শুক্রবার ২৯শে মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১৫ই চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

স্বৈরাচার সরকারের অধীনে নির্বাচন সুষ্ঠু আশা করা যায় না

  |   সোমবার, ২৪ ডিসেম্বর ২০১৮ | প্রিন্ট

স্বৈরাচার সরকারের অধীনে নির্বাচন সুষ্ঠু আশা করা যায় না

 

মোঃ মাহবুব আলী খানশূর 

এবছরের মার্চে  প্রমান হয়েছে বাংলাদেশ এখন স্বৈরশাসনের অধীন এবং সেখানে এখন গণতন্ত্রের ন্যূনতম মানদন্ড পর্যন্ত মানা হচ্ছে না । আর ওই  মন্তব্য করেছে একটি জার্মান গবেষণা প্রতিষ্ঠান। বিশ্বের ১২৯ টি দেশে গণতন্ত্র, বাজার অর্থনীতি এবং সুশাসনের অবস্থা নিয়ে এক সমীক্ষার পর জার্মান প্রতিষ্ঠান ‘বেরটেলসম্যান স্টিফটুং’ তাদের রিপোর্টে এই মন্তব্য করে। স্বৈরাচার মানেই জোর করে ক্ষমতায় থাকতে চায় বছরের পর বছর। বাংলাদেশেও আসন্ন নির্বাচনে স্বৈরাচার আওয়ামী সরকার ক্ষমতায় থাকলে সুষ্ঠু নির্বাচন আশা করা যায় না।

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রচার ঘিরে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের গাড়িবহরে হামলা এবং নোয়াখালীর কবিরহাটে বিএনপির প্রার্থী মওদুদ আহমদের মিছিলে হামলা, ভাঙচুরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ঐক্যফ্রন্ট বিশেষ করে বিএনপির মিটিং-মিছিল এবং গাড়িবহরে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা হামলা করছে বলে প্রতিদিন প্রিন্ট ও ইলেকট্র্রনিক মিডিয়ায় খবর হচ্ছে। আওয়ামী লীগ তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে অতীতের মতো এবারো এসব ঘটনার দায় অস্বীকার করছে। কিন্তু মিডিয়া রিপোর্ট তো অবিশ্বাস করার জো নেই। কোনো কোনো বিএনপি প্রার্থীর বাসা বা বাসার সামনে থেকে বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্টের  নেতাকর্মীদের যখন তখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ধরে নিয়ে যাচ্ছে এবং মামলায় জড়াচ্ছে। কোথাও কোথাও বিএনপির ও জামায়াতের নেতাকর্মীদের একের পর এক মামলায় গ্রেফতার দেখানো হচ্ছে। এর পেছনে সরকারের ও সরকারি দলের নির্দেশ আছে বলে সংশ্লিষ্ট মহলের ধারণা। সন্ত্রাস, ভয়ভীতি প্রদর্শন ও গ্রেফতার করে ঐক্যফ্রন্ট তথা ২০ দলীয় জোটের প্রচারণায় বাধাদান ও নির্বাচন থেকে সরে যেতে বাধ্য করা সরকারি দলের কৌশল বলে অনেকে মনে করেন।

প্রতিদিন নাশকতার এবং কখনো কখনো পুলিশের কাজে বাধা দেয়ার অভিযোগে বিএনপি ও জামায়াতের নেতাকর্মীদের পুলিশ গ্রেফতার করছে। নির্বাচনের সময় সব দলের নেতাকর্মীদের প্রচারণার কাজে ব্যস্ত থাকার কথা। তারা নাশকতা করে গ্রেফতার হওয়ার ঝুঁকি নেবে কেন? কী ধরনের নাশকতা তা আইনশৃঙ্খলাবাহিনী কখনো স্পষ্ট করে না। বিএনপি-আওয়ামী লীগ মারামারি হলে পুলিশ শুধু বিএনপি নেতাকর্মীদেরই গ্রেফতার করছে; অপরপক্ষ যেন ধোয়া তুলসি পাতা। ফলে অনেক বিএনপি নেতাকর্মী প্রচারে নামতে পারছেন না। শুধু আওয়ামী লীগ নয়, সরকার, প্রশাসন ও পুলিশকে প্রতিপক্ষ ভাবছে বিএনপি। এরা বিরোধীদলীয় জোট ও ঐক্যফ্রন্টকে হারাতে একাট্টা হয়েছে বলে মনে হয়।

সরকারি তথা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা বিএনপির প্রচার-প্রপাগান্ডায় হামলা ও গাড়িসহ বিভিন্ন স্থানে বিএনপি অফিস ভাঙচুর করলেও তারা পার পেয়ে যাচ্ছে। এসব ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর কোনো তৎপরতা দেখা যায় না। হামলার শিকার বিএনএপি ও ঐক্যফ্রন্টের নেতাকর্মীরা, আবার গ্রেফতারও হচ্ছেন তারা। কোনো কোনো প্রার্থী নির্বাচন কমিশনের কাছে নিরাপত্তা চেয়েছেন। এ থেকে বোঝা যায়, সংশ্লিষ্ট এলাকার প্রশাসন ও পুলিশ নিরপেক্ষ নয় এবং তারা নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেনি। অবাক করার কাণ্ড যে পুলিশ বিএনপির প্রার্থীদের পর্যন্ত গ্রেফতার করছে, যা ইতঃপূর্বে কোনো জাতীয় নির্বাচনে ঘটেনি। প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ সুষ্ঠু নির্বাচনে পর্বত প্রমাণ বাধার সৃষ্টি করছে। আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর এহেন আচরণে সরকারপক্ষ প্রচারণায় সুবিধে পেয়ে যাচ্ছে। অথচ রাষ্ট্রীয় বাহিনী হিসেবে আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর নিরপেক্ষ থাকার কথা; কিন্তু তারা নিরপেক্ষতার প্রমাণ রাখার কথা তো দূরের কথা, অযাচিতভাবে সম্ভাব্য প্রিজাইডিং, সহকারী প্রিজাইডিং ও পোলিং অফিসারদের রাজনৈতিক অতীত অনুসন্ধান শুরু করে পুলিশ নিজেকে অনেক আগেই বিতর্কিত করেছে। নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ নেই বলে টিআইবি, সুজন, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ প্রভৃতি সংস্থা মত প্রকাশ করেছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে স্বাধীনভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগ নিয়ে ভোটারদের মনে সংশয় রয়েছে বলে মনে করেন সমাজের বিশিষ্টজনেরা।

এ প্রসঙ্গে বিচার বিভাগের ভূমিকা নিয়ে দু-একটি কথা বলা দরকার। বিচার বিভাগের একটা কাজ হলো নির্বাহী বিভাগের বাড়াবড়ির প্রতিবিধান দেয়া। কিন্তু বিচার বিভাগের বিশেষ করে নি¤œ আদালতের মনোভঙ্গিও সরকারের অনুকূলে বলে মনে হয়। উদাহরণস্বরূপ, নরসিংদি-১ আসনে বিএনপির প্রার্থী খায়রুল কবির খোকন একটা মামলায় ৮৭ নম্বর আসামি হলেও তাকে জামিন না দিয়ে অন্য আসামিদের জামিন দেয় নি¤œ আদালত। গায়েবি মামলায়ও বিএনপির নেতাকর্মীদের জামিন না দিয়ে নি¤œ আদালত সরকার তথা পুলিশের মনোবাসনা পূরণের হাতিয়ার হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট মহলের ধারণা। এ কি বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের উদ্দেশ্য বা সুফল? জনগণ কিন্তু নির্বাহী বিভাগের ক্ষমতার অপব্যবহার ও বাড়াবাড়ির ক্ষেত্রে জুডিশিয়াল অ্যাক্টিভিজম দেখতে চায়।

অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে সরকার রাষ্ট্রের সব অঙ্গকে ব্যবহার করে নির্বাচনে জেতার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। ক্ষমতার অপব্যবহার করে দলীয়-অনুগত প্রশাসন ও পুলিশ বিএনপি জোট তথা ঐক্যফ্রন্টকে হারিয়ে দিলে এবং সরকারি জোটকে জয়ী করালে ভয়াবহ প্রতিক্রিয়া হবে বলে জনমনে আশঙ্কা। এ প্রসঙ্গে লেখক ও গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদের কিছু উক্তির উদ্ধৃতি করছি : বাঙালির দুর্দশার জন্য দায়ী নির্লজ্জতা। ভোট কারচুপি করে জিতে আসা ব্যক্তিদের ফুলের মালা দিয়ে বরণ করে নেয় নির্লজ্জতার কারণে। বিদেশীরা বাংলাদেশের গণতন্ত্র নিয়ে আশা ছেড়ে দিয়েছে (প্রথম আলো ১২ ডিসেম্বর ২০১৮ পৃষ্ঠা-৩)।

১৯৯১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত নির্দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন হওয়ায় কোনো পক্ষের নির্বাচনী প্রচার-প্রপাগান্ডায় বাধাদান এবং হামলা-ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেনি। নির্বাচন কমিশন সাহসী ভূমিকা পালন করে সুষ্ঠু নির্বাচন করতে পেরেছে। আর প্রশাসনও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ সংশ্লিষ্ট নির্বাচনী কর্মকর্তারাও নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করেছেন। বিদ্যমান অবস্থায় নির্বাচন কমিশনের ভূমিকাও প্রশ্নবিদ্ধ। কারো কারো মতে, কমিশন প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি এবং কমিশন অদক্ষ ও অসহায়। নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার লক্ষ্যে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট সাত দফা দাবি সরকারের কাছে পেশ করলে সরকার তা না মেনে সুষ্ঠু নির্বাচনের লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড সৃষ্টির যে আশ্বাস দিয়েছিল; তার কোনো প্রতিফলন সরকার, সরকারি জোট এবং পক্ষপাতদুষ্ট প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর আচার-আচরণে দেখা যাচ্ছে না। দলীয়-অনুগত ও পক্ষপাতদুষ্ট প্রশাসন ও পুলিশের এহেন আচরণ কিন্তু নির্দলীয় সরকারের যৌক্তিকতা তুলে ধরে।

বিদ্যমান বাস্তবতায় নির্বাচনের ফলাফল পূর্বনির্ধারিত বলেই কেউ কেউ মনে করেন। তবে ফলাফল যা-ই হোক না কেন, শুধু ক্ষমতার জন্য প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলাবাহিনীসহ সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে দলীয় স্বার্থে ব্যবহারের জন্য সরকার যেভাবে দলীয়করণ করে এগুলোর নিরপেক্ষতার শাশ্বত মূল্যবোধকে নির্বাসনে পাঠিয়েছে, জাতিকে কতকাল এর খেসারত দিতে হবে তা কে জানে। ক্ষমতা আঁকড়ে রাখার মানসিকতা ত্যাগ না করলে এহেন পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। তবে সময় এখনো ফুরিয়ে যায়নি। ক্ষমতায় যাওয়াই মুখ্য বিষয় নয়, ন্যায্যভাবে ক্ষমতায় গেলেন কি না সেটিই সর্বজনের বিবেচ্য। নৈতিক বৈধতার জন্য একটা গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দরকার বলে বিজ্ঞজনদের মত।

Facebook Comments Box
advertisement

Posted ০৫:২০ | সোমবার, ২৪ ডিসেম্বর ২০১৮

Swadhindesh -স্বাধীনদেশ |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

advertisement
advertisement
advertisement
Advisory Editor
Professor Abdul Quadir Saleh
Editor
Advocate Md Obaydul Kabir
যোগাযোগ

Bangladesh : Moghbazar, Ramna, Dhaka -1217

ফোন : Europe Office: 560 Coventry Road, Small Heath, Birmingham, B10 0UN,

E-mail: news@swadhindesh.com, swadhindesh24@gmail.com