মঙ্গলবার ২৩শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১০ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

লুটপাটে ডুবছে বিআরটিসি

  |   শনিবার, ১১ আগস্ট ২০১৮ | প্রিন্ট

লুটপাটে ডুবছে বিআরটিসি

ডেস্ক রিপোর্ট : ২০ শতাংশের বেশি বাস বিভিন্ন ডিপোয় ‘অচল’ ২১ ডিপোর ২০টিতেই বেতন অনিয়মিত ডিপো ব্যবস্থাপকদের দিতে হয় ‘চুঙ্গি’

একমাত্র সরকারি পরিবহন সংস্থা বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশন (বিআরটিসি) লোকসানের ভারে শেষ পর্যন্ত ডুবতে বসেছে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে, দেশের বিভিন্ন স্থানে সংস্থাটির ২১টি ডিপোর ২০টিতেই চালক ও কর্মচারীদের বেতন-ভাতা নিয়মিত দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। সংস্থাটির নিজস্ব হিসাবেই, সর্বশেষ ২০১৬-১৭ অর্থবছরে সংস্থার লোকসান হয়েছে ৪৭৩ কোটি টাকা।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ট্রিপ চুরি, বিভিন্নভাবে রাজস্ব লুট, রক্ষণাবেক্ষণের নামে অতিরিক্ত ব্যয় দেখানো, ঋণ করে কেনা বাস সিন্ডিকেটের সহযোগিতায় অচল করে রাখায় সংস্থাটির লোকসানের পরিমাণ বাড়ছে। ডিপো ব্যবস্থাপকরা স্থানীয় রাজনীতিকদের সঙ্গে নিয়ে চালকদের বিভিন্ন হারে চাঁদা তুলতে বাধ্য করছেন। চালক বাস্তব আয় থেকে এ অর্থের জোগান দিচ্ছেন। তবে মাস শেষে এই চালকরাও বেতন পাচ্ছেন না।

সংস্থাটি বলছে, পে স্কেল বাস্তবায়নে মাসে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতায় অতিরিক্ত ২.৮ কোটি টাকা খরচ বেড়ে যাওয়ায় লোকসান হচ্ছে। তবে বিআরটিসির চালক ও অন্য কর্মচারীরা বলছেন, দুর্নীতি বন্ধ হলে সংস্থাটির লাভ হতো। এ জন্য ডিপো ব্যবস্থাপকদের ওপর তদারকি বাড়াতে হবে। শুধু তাঁদের বদলি করলেই হবে না।

বিআরটিসি প্রধান কার্যালয়ের তথ্যানুসারে, ২০১৫ সালের জুন পর্যন্ত আগের পাঁচ বছরে সংস্থাটির লোকসান ছিল ৩৪০ কোটি টাকা। ২০১৫ সালের ১ জুলাই থেকে নবম জাতীয় বেতন স্কেল চালু হলে তিন হাজার ৪১৫ জন কর্মচারীর বেতন প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যায়। ‘সেবাই আদর্শ’ স্লোগান সামনে রেখে সংস্থাটি সেবা শুরু করেছিল। রাজধানীতে এই সংস্থার বাসে সেবা পাওয়া এখন ‘দুর্লভ’ হয়ে পড়েছে। মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত এক হাজার ৫৩৮টি নতুন বাস কেনা হয়েছিল। এখন এর ২০ শতাংশের বেশি বাস বিভিন্ন ডিপোতে বসিয়ে রাখা হয়েছে। এর নেপথ্যেও রয়েছে শ্রমিক নেতা, ডিপো ব্যবস্থাপক সিন্ডিকেট। ব্যয় বেশি হবে বলে রক্ষণাবেক্ষণ করা হচ্ছে না পুরনো ও অচল বাসগুলোর।

রাজধানীর জোয়ারসাহারা বাস ডিপোর প্রায় ৩০০ কর্মচারী ১০ মাস ধরে বেতন না পেয়ে গত ২৫ জুলাই ডিপোয় তালা মেরে বাস চালানো বন্ধ করে দিয়েছিলেন। ঘটনাস্থলে গেলে বিআরটিসি শ্রমিক-কর্মচারী লীগের সাধারণ সম্পাদক হারুন রশীদের ওপর ক্ষিপ্ত হন আন্দোলনকারীরা। শ্রমিকরা জানান, ডিপোর অনিয়মে হারুন জড়িত। তিনি ডিপো থেকে মাসে মাসে কমিশন নেন লাখ লাখ টাকা। বাসের ট্রিপ চুরি, যন্ত্রাংশ কেনার নামে অতিরিক্ত ব্যয় ও নিজেদের পকেট ভারী করেছেন ডিপো ব্যবস্থাপক মনিরুজ্জামান ও শ্রমিক নেতারা।

বিআরটিসি সূত্রে জানা গেছে, দেশে ১৯৮টি রুটে বিআরটিসির বাস চলাচল করে। সংস্থাটির আছে ২১টি ডিপো। এর মধ্যে ২০টি ডিপোয় বেতন বকেয়া পড়েছে এক মাস থেকে ১৪ মাস পর্যন্ত। বিভিন্ন ডিপোর কর্মচারীরা জানান, ঢাকার গাবতলীতে ছয় মাস, মোহাম্মদপুরে পাঁচ মাস, মতিঝিলে এক মাস, গাজীপুরে তিনটি ডিপোয় কর্মচারীদের বেতন তিন মাস ধরে দেওয়া হচ্ছে না। নরসিংদীতে আট মাস, নারায়ণগঞ্জে ৯ মাস, রংপুরে ১৪ মাস, কুমিল্লায় তিন মাস, চট্টগ্রামে ৯ মাস ধরে বেতন-ভাতা দেওয়া হচ্ছে না। বগুড়ায় চার মাস, সিলেটে তিন মাস, পাবনায় সাত মাস, নোয়াখালীর সোনাপুর ডিপো ও খুলনা ডিপোতে তিন মাস, দিনাজপুরে ছয় মাস ধরে কর্মচারীরা বেতন না পেয়ে ক্ষুব্ধ হয়ে পড়েছেন।

জোয়ারসাহারা বাস ডিপোর ব্যবস্থাপক ছিলেন মো. মনিরুজ্জামান। ডিপোর কর্মচারীদের তোপের মুখে ওই ব্যবস্থাপককে জোয়ারসাহারা থেকে গত ২৫ জুলাই অন্য বাস ডিপোতে বদলি করা হয়েছে। কর্মচারীরা অভিযোগ করেছেন, এর আগে কল্যাণপুর বাস ডিপোতে ব্যবস্থাপক থাকার সময় মনিরুজ্জামানের ইন্ধনেই অর্থ আত্মসাৎ চলত। একপর্যায়ে ৫৪ লাখ টাকা আত্মসাতের ঘটনায় মামলাও হয়েছে। জোয়ারসাহারা ডিপোতে দায়িত্ব নেওয়ার পর মনিরুজ্জামান মাত্র দুই মাস বেতন দিতে পেরেছেন কর্মচারীদের। দিনে গড়ে ৭৭টি বাস চলাচল করলেও জোয়ারসাহারা ডিপোয় দেড় বছরে লোকসান হয়েছে প্রায় দুই কোটি টাকা। মনিরুজ্জামানের দায়িত্ব পালনকালে বাসের যন্ত্রাংশ কিনে ভুয়া বিল করা, ট্রিপ কম দেখিয়ে তার জন্য চাঁদা তোলাসহ বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতি হয়েছে বলে কর্মচারীরা কালের কণ্ঠ’র কাছে অভিযোগ করেছেন। মো. মনিরুজ্জামানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, এসব অভিযোগ সত্য নয়।

ডিপোয় যানবাহন মেরামত ব্যয়, গাড়িতে অতিরিক্ত জ্বালানি তেল ব্যবহারসহ বিভিন্ন দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার অভিযোগ প্রবল হলে গত ৫ জুলাই দুদকের প্রতিনিধিদল এ ডিপোয় আকস্মিক অভিযান চালায়। দুদক পরিচালক ফরিদুর রহমানের নেতৃত্বে অভিযান চালিয়ে ডিপোর যানবাহন মেরামত ব্যয়সংক্রান্ত বিভিন্ন বিল-ভাউচার, রেজিস্টার ও স্টোররুম পর্যবেক্ষণ করে তথ্য সংগ্রহ করা হয়।

বিআরটিসির চেয়ারম্যান ফরিদ আহমেদ ভুঁইয়া কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘মনিরুজ্জামান দায়িত্বে আসার পর থেকে কেন পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে, তা খতিয়ে দেখা হবে।

বিআরটিসি বগুড়া বাস ডিপো থেকে দিনে ৪৬টি বাস চলাচল করে। সেখানে স্থায়ী ও অস্থায়ী কর্মচারী ১৪৯ জন। মাসে বেতন-ভাতা দিতে হয় প্রায় ২৪ লাখ টাকা। এ ডিপোয় গত জুন মাসে আয় হয়েছে প্রায় এক কোটি ১৩ লাখ টাকা, ব্যয় হয়েছে প্রায় এক কোটি ১১ লাখ টাকা। লাভ হয়েছে প্রায় দুই লাখ টাকা। বাসে বেশি যাত্রী পরিবহন করা হলেও তিন মাস ধরে এ ডিপোয় কর্মচারীরা বেতন পাচ্ছেন না। ডিপোর কর্মচারীরা অভিযোগ করেন, ডিপো ব্যবস্থাপক ও স্থানীয় মাস্তানদের সিন্ডিকেটের জন্য গাড়িচালকদের রাজস্ব আয় থেকে মাসে গড়ে ১৪ লাখ টাকা (চাঁদা বা চুঙ্গি) তুলতে হয়। না হলে চালকদের অন্যত্র বদলি করে দেওয়াসহ বিভিন্ন হয়রানি করা হয়। ডিপোর ফোরম্যান আবদুর রশিদ ডিপো ব্যবস্থাপকের বিরুদ্ধে বাসের যন্ত্রাংশ ক্রয়ের ভুয়া বিল-ভাউচার করার অভিযোগ করেছেন উচ্চপর্যায়ে। এ অভিযোগ করার পর ডিপো ব্যবস্থাপকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। উল্টো আবদুর রশিদকে বগুড়া থেকে রংপুরে বদলি করা হয়েছে। বগুড়া ডিপো ব্যবস্থাপক মো. মফিজ উদ্দিন এর আগে জোয়ারসাহারা বাস ডিপোর ব্যবস্থাপক ছিলেন। জানা গেছে, বগুড়া ডিপোর এ ব্যবস্থাপকের জন্য ঘুষ বাবদ (চুঙ্গি) মাসে প্রায় ১৫ লাখ টাকা তোলা হয়। ডিপো ব্যবস্থাপকসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা এ অর্থ নিজেদের পকেটে পুরে নেন। ওই ডিপোর একাধিক বাসচালক ও কর্মচারী জানান, নওগাঁ-জয়পুরহাট রুটে ৫০০ টাকা, ভূরুঙ্গামারী-রাজশাহী রুটে দুই হাজার টাকা, বগুড়া-বাংলাবান্ধা রুটে দুই হাজার টাকা, রংপুর-কিশোরগঞ্জ রুটে দুই হাজার টাকা, বগুড়া-দিনাজপুর রুটে এক হাজার টাকা, বগুড়া-বরিশাল রুটে তিন হাজার টাকা, বগুড়া-সেতাবগঞ্জ রুটে দেড় হাজার টাকা হারে চুঙ্গি আদায় করা হয়। এ ছাড়া বাসের যন্ত্রাংশ কেনার ভুয়া ভাউচারে বিল করা হয় মাসে তিন-চার লাখ টাকার। ডিপো ব্যবস্থাপক মফিজ উদ্দিন কালের কণ্ঠকে বলেছেন, ‘চুঙ্গি শব্দটা আমিও শুনেছি। আমি কোনো দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত নই। আবদুর রশিদ ভুয়া ভাউচারের যে অভিযোগ তুলেছে, তা সত্য নয়। কারণ সে একসময় পাঁচ সদস্যের ক্রয় কমিটিতে ছিল। কমিটি তো অনুমোদন দিয়েছে। তাহলে অপরাধ কী?’

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, রাজস্ব আত্মসাৎ, দরপত্র ছাড়াই বহিরাগতদের বাস ইজারা দেওয়া, বহিরাগত ও অবৈধভাবে নিযুক্ত কন্ডাক্টরদের দিয়ে ভাড়া আদায়, রেজিস্টারে আয়ের হিসাব না রাখায় লোকসান দেখানোর সুযোগ বাড়ছে সংস্থার বিভিন্ন ডিপোতে। এতে বিভিন্ন ডিপো ব্যবস্থাপক, বহিরাগত সন্ত্রাসী, ইজারাদার ও চালকদের বড় অংশ সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছে। বিআরটিসিতে দুর্নীতির অভিযোগের পর তদন্তের জন্য ২০১৫ সালের ২৯ মার্চ কমিটি করা হয়েছিল সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব আব্দুল হামিদকে প্রধান করে। কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, মতিঝিল ডিপোতে এক কোটি টাকার অধিক, মিরপুর দ্বিতল বাস ডিপোয় ৯০ লাখ টাকার অধিক রাজস্ব জমা হয়নি—এমন তথ্য পাওয়া গেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, ডিপোভিত্তিক টায়ার, টিউব, লুব্রিকেন্ট, তেল, গ্যাস, কম্প্রেসর কেনা, রোজভিত্তিক চালক ও কন্ডাক্টর নিয়োগ, বাস মেরামত, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, ডিপোর জায়গা লিজ দেওয়াসহ স্বেচ্ছাচারী বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের আলামত মিলেছে। তদন্ত হওয়ার পর বিভিন্ন ডিপোর ব্যবস্থাপককে বদলি করা হয়েছিল। তবে অবস্থার উন্নতি হয়নি।

বিআরটিসির চেয়ারম্যান ফরিদ আহমেদ ভুঁইয়া বলেন, সংস্থায় মাসে আয় হয় গড়ে ২০ কোটি টাকা। এর মধ্যে মাসে সাত কোটি ২০ লাখ টাকা দিতে হয় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতায়। প্রতি মাসে ঘাটতি থাকে প্রায় ৫০ লাখ টাকা। বিভিন্ন ডিপোয় দুই মাস বা কয়েক মাস পর বেতন দিতে হচ্ছে স্বীকার করে তিনি জানান, জোয়ারসাহারা, রংপুর, নারায়ণগঞ্জ ও গাবতলী ডিপোয় পাঁচ-ছয় মাস ধরে কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বকেয়া পড়েছে। তবে অবস্থার উন্নতি হচ্ছে।

তিনি আরো বলেন, ‘ডিপোয় অচল চীনা বা কোরিয়ান বাস মেরামতে গড়ে প্রতিটিতে ১০ লাখ টাকা খরচ পড়ে। বেতন-ভাতা দেব, নাকি বাস মেরামত করব? ২০১২ সালের পর আর নতুন বাস আনা হয়নি। নতুন বাস আনা হলে রাজস্ব বাড়বে। এ ছাড়া বিভিন্ন সময় অপরিকল্পিত বাস আমদানি করায় খেসারত দিতে হচ্ছে সরকারকে।’
সূত্র : কালের কন্ঠ

Facebook Comments Box
advertisement

Posted ১২:০৬ | শনিবার, ১১ আগস্ট ২০১৮

Swadhindesh -স্বাধীনদেশ |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

advertisement
advertisement
advertisement

এ বিভাগের আরও খবর

Advisory Editor
Professor Abdul Quadir Saleh
Editor
Advocate Md Obaydul Kabir
যোগাযোগ

Bangladesh : Moghbazar, Ramna, Dhaka -1217

ফোন : Europe Office: 560 Coventry Road, Small Heath, Birmingham, B10 0UN,

E-mail: news@swadhindesh.com, swadhindesh24@gmail.com