শুক্রবার ১৯শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ৬ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

মোবাইল ফোনের অপব্যবহার শুরু মিথ্যা দিয়ে

  |   রবিবার, ০৮ এপ্রিল ২০১৮ | প্রিন্ট

মোবাইল ফোনের অপব্যবহার শুরু মিথ্যা দিয়ে

ডেস্ক রিপোর্ট: দিশারী পরিবহন। চিড়িয়াখানা থেকে কদমতলী রুটের বাস। মিরপুর-১ নম্বর থেকে এক তরুণের যাত্রা। গন্তব্য শাহবাগ। বাসটি শ্যামলী যেতেই তরুণের মোবাইল ফোনে রিং বেজে ওঠে। ফোন রিসিভ করেই ওই তরুণ বলে উঠেন আমি ফার্মগেট।

পাশের যাত্রী তার দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। এরপরে আবার স্বাভাবিক সবাই। কিছুক্ষণ পর আবার রিং। ততক্ষণে বাসটি খামারবাড়ি সিগন্যালে আটকে আছে। এবার ছেলেটি মোবাইল রিসিভ করে বলে আমি বাংলামোটর। আর মাত্র পাঁচ মিনিট লাগবে আসতে। একটু অপেক্ষা করো। কিন্তু বাসটি ওই একই সিগন্যালে পার করলো আরো ৩৫ মিনিট। এবার তার ফোন বেজে উঠলেও রিসিভ করেননি। পরপর দুই তিনবার রিং হওয়ার পরে ফোন ধরলেন। আর বললেন, ‘বাবু সরি, আমি বাংলামোটর জ্যামে আটকে আছি। কি করবো বলো’। তখনো তিনি খামারবাড়ি জ্যামে আটকা। পাশের যাত্রী কৌতূহল মনে জানতে চাইলো, ভাই আপনি তো খামারবাড়ি। কেন বাংলামোটর বলছেন বারবার। তরুণের উত্তর- ভাই কি করবো বলেন, আমার গার্লফ্রেন্ড এক ঘণ্টা ধরে অপেক্ষা করছে। আর আমি জ্যামে আটকে আছি। ওর মন তো রক্ষা করতে পারবো না। আপনি কি বারবার মিথ্যা বলছেন না জানতে চাইলে তরুণ বলেন, মিথ্যা আর কি? আমি তো যাচ্ছি। কিন্তু পথ একটু বাড়িয়ে বলছি এই আর কি। এটা কি মিথ্যা বলা হচ্ছে। আমি তার মন রক্ষা করতে এটা বলেছি।

মোবাইল ফোন কিংবা মুঠোফোন। যন্ত্রের সহজলভ্যতায় মানুষ দিব্যি কাছাকাছি বাস করে। এক নিমিষেই তারা হয়ে যায় পরস্পরের। কিন্তু মোবাইল ফোন মানুষকে কাছে নিয়েছে ঠিক কিন্তু শিখাচ্ছে অপব্যবহারও। অনেকেই জানে না কিংবা জানতে চায় না সে কীভাবে মিথ্যার অনুশীলন করছেন মোবাইলের মাধ্যমে। জড়িয়ে পড়ছে নানা অপরাধে। ভেঙে যাচ্ছে সুখের সংসার কিংবা শখের চাকরি। চার পাশে হরহামেশাই বিব্রতকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয় অনেককে। দেখা যায় ওই ব্যক্তি তার মোবাইলের বিপরীতের পাশের মানুষকে মিথ্যা কথার ফুলঝুরি ছাড়ছে। তার সম্পর্কে চাপাবাজি করতে থাকে। তার যা নেই তাই বলে বেড়ায়। কারণ তার বিপরীত পাশের লোক তো তাকে দেখতে পাচ্ছেন না। আবার বিত্তবান থেকে নিম্ন শ্রেণির সন্তানরা বিভিন্ন অপকর্মে জড়ানোর প্রাথমিক দাপটটা শুরু করেন মোবাইল ফোনে মিথ্যা কথা বলার মাধ্যমেই।

মো. জাবের হোসেন। পাওনাদারদের তাগাদায় মাথা গুঁজে থাকেন প্রায়। তার ফোন বন্ধও রাখেন অনেক সময়। ছুটির দিনে মোবাইল ফোন খোলা রাখলেও ধরিয়ে দেন সন্তানদের কিংবা বউকে। তাকে কেউ ফোনে পায় না। এর বাইরে মাঝেমধ্যে ফোন যখন ওপেন করেন তখনই পাওনাদারদের কল। হুট করে তিনি তার সাত বছরের মেয়েকে ফোন ধরিয়ে বলতে বলেন, বাবা ভুল করে ফোন বাসায় রেখে গেছে। কখন বাসায় ফিরবে তাও বলতে পারছি না। ফোন কেন বন্ধ থাকে এমন কিছু জানতে চাইলে ছোট্ট এ মেয়েটি আগে থেকেই বাবার শিখানো মিথ্যা কথা বলে। বাবার কাছে টাকা নেই এ কারণে মোবাইলেও টাকা থাকে না। এজন্য আপনাদের ফোনও দিতে পারেন না। ফোন কল কেটে দেয়ার পরে জাবেদ তার মেয়েকে বলেন, ‘মা তুই আমাকে এবার বাঁচাইলি। এ লোক কয়েকদিনে আর ফোন দিবে না।’

শ্রাবণী রায় শুয়ে শুয়ে টিভিতে সিরিয়াল দেখছেন। কোনোভাবেই মনোযোগ বিনষ্ট করা যাবে না। হঠাৎ তার স্বামীর ফোন। মোবাইল রিং বেজে উঠতেই বাচ্চা ছেলেকে ফোন ধরিয়ে দিলেন। আর ‘তাকে বলতে বললো তোর আব্বুকে বল আম্মু ঘুমাচ্ছে। হঠাৎ করে প্রেসার বেড়ে গেছে। খুব মাথাব্যথা করছে’। শ্রাবণী নিজেই সন্তানকে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে মিথ্যা শিক্ষা দিচ্ছেন। কিন্তু তিনি চিন্তাও করছেন না এর ভয়াবহতা। পরবর্তীতে যখন বড় হয়ে এ সন্তান তার মা-বাবা এবং পাড়াপড়শির সঙ্গে মিথ্যা বলে তখনই বলে বেড়ান ছেলেটি বখে গেছে। কিন্তু এর চারা তো সেদিন তিনিই বপন করেছিলেন।

সমাজ বিজ্ঞানীদের মতে, মোবাইল ফোন মানুষের যোগাযোগ মাধ্যমে বিপ্লব ঘটিয়েছে। সময়কে সহজ করেছে। তবে এটার অপব্যবহারও হচ্ছে অহরহ। যেমন সামাজিক অবক্ষয়ে মোবাইল ফোনের একটা ভূমিকা রয়েছে। অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের সঠিক দিকনির্দেশনা দিলে সাধারণত এমনটা ঘটতো না। এর পাশাপাশি নৈতিক শিক্ষারও একটা বড় অভাব দেখা যায় তাদের মধ্যে।

মোবাইল ফোনের অপব্যবহার এবং এটাকে ভিত্তি করে মিথ্যা শিখানো হচ্ছে এ বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মাসুদা এম. রশিদ চৌধুরী। তিনি বলেন, মোবাইল ফোন পৃথিবীতে একটা আধুনিক প্রযুক্তি হিসেবে এসেছে। এর ব্যবহার যোগাযোগ অনেক সহজ করে দিয়েছে। সঙ্গে আমাকে নিরাপত্তাও দিচ্ছে। আমি কোথাও বিপদে পড়লে তা দ্রুত জানাতে পারছি মোবাইলের মাধ্যমে। কিন্তু আধুনিক এ যন্ত্রটির মারাত্মক অপব্যবহার হচ্ছে প্রতিনিয়ত। কীভাবে এটাকে অন্যায়ভাবে ব্যবহার করা যেতে পারে তার অনুশীলন করা হচ্ছে। সব থেকে বেশি প্রভাব পড়ছে শিশুদের ওপর। কেননা, বাচ্চারা আমাদের বড়দের কাছ থেকেই শিখে। আমরা বড়রাই এদের দিন দিন নষ্ট করে দিচ্ছি। আমরা তাদের হাতে একটা ডিভাইস তুলে দিচ্ছি। কিন্তু এর সঠিক ব্যবহার সম্পর্কে জানাচ্ছি না। আগেরদিনে যেমন বাবা-মা সন্তানদের সৎ কথা বলা শিখাতো, সঠিক সময় বাড়িতে আসার নির্দেশ দিতো, সুস্থভাবে চলা শিখাতো এবং মুরব্বিদের মান্য করা শিখাতো। এখন বড়রাও শিখে না, নিজেরাও মানে না।

তিনি আরো বলেন, এখন বাবা-মা উদাসীন। বাচ্চারাই দেখছে তার পিতা-মাতা ওটাকে কত অন্যায়ভাবে ব্যবহার করছে। তারা ছোট ছোট সন্তানদের সামনেই মোবাইল ফোনে মিথ্যা কথা বলে যাচ্ছে। আগেকার বাবা-মা কোনো গোপন কথা আলাপ করলে দূরে সরে গিয়ে কিংবা অন্য ঘরে গিয়ে আলাপ করতো। আর এখন তারা সবকিছু ওপেন বলছে। মোবাইলে সন্তানদের সামনেই হর-হামেশা আলাপ করছে। এর ফলে তারা মিথ্যা তো শিখছেই সঙ্গে একটা বিভ্রান্তিকর মানসিকতা নিয়ে বড় হচ্ছে। বর্তমানে বাবা-মা সন্তানদের সময় না দেয়াতে তারাও বিভিন্নভাবে মিথ্যার আশ্রয় নিচ্ছে। তারা মোবাইল ফোনে কি বলছে, কি দেখছে, কার সঙ্গে গোপনালাপ করছে সেসব বিষয়ে একেবারেই উদাসীন। এখন বাচ্চাদের হাতেও একটা মোবাইল ধরিয়ে দেয়া হচ্ছে আর তাতে তারা ফেসবুকসহ একাধিক সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করে নোংরা এবং মিথ্যা কথা শিখছে। যা ভাবাও যায় না।

হেফাজতে ইসলামের সাংগঠনিক সম্পাদক আল্লামা আজিজুল হক ইসলামাবাদী বলেন, মোবাইল ফোনে মিথ্যা বলা এখন অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে গেছে। ব্যক্তি বলতেও পারছে না যে, সে কীভাবে অহরহ মিথ্যা বলছে। আধুনিক প্রযুক্তির সবকিছু হচ্ছে বিজ্ঞান। আর ইসলাম এটাকে খুব সহজভাবে নেয় যদি এটা অবৈধ, হারাম এবং পাপের কিছু না থাকে।

মোবাইল ফোন ব্যবহার আমাদের জন্য অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু এটাকে ব্যবহার করে মিথ্যা কথায় লিপ্ত হয়ে যেন একটা কবিরা গুনাহ হয়। তাহলে এটা ব্যবহার হারাম। এছাড়াও মোবাইলে ইন্টারনেট ব্যবহার করে কেউ যদি চোখের গুনাহ, মুখের গুনাহ এবং অশ্লীলতা করে তাহলে এটা হারাম। বর্তমানে মোবাইলের মাধ্যমে বড়রা ছোটদের, বাবা তার সন্তানদের মিথ্যা শিক্ষা দিচ্ছে। আবার সন্তানরা তাদের মা-বাবার সঙ্গেও একইভাবে মিথ্যা বলছে। এ কারণে তারা জড়িয়ে পড়ছে বিভিন্ন অপরাধে এবং খারাপ কাজে। যে ব্যাপারে অভিভাবকরা খেয়াল রাখছে না। তিনি শিশু ও শিক্ষার্থীদের মোবাইলের অপব্যবহার সম্পর্কে হেফাজতে ইসলামের আমীরের একটি কথা তুলে ধরে বলেন, মোবাইলিজমের মাধ্যমে মানুষকে চরমভাবে মিথ্যা ও খারাপ কাজ শেখানো হচ্ছে। বিজ্ঞান আধুনিক যন্ত্র আমাদের উপকারের জন্য দিলেও আমরা তার মাধ্যমে যত রকম খারাপ কাজ করে যাচ্ছি। আর এসবের জন্য আমাদের অভিভাবকরাই সম্পূর্ণরূপে দায়ী। তারা সন্তান এবং শিক্ষার্থীদের ধর্মীয় এবং নৈতিক শিক্ষা না দিলে সামনে আরো ভয়ঙ্কর অবস্থা দেখা দেবে।
সূত্র: মানবজমিন

Facebook Comments Box
advertisement

Posted ২৩:০৩ | রবিবার, ০৮ এপ্রিল ২০১৮

Swadhindesh -স্বাধীনদেশ |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

advertisement
advertisement
advertisement
Advisory Editor
Professor Abdul Quadir Saleh
Editor
Advocate Md Obaydul Kabir
যোগাযোগ

Bangladesh : Moghbazar, Ramna, Dhaka -1217

ফোন : Europe Office: 560 Coventry Road, Small Heath, Birmingham, B10 0UN,

E-mail: news@swadhindesh.com, swadhindesh24@gmail.com