| শুক্রবার, ২৯ জানুয়ারি ২০২১ | প্রিন্ট
রহস্যে মোড়া বিদ্যুতের ঝলক দেখলো আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন। একের পর এক। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের অনেক অনেক উপরের স্তরে। যা জমাট বাঁধা মেঘ থেকে ছুটে যাচ্ছে মহাকাশে। নীল রঙের ‘ভুতুড়ে’ আলো। ১ থেকে ২ সেকেন্ডের স্থায়িত্ব তাদের।
মেঘের দেশে ঠিক কোন জায়গায় তার জন্ম হচ্ছে, কতোদূর পর্যন্ত গিয়ে ঠিক কোথায় উধাও হয়ে যাচ্ছে সেই বিদ্যুতের ঝলকগুলো, তা যদিও রহস্যই থেকে গেলো।
আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের (আইএসএস) রহস্যে মোড়া এই পর্যবেক্ষণের গবেষণাপত্রটি গত ২২ জানুয়ারি প্রকাশিত হয়েছে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান-জার্নাল ‘নেচার’তে।
রহস্যে মোড়া এই আলোর ঝিলিক তৈরি হচ্ছে মেঘ-রাজ্যেরই খেয়ালখুশিতে। যাকে আমরা বিদ্যুৎ চমক (‘লাইটনিং’) বলে জানি। দেখি, মেঘ থেকে নেমে আসছে মাটিতে অথবা কোনো উঁচু গাছে বা কোনো সুউচ্চ অট্টালিকার উপর।
ভূপৃষ্ঠের ৩৫ থেকে ৪০ হাজার ফুট উপরে উড়তে উড়তে মাঝেমধ্যে এই আলোর ঝিলিক চোখে পড়ে আন্তর্জাতিক উড়ানের পাইলটদেরও। যার জেরে মেঘ-রাজ্যের উথালপাথালে আচমকা অনেকটা উপরে উঠে তার পর হু হু করে নীচে নেমে গিয়ে বেশ কয়েক বার বড়সড় দুর্ঘটনায় পড়তে হয়েছে আন্তর্জাতিক বিমানগুলোকে। প্রাণ বিপন্ন হয়েছে যাত্রীদের।
এই রহস্যাবৃত আলোর ঝিলিকে হামেশাই ব্যাঘাত ঘটে এফ এম রেডিও যোগাযোগব্যবস্থায়। নিঁখুত ভাবে রেডিও সিগন্যাল পাঠানো যায় না।
বিশেষজ্ঞদের ধারণা, আইএসএস’র এই পুঙ্খনাপুঙ্খ পর্যবেক্ষেণ এবার মেঘ-রাজ্য থেকে মহাকাশের দিকে ছুটে যাওয়া এই ‘ভুতুড়ে’ বিদ্যুৎ চমকগুলো থেকে আম্তর্জাতিক উড়ানগুলোকে বাঁচানোর পথ দেখাতে পারে। এফ এম রেডিও যোগাযোগব্যবস্থাকে অব্যাহত রাখারও পথ খুলে দিতে পারে।
ব্লু জেট
নীল রঙের এই ‘ভুতুড়ে’ বিদ্যুৎ চমকগুলোকে বিজ্ঞানের পরিভাষায় বলা হয় ‘ব্লু জেট’। যেগুলো তৈরি হয় মেঘ-রাজ্যের একেবারে নীচের স্তরে। যার নাম ‘ট্রপোস্ফিয়ার’। পৃথিবীর অক্ষাংশ অনুসারে যা ভূপৃষ্ঠের ৭ থেকে ১২ কিলোমিটার উপরে থাকে। তার পরেই শুরু হয় মেঘ-রাজ্যের পরের স্তর। ‘স্ট্র্যাটোস্ফিয়ার’। সেখানে পৌঁছেই এগুলো উধাও হয়ে যায়। যার পরের স্তর ‘মেসোস্ফিয়ার’। তার পরের স্তর ‘আয়নোস্ফিয়ার’।
আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারের মেঘ-রাজ্য থেকে এই বিদ্যুৎ চমকগুলোকে একের পর এক ছুটে যেতে দেখেছে মহাকাশের দিকে। বায়ুমণ্ডলের বিভিন্ন দিক থেকে।
১ সেকেন্ডে পৌঁছেছে ৫০ কিলোমিটার উচ্চতায়
নাসার জেট প্রোপালসন ল্যাবরেটরির (জেপিএল) একটি সূত্র জানাচ্ছে, এই ব্লু জেটগুলোকে ভূপৃষ্ঠের ১২ কিলোমিটার উপর থেকে ১ বা ২ সেকেন্ডের মধ্যে ৫০ কিলোমিটার উচ্চতার দিকে ছুটে যেতে দেখা গিয়েছে। তারপরই তারা উধাও হয়ে গিয়েছে।
‘তবে স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারের ঠিক কোন জায়গায় এই ব্লু জেটগুলির উৎপত্তি হচ্ছে, কী ভাবে হচ্ছে আর তারা ১/২ সেকেন্ডের মধ্যে মেসোস্ফিয়ারের ঠিক কোন জায়গায় পৌঁছে উধাও হয়ে যাচ্ছে, তা এখনো একেবারেই রহস্যাবৃত’, বলছেন কলকাতার ‘ইন্ডিয়ান সেন্টার ফর স্পেস ফিজিক্স’ (আইসিএসপি)-এর অধিকর্তা জ্যোতির্বিজ্ঞানী সন্দীপ চক্রবর্তী। ভারতে যারা বিদ্যুৎ চমক নিয়ে গবেষণা করেন, সন্দীপ তাদের অন্যতম।
বিদ্যুৎ চমক নিয়ে রহস্যের অবশ্য এখানেই শেষ নয়। সাধারণ ভাবে মেঘের সঙ্গে অন্তত ১০ লক্ষ ভোল্টের ফারাক ঘটলেই বিদ্যুৎ চমকের সৃষ্টি হয়।
স্প্রাইট্স এবং এলভ্স
ব্লু জেট ছাড়াও তিন ধরনের আলোর ঝিলিক দেখা যায় আমাদের এই বাসযোগ্য গ্রহের মেঘ-রাজ্যে।
তার একটির নাম ‘স্প্রাইট্স’। এগুলোর উৎপত্তি হয় স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারের ঠিক উপরের স্তর মেসোস্ফিয়ারে। এগুলোর রং লাল। এগুলো বায়ুমণ্ডলের উপরের স্তর থেকে নেমে আসে নীচের দিকে। পৃথিবীর দিকে।
অন্যটির নাম ‘এলভ্স’। যা আদতে আলোর বলয়। ‘রিং’। যা চার পাশে উত্তরোত্তর বেড়ে ওঠে মিলিয়ে যায়। পুকুরে জলের তরঙ্গের মতো। এগুলোর রং হয় সাদা ও সবুজ। এগুলি পৃথিবীর দিকে নেমে আসে না। আবার মহাকাশের দিকেও ছুটে যায় না।
আমরা হামেশাই ভূপৃষ্ঠ থেকে যে বিদ্যুৎ চমক দেখি, তার রং হয় সাদা ও হলদেটে। যাকে বলি ‘লাইটনিং’। সেগুলো মাটির দিকে নেমে আসে।
কেন রঙের তারতম্য আলোর ঝিলিকগুলোর?
সন্দীপ জানাচ্ছেন, আমরা যে বিদ্যুৎ চমক (লাইটনিং) দেখতে অভ্যস্ত, তাতে মেঘের গায়ে লেগে থাকা বিদ্যুতের আধানগুলি (ঋণাত্মক, মূলত ইলেকট্রন কণিকা) তুলনায় হাল্কা বলে নীচে নেমে আসে খুব দ্রুত গতিতে। তা ধাক্কা মারে বায়ুমণ্ডলে। সেই সজোর ধাক্কায় বায়ুমণ্ডলে থাকা নাইট্রোজেন ও অক্সিজেন অণু ভেঙে গিয়ে আয়নে পরিণত হয়। নাইট্রোজেন আয়নের নীল আর অক্সিজেন আয়নের লাল রং মিলেমিশে সাদা বা হলদেটে রং দেয় বিদ্যুৎ চমকগুলোর। মেসোস্ফিয়ারে স্প্রাইট্স তৈরি হয় মেঘেদের গায়ে লেগে থাকা ইলেকট্রন কণাদের ধাক্কায় বায়ুমণ্ডলের অক্সিজেন অণু ভেঙে গিয়ে অক্সিজেন আয়ন হয়ে যায় বলে। তাই এই বিদ্যুৎ চমকগুলোর রং লাল। একেবারে উপরে আয়নোস্ফিয়ারে মেঘেদের গায়ে লেগে থাকা ইলেকট্রন কণাগুলো বায়ুমণ্ডলে বেশি পরিমাণে থাকা নাইট্রোজেন পরমাণুগুলোকে ভেঙে আয়নে পরিণত করে বলে এলভ্স-এর রং হয় সাদা বা সবজেটে। নীল হয় না, কারণ অতোটা উপরের স্তরে বায়ুমণ্ডল অনেকটাই পাতলা হয়ে যায়। ফলে নাইট্রোজেন পরমাণুর সংখ্যাও সেখানে কম।
আর স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারে ব্লু জেটগুলো নীল রঙের হয় মেঘেদের গায়ে লেগে থাকা ইলেকট্রন কণাগুলো বায়ুমণ্ডলে থাকা নাইট্রোজেন পরমাণুগুলোকে ভেঙে আয়নে পরিণত করে বলে। বায়ুমণ্ডল সেখানে অনেকটাই ঘন। আর বায়ুমণ্ডলে নাইট্রোজেনের পরিমাণই বেশি।
ভুতুড়ে আলোর ঝিলিক ও দূষণ
সন্দীপ জানাচ্ছেন, ভূপৃষ্ঠের ৩৭০ কিলোমিটার উপরে থেকে পৃথিবীকে প্রদক্ষিণরত স্পেস স্টেশন থেকে এ বার যে এই প্রথম এতো ভালোভাবে এই রহস্যে মোড়া আলোর ঝিলিক দেখা গেলো, তার কারণ হতেই পারে, বায়ুমণ্ডলের অতো উঁচু স্তরেও দূষণ কণা অ্যারোসলের আধিক্য। এই কণাদের গায়ে লেগে থাকে প্রচুর পরিমাণে ঋণাত্মক আধান। ইলেকট্রন কণা। যারা মেঘেদের গায়ে লেগে থাকা কণাগুলোকে উপরের দিকে টেনে নেয় বলেই বায়ুমণ্ডলের ভেঙে যাওয়া নাইট্রোজেন আয়নগুলো উপরে মহাকাশের দিকে ছুটতে শুরু করে। ছড়িয়ে দেয় ভুতুড়ে নীল আলো। সূত্র: আনন্দবাজার পত্রিকা।
Posted ১৩:৪১ | শুক্রবার, ২৯ জানুয়ারি ২০২১
Swadhindesh -স্বাধীনদেশ | Athar Hossain