শুক্রবার ২৬শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১৩ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

৪ ডিসেম্বর ঝিনাইগাতী মুক্ত দিবস

  |   শনিবার, ০৪ ডিসেম্বর ২০২১ | প্রিন্ট

৪ ডিসেম্বর ঝিনাইগাতী মুক্ত দিবস

শাহরিয়ার মিল্টন ,শেরপুর : ৪ ডিসেম্বর ঝিনাইগাতী মুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের এদিনে পাক হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করে মিত্র বাহিনীর সহযোগীতায় মুক্তিযোদ্ধারা ঝিনাইগাতী অঞ্চলকে শত্রু মুক্ত করেন। পাক-হানাদার বাহিনী ১৯৭১ এর ২৫ মার্চ কালো রাতে যখন ঢাকার বুকে হত্যাযজ্ঞে ঝাঁপিয়ে পড়েন, সে রাতেই (৩.৪৫ মিনিটে) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পাঠানো স্বাধীনতার ঘোষণার টেলিগ্রাম ম্যাসেজটি ঝিনাইগাতী ভি এইচ এফ ওয়্যারলেস অফিসে এসে পৌঁছে। ম্যাসেজ পেয়েই ওয়্যারলেস মাস্টার জামান তার অফিসের পিয়ন পাঠিয়ে শেষ রাতের দিকে সংবাদ দেন আওয়ামী লীগ নেতা ফকির মো: আব্দুল মান্নানের বাসায় ।

বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষনার সবাদ পেয়ে পরদিন ২৬ মার্চ সকালে আওয়ামী লীগ নেতা ফকির মো: আব্দুল মান্নান, ডা. সৈয়দ হোসেন, আব্দুল কাফি মিয়া, হারুনুর রশিদ (রশিদ মাষ্টার), সৈয়দ আলী মেম্বার, অনন্ত কুমার রায়, সেকান্দর আলীসহ অনেকেই ওয়্যারলেস অফিসে আসেন। ইংরেজীতে লেখা টেলিগ্রাম ম্যাসেজটি পেয়েই নেতারা তৎক্ষনাৎ তা শেরপুর সংগ্রাম পরিষদ নেতাদের কাছে পাঠান।

ঝিনাইগাতীর সবেক উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ফকির মো. আব্দুল মান্নান জানান, ২৬ মার্চ সকাল থেকেই ঢাকার সর্বশেষ সংবাদ জানার জন্যে বাঁধভাঙ্গা জোয়ারের মতো শেরপুর শহরে মানুষ সমবেত হতে থাকেন। ঝিনাইগাতী ওয়্যারলেস অফিসে পাঠানো বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণাটি শেরপুর সংগ্রাম পরিষদ নেতারা হাতে পেয়েই তা বাংলায় অনুবাদ করে শেরপুর নিউ মার্কেট মোড়ে জনতার স্বতঃস্ফুর্ত সমাবেশে পাঠ করে শোনান। বঙ্গবন্ধুর পাঠানো স্বাধীনতার ঘোষণা শুনে সমবেত জনতা মুর্হুমুর্হু শ্লোগানে মুখরিত করে তোলে শেরপুরের আকাশ বাতাস।

২৭ মার্চ সকালে শেরপুর সংগ্রাম পরিষদ নেতা অ্যাডভোকেট আব্দুল হালিম এমপি, মুহসিন আলী মাস্টার ও ছাত্র নেতা আমজাদ আলী ঝিনাইগাতী আসেন । ছাত্রনেতা ফকির মো: আব্দুল মান্নানকে সঙ্গে নিয়ে তারা নকশি ইপিআর ক্যাম্পে যান। নকশি ক্যাম্পের সুবেদার হাকিম সংগ্রাম পরিষদ নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে বসেই বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। দেশকে শত্রু মুক্ত করা সহ পাক হানাদার বাহিনীকে প্রতিরোধ করার জন্য পরিকল্পনা গ্রহণ করেন।

শুরু হলো প্রতিরোধ সংগ্রাম। যুদ্ধের প্রস্তুতি হিসেবে রাংটিয়া পাতার ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ শিবির খোলা হয়। ট্রেনিং শেষে এসব স্বেচ্ছাসেবক সহ মুজিব বাহিনী ও ইপিআর সৈনিকদের নিয়ে সুবেদার হাকিম মধুপুরে প্রতিরোধ গড়ে তুলেন। পরে তা পিছু হটে পুরাতন ব্র্হ্মপুত্র নদের চরে প্রতিরোধ গড়ে তুলেন। ২৬ এপ্রিল সুবেদার হাকিমের খোলা জীপ এসে দাঁড়ায় ঝিনাইগাতী পাঁচ রাস্তার মোড় আমতলায়। তিনি জনতাকে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যেতে অনুরোধ করেন। ২৬ এপ্রিল পর্যন্ত ঝিনাইগাতী শত্রু মুক্ত ছিল।

২৭ এপ্রিল পাক বাহিনী বহর নিয়ে গোলা বর্ষন করতে করতে পৌছায় ঝিনাইগাতী বাজারে। ঝিনাইগাতী ঢুকেই আওয়ামী লীগ অফিস আগুন ধরিয়ে পুড়ে দেয়। গাড়ী বহর নিয়ে রাংটিয়া পাহাড় পর্যন্ত গিয়ে আবার পিছনে ফিরে এসে ওইদিন বিকেলেই কোয়ারীরোডে পাক বাহিনী ক্যাম্প স্থাপন করেন।। পরে ঝিনাইগাতীর এক মাইল দক্ষিণে আহম্মদ নগর হাই স্কুলে তাদের সেক্টর হেড কোর্য়াটার স্থাপন করেন। যা মুক্তিযোদ্ধাদের ১১নং সেক্টরের বিপরীতে পাক বাহিনীর ব্রহ্মপুত্র নদের উত্তরে একমাত্র সেক্টর হেড কোর্য়াটার। যার দায়িত্বে ছিলেন মেজর রিয়াজ। এছাড়া পাক বাহিনী শালচূড়া, নকশি, হলদীগ্রাম, তাওয়াকোচা, মোল্লাপাড়ায় ক্যাম্প স্থাপন করেন।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাক বাহিনী ৩০ এপ্রিল জগৎপুর গ্রামে হানা দিয়ে গ্রামটি পুড়িয়ে দেয় এবং ৪১ জন গ্রামবাসীকে গুলি করে হত্যা করেন। ৫ জুলাই কাটাখালি ব্রীজ ধ্বংস করে মুক্তিযোদ্ধারা রাঙ্গামাটি গ্রামে আশ্রয় নেন। দালালদের খবরে পাক বাহিনী রাংগামাটি গ্রামটি তিনদিক থেকে ঘিরে ফেলেন। শুধু রাংগামাটি বিলের দিক খোলা ছিল। সম্মুখ যুদ্ধে কমান্ডার নাজমুল আহসান শহীদ হন। তার লাশ আনতে গিয়ে আলী হুসেন ও মোফাজ্জল শহীদ হন। পরদিন রাঙ্গামাটি গ্রামে হানা দিয়ে পাক বাহিনী ৯ জন গ্রামবাসীকে এক লাইনে দাড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করেন। ২৩ আগষ্ট মুক্তিযোদ্ধারা তাওয়াকুচা ক্যাম্প দখল করে মুক্ত তাওয়াকুচায় বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। তাওয়াকুচা যুদ্ধে ৪ জন পাক সেনা ও ৭ জন রাজাকার নিহত হলে পাক বাহিনী ক্যাম্প ছেড়ে দিয়ে পিছু হটে আসেন। ৩ আগষ্ট নকশি ক্যাম্প আক্রমন করেন মুক্তিযোদ্ধারা। আগের দিন ২ আগষ্ট বিকেলে মেজর জিয়া নকশি ক্যাম্প আক্রমনের জন্যে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতিয়ারের অবস্থান গুলো দেখেন। এদিনের যুদ্ধে ২৬ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ ও নিখোঁজ হন। যুদ্ধে পাক বাহিনীর ৩৫ জন সেনা নিহত হন।

২৭ নভেম্বর কমান্ডার জাফর ইকবালের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা ঝিনাইগাতী বাজারের রাজাকার ক্যাম্প দখল করে ৮টি রাইফেলসহ ৮ জন রাজাকারকে ধরে নিয়ে যান। ২৮ নভেম্বর পাক বাহিনী ঝিনাইগাতী হানা দিয়ে মুক্তিযোদ্ধা এবিএম সিদ্দিকের ছোট ভাই ওমর (১১) , মুক্তিযোদ্ধা মকবুলের ছেলে খালেক (১০), পাক বাহিনীর দালাল আব্দুর রহমান, গোজারত মেম্বারসহ ৮ জনকে আহম্মদ নগর ক্যাম্পের বধ্যভূমিতে ধরে নিয়ে এক লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করেন। পরে তাদের এক গর্তে মাটি চাপা দেয়া হয় ।

৩ ডিসেম্বর রাত আনুমানিক দেড়টায় শালচূড়া ক্যাম্পের পাক বাহিনী কামালপুর দুর্গের পতনের আগাম সংবাদ পেয়ে পিছু হটেন এবং আহম্মদ নগর হেড কোর্য়ারটারের সৈনিকদের সঙ্গে নিয়ে রাতেই মোল্লাপাড়া ক্যাম্প গুটিয়ে শেরপুরে আশ্রয় নেন। এভাবে রাতের আঁধারে বিনা যুদ্ধে ঝিনাইগাতী শত্রু মুক্ত হয়। ৪ ডিসেম্বর সকালে মুক্তিযোদ্ধারা মুক্ত ঝিনাইগাতীতে স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়ান।

Facebook Comments Box
advertisement

Posted ১৫:৪৩ | শনিবার, ০৪ ডিসেম্বর ২০২১

Swadhindesh -স্বাধীনদেশ |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

advertisement
advertisement
advertisement
Advisory Editor
Professor Abdul Quadir Saleh
Editor
Advocate Md Obaydul Kabir
যোগাযোগ

Bangladesh : Moghbazar, Ramna, Dhaka -1217

ফোন : Europe Office: 560 Coventry Road, Small Heath, Birmingham, B10 0UN,

E-mail: news@swadhindesh.com, swadhindesh24@gmail.com