শনিবার ২০শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ৭ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

শিরোনাম >>
শিরোনাম >>

মোস্তাফিজরা হারেন না

  |   বুধবার, ০৭ নভেম্বর ২০১৮ | প্রিন্ট

মোস্তাফিজরা হারেন না

হরতাল ছিল। এর মধ্যেই মোস্তাফিজকে যেতে হবে সাতক্ষীরা থেকে ঢাকা। ডাক এসেছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের নেটে বল করার। এমন সুযোগ কি ছাড়া যায়! সেদিন মোস্তাফিজুর রহমানকে জিতিয়ে দিয়েছিলেন তাঁর সেজ ভাই মোখলেছুর রহমান।

কালীগঞ্জ উপজেলার তেঁতুলিয়া গ্রাম থেকে প্রথমে মোটরসাইকেলে খুলনার চুকনগর। তারপর ভাড়া গাড়িতে ঢাকা। ঠিক সময়ে মোস্তাফিজ পৌঁছে গেলেন মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামের নেটে।

মোস্তাফিজের বয়স তখন ১৪ কি ১৫ বছর। ভাই-বন্ধুদের সঙ্গে এলাকার একটা টুর্নামেন্টে খেলছিলেন রাজাপুর আরপি সংঘের হয়ে। অন্য বোলাররা সুবিধা করতে পারছিল না বলে অধিনায়ক মোখলেছুর রহমান ছোট ভাই মোস্তাফিজের হাতে বল তুলে দিলেন। বাকিদের মনে তো তখন খচখচানি। মোস্তাফিজ পারবেন তো? পেরেছিলেন তিনি। তৃতীয় বলেই উইকেট।

মোস্তাফিজের আজকের ‘ফিজ’ হয়ে ওঠার শুরুটা ছিল সংগ্রাম আর প্রতিকূলতায় ভরা। যখন তাঁর বয়সীরা আরামে ঘুমাত, শীতের সময় লেপের ভেতর থেকে বের হয়ে স্কুলে যেতে চাইত না, মোস্তাফিজ তখন রাস্তায়। ভাইয়ের মোটরসাইকেলের পেছনে বসে ৪০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে তেতুঁলিয়া গ্রাম থেকে সাতক্ষীরা শহরে যেতেন অনুশীলন করতে।

শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা—কিছুতেই থামত না মোটরসাইকেল। প্রতিদিন এক ঘণ্টার মতো মোটরসাইকেলে চড়ে তবেই মোস্তাফিজ পৌঁছাতেন অনুশীলনে। সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরতে আবার এক ঘণ্টা। মাঝেমধ্যে মনে হতো মোস্তাফিজের, ‘ধুর! এত কষ্ট করে কী হবে! এর চেয়ে গাঁয়ের মাঠে খেলি।’ কিন্তু ওই মনে হওয়া পর্যন্তই। পরদিন ভোরে ঠিকই ঘুম থেকে উঠে ভাইয়ের পেছনে চেপে বসতেন তিনি । মোস্তাফিজ ওই বয়সেও হারেননি। হারেননি বলেই তিনি আজকের মোস্তাফিজ, ‘ফিজ’।

মোস্তাফিজুর রহমান
 এপ্রিল, ২০১৫ টি-টোয়েন্টি অভিষেক
 জুন, ২০১৫ ওয়ানডে অভিষেক
 জুলাই, ২০১৫ টেস্ট অভিষেক
 এপ্রিল, ২০১৬ সান রাইজার্স হায়দরাবাদের হয়ে আইপিএল অভিষেক
 জুলাই, ২০১৬ সাসেক্সের হয়ে ইংলিশ কাউন্টিতে অভিষেক
 ২০১৬ কাঁধের চোট। এক বছরের জন্য মাঠের বাইরে।
 ২০১৭ অ্যাঙ্কেলের চোট। চার মাস মাঠের বাইরে।
 ভারতের বিপক্ষে ঢাকায় অভিষেক ওয়ানডেতে ৫ উইকেট, পরের ম্যাচেই উইকেট ৬টি।
 ক্যারিয়ারের প্রথম দুই ওয়ানডেতেই ৫ উইকেট নেওয়া দ্বিতীয় বোলার ।
 কলম্বো টেস্টে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ৩ উইকেট
 ডাম্বুলার ওয়ানডেতে ৩ উইকেট
 ২০১৭ সালে চট্টগ্রাম টেস্টে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ৪ উইকেট

মোস্তাফিজ আজও হারেন না। এই তো সেদিন, এশিয়া কাপের ঘটনা। আবুধাবির প্রচণ্ড গরমে আফগানিস্তানের বিপক্ষে খেলছিল বাংলাদেশ। নিজের দ্বিতীয় স্পেলের তৃতীয় ওভার করার পরই হাঁপিয়ে উঠলেন মোস্তাফিজ। ওদিকে পায়ের মাংসপেশিতেও ব্যথা। বোধ হয় টান পড়েছে। অধিনায়ক মাশরাফিকে গিয়ে বললেন, ‘আর তো পারছি না, ভাই!’ মাশরাফি তাঁকে বোলিং থেকে ক্ষণিকের বিশ্রাম দিলেও জানতেন, ক্লান্ত মোস্তাফিজই পারেন বাংলাদেশকে জয় এনে দিতে। নয়তো ম্যাচের শেষ ওভারে কেন তাঁর হাতেই তুলে দেবেন বল!

মোস্তাফিজের হাসিটা দেখেছেন কখনো? সরল, কিন্তু বিজয়ীর। মোস্তাফিজ ছক্কা খেয়েও হাসতে পারেন। কারণ, তিনি জানেন, জীবন ওই এক ছক্কাতেই শেষ নয়। পরের বলটাই তাঁকে ভাসাতে পারে আনন্দে। জীবনে আনতে পারে নতুন রং।

মনে আছে ওই ওভারটির কথা? জেতার জন্য ৬ বলে ৮ রান দরকার ছিল আফগানিস্তানের। ওয়ানডের জন্য খুব সহজ সমীকরণ। কিন্তু মোস্তাফিজের মাথার ভেতর তখন প্রজাপতি উড়ছে। বুদ্ধির প্রজাপতি। তিনি আগেই ঠিক করে নিলেন, ছয়টা বল করতে হবে ছয় রকম। সে রকমই যে হয়েছে, তা নয়। কিন্তু ওটা ভেবেছেন বলেই তো ওই ওভারটা হলো দুর্দান্ত। অফ কাটারের মায়াবী ছোবলের সামনে অসহায় হয়ে পড়লেন আফগান ব্যাটসম্যানরা। রশিদ খান তো দ্বিতীয় বলেই আউট! কিসের আট? ছয় বলে মোস্তাফিজ দিলেন মাত্র ৪ রান। বাংলাদেশ ম্যাচ জিতে গেল তিন রানে। মোস্তাফিজ হারেননি। হারেনি বাংলাদেশও।
ক্যারিয়ারের একেবারে শুরুতেই ভীষণ এক চোট পেয়েছিলেন মোস্তাফিজ। ২০১৫ সালে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক। পরের বছরই চোট পেলেন কাঁধে। সেই যন্ত্রণা নিয়ে বেশ কিছুদিন কাটানোর পর ২০ বছরের কচি কাঁধটি গেল ছুরির নিচে। ইংল্যান্ডে অস্ত্রোপচার শেষে মাঠে ফিরতে ফিরতে আরও চার মাস।
চোট কাটিয়ে মাঠে ফেরার পর প্রথমে মনে হচ্ছিল মোস্তাফিজের বোলিং থেকে সেই বিষ বুঝি হারিয়ে গেছে। আগের মতো তাঁর কাটারকে আর ভয় পাচ্ছেন না খেলোয়াড়েরা। কিংবা ছুরির পোঁচে কাটারের ধারটাই গেছে কমে। বাংলাদেশের ক্রিকেটের বুক চিরে বইতে শুরু করল গোপন হতাশার স্রোত। আহা! কী অস্ত্রটাই না ভোঁতা হয়ে যাচ্ছে!
কিন্তু মোস্তাফিজ এবারও হারেননি। ২০১৭ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে চট্টগ্রাম টেস্টে ৪ উইকেট, এর আগে কলম্বো টেস্টে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ৩ উইকেট ও ডাম্বুলার ওয়ানডেতে ৩ উইকেট—মোস্তাফিজের আলোর ঝলকানি মাঝেমধ্যেই দেখা গেছে। এ বছর ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে তো পুরোপুরিই ফর্মে ফিরে গেলেন মোস্তাফিজ। খেলা আবারও দুঃসাধ্য হয়ে পড়ল ব্যাটসম্যানদের জন্য। এশিয়া কাপেও তা দুঃসাধ্যই থাকল। ছোট্ট এই ক্যারিয়ারে মাঝে একবার অ্যাঙ্কেলের চোটেও পড়েছেন। কিন্তু হার মানেননি।
মোস্তাফিজ এভাবেই জিতে চলেছেন একটার পর একটা লড়াই। কৈশোর থেকে আজকের তারুণ্য পর্যন্ত হার তাঁকে গ্রাস করতে পারেনি। জয়-পরাজয়, সাফল্য-ব্যর্থতা নিয়েই মানুষের জীবন। প্রতিকূলতা আসবে, সংগ্রাম করতে হবে। সেসব জয় করতে পারলে তবেই না মুখে ছড়ায় সাফল্যের উজ্জ্বল হাসি!
মোস্তাফিজের হাসিটা দেখেছেন কখনো? সরল, কিন্তু বিজয়ীর। মোস্তাফিজ ছক্কা খেয়েও হাসতে পারেন। কারণ, তিনি জানেন, জীবন ওই এক ছক্কাতেই শেষ নয়। পরের বলটাই তাঁকে ভাসাতে পারে আনন্দে। জীবনে আনতে পারে নতুন রং।
মোস্তাফিজরা তাই কখনো হারেন না।

 তারেক মাহমুদ প্রথম আলো

Facebook Comments Box
advertisement

Posted ১৩:৫৩ | বুধবার, ০৭ নভেম্বর ২০১৮

Swadhindesh -স্বাধীনদেশ |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

advertisement
advertisement
advertisement

এ বিভাগের আরও খবর

Advisory Editor
Professor Abdul Quadir Saleh
Editor
Advocate Md Obaydul Kabir
যোগাযোগ

Bangladesh : Moghbazar, Ramna, Dhaka -1217

ফোন : Europe Office: 560 Coventry Road, Small Heath, Birmingham, B10 0UN,

E-mail: news@swadhindesh.com, swadhindesh24@gmail.com