছে ঝর্ণার ছবি। ঝর্ণা রানীর স্বামী গৌরাঙ্গ ভৌমিক জানান, ছোট ছেলে শুভদেব মায়ের ছবি নিয়ে আজও কাঁদে। বাইরে কোনো কিছুর শব্দ হলেই ভয়ে আঁতকে ওঠে সে। রাতে ‘মা’ ‘মা’ করে চিৎকার করে প্রায়ই ঘুম থেকে জেগে ওঠে। ঘুমানোর আগে দরজা-জানালা ভালো করে বন্ধ করতে বলে তাকে। শুধু ঝর্ণা রানী ভৌমিকের পরিবারের সদস্যরা নয়, সেই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীরা এখনও ভুলতে পারেননি সেদিনের দুঃসহ স্মৃতি। তাদের ভাষ্য, এখনও সেদিনের কথা মনে হলে তারা আঁতকে ওঠেন।
কিশোরগঞ্জের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ রাসেল শেখ বলেন, শোলাকিয়ায় জঙ্গি হামলায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যাপক তৎপরতায় জঙ্গিদের মনোবল ভেঙে যায়। তারা বিচ্ছন্ন হয়ে পড়ে।
কিশোরগঞ্জ আদালতের সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) অ্যাডভোকেট আবু নাসের মো. ফারুক সঞ্জু বলেন, জঙ্গি হামলার ঘটনায় সন্ত্রাস দমন আইনে মামলা হয়। বর্তমানে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল সন্ত্রাস দমন ট্রাইব্যুনাল-২ আদালতে পাঁচজন আসামির বিচার চলছে। ৬ জুন সাক্ষ্যগ্রহণের তারিখ ছিল। সেদিন মামলার বাদীসহ মোট ১৭ জন সাক্ষী উপস্থিত ছিলেন। ঢাকার হলি আর্টিসান মামলায় তিনজন আসামির মৃত্যুদণ্ড সাজা হওয়ায় এ মামলার বিচারকার্য বিলম্বিত হচ্ছে।
পিপি আবু নাসের আরও বলেন, আসামিদের মধ্যে মিজান ওরফে বড় মিজান, জাহাঙ্গীর, জাহেদুল ও আনোয়ারকে আদালতে উপস্থিত করা হয়। তবে মো. সবুর খান হাসান ওরফে সোহেল আরেক জঙ্গি মামলায় রাজশাহী কারাগারে থাকায় আদালতে হাজির হতে পারেননি। ২৫ জুলাই আবারও সাক্ষ্যগ্রহণের দিন ধার্য করা হয়েছে। আশা করছি আদালতে সাক্ষ্যগ্রহণের পর আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত হবে।
এ ধরনের নৃশংস ও বর্বরোচিত ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি কিশোরগঞ্জবাসীর।
এ ঘটনায় নিহত দুই পুলিশ সদস্যের পরিবারকে আর্থিক ক্ষতিপূরণ প্রদানের পাশাপাশি সার্বিক সহযোগিতা এবং নিহত গৃহবধূর সন্তানকে ব্যাংকে চাকরি দিয়ে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছে সরকার।
আজ শুক্রবার জঙ্গি হামলা নিহত দুই পুলিশ সদস্যের স্মৃতিস্তম্ভে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করবেন পুলিশ সুপারসহ ঊধ্বর্তন পুলিশ কর্মকর্তা ও সদস্যরা। এ ছাড়া জেলা প্রশাসকসহ প্রশাসনের ঊধ্বর্তন কর্মকতাসহ নানা শ্রেণিপেশার মানুষ শ্রদ্ধা নিবেদন করবেন। দুপুরে দোয়া মাহফিল হবে। এতে সর্বস্তরের মানুষ অংশ নেবে। ঝর্ণা রানী ভৌমিকের পরিবার পৃথকভাবে একাধিক কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। এসব কর্মসূচিতে সবাইকে উপস্থিত থাকার জন্য পরিবারের পক্ষ থেকে অনুরোধ জানানো হয়েছে। সূএ : বিডি২৪লাইভ ডট কম
Posted ০৮:১০ | শুক্রবার, ০৭ জুলাই ২০২৩
Swadhindesh -স্বাধীনদেশ | Athar Hossain