| রবিবার, ২৫ মার্চ ২০১৮ | প্রিন্ট
ডেস্ক রিপোর্ট : মেগাসিটি ঢাকায় প্রতিনিয়ত মানুষের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে যানবাহনের সংখ্যা। এতে তীব্র যানজটে দিশেহারা নগরবাসী। সিগন্যালে আটকা পড়ে কর্মব্যস্ত মানুষের পথেই নষ্ট হচ্ছে অনেকটা সময়। মহানগর পুলিশ প্রশাসন ও বিআরটিএ’র তথ্য অনুযায়ী, রাজধানীর সড়কগুলোতে যে পরিমাণ যানবাহন চলাচল করার ব্যবস্থা রয়েছে এর ১০ গুণ বেশি যানবাহন চলে। এরমধ্যে বেশিরভাগ ফুটপাত আবার দখল। এই দুর্ভোগের পাশাপাশি রাজধানীতে মূর্তিমান আতঙ্কা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে মোটর সাইকেল। নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে নগরীতে অনেকটা বেপরোয়া গতিতে চলছেন মোটর সাইকেল চালকরা। অনেক ক্ষেত্রে তারা সিগন্যাল তো দূরের কথা ভিআইপি সিগন্যালও মানেন না। আর রাজধানীর অধিকাংশ সড়কের ফুটপাতে মোটর সাইকেল চালানো যেন নিত্য-নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এতে বিরক্ত পথচারী। শুধু তাই নয়, ফুটপাতে মোটর বাইক চলাচল করায় প্রায়ই ঘটছে নানা ধরনের দুর্ঘটনা। এক্ষেত্রে আদালতের নির্দেশ উপেক্ষিত।
রাজধানীর ফার্মগেট থেকে পান্থপথ, গুলিস্তান, পল্টন, মালিবাগ, মগবাজার ফ্লাইওভার, খিলগাঁও ফ্লাইওভার, রামপুরা, মৌচাক, বাড্ডা, কুড়িল, গাবতলী, শ্যামলী থেকে নিউমার্কেট পর্যন্ত এলাকায় এই প্রতিবেদক গত তিনদিন সরেজমিনে গিয়ে মোটর সাইকেলের বেপরোয়া চালানোর চিত্র প্রত্যক্ষ করেছেন। দেখা গেছে, পুলিশের সামনেই দ্রুত গতিতে চলে যাচ্ছেন মোটর সাইকেল চালকরা। তীব্র হর্ন দিয়ে দুরন্ত গতিতে ফুটপাতের ওপর দিয়েই চলাচল করছেন। কোন কোন তরুণ চালক আঁকাবাঁকা করে দ্রুত গতিতে বাইক চালাচ্ছে। আবার চলন্ত যানবাহনের সামনে দিয়ে মোটর সাইকেল নিয়ে দ্রুত ঝুঁকি নিয়ে চলে যাচ্ছেন। এভাবে চলাচলের কারণে অন্যান্য যানবাহনের পাশাপাশি প্রতিদিনই ঘটছে মোটর বাইকের দুর্ঘটনা। এসব চালক দুর্ঘটনার কবলে পড়লে হেড ইঞ্জুরিতে মৃত্যু হওয়ার সম্ভবনাই বেশি। মজার ব্যাপার হলো, কয়েকটি পুলিশের বাইকে নেই কোন নম্বর। শুধু পুলিশ লেখা আছে। এসব বাইকে দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা অনেক। নাম্বার ছাড়া বাইক চালানো কয়েক জন চালক ইত্তেফাককে বলেন, দেখেন, পুলিশের বাইকে কোন নাম্বার নেই। যারা নিয়ম-কানুন বাস্তবায়ন করবে তাদের বাইকে নেই, তাহলে সাধারণ মানুষের বাইকে থাকবে কিভাবে। বৃহস্পতিবার ভিআইপি সিগন্যালও মানছিল না এক বাইক চালক। দুই দফা পুলিশের বাধায় তাকে আটকানো হয়। সুযোগ পেলেই ফাঁক-ফোকড় দিয়ে দ্রুত টান দিয়ে চলে যান বাইক চালকরা।
সময় বাঁচাতে নিয়মের বাইরে চলাচল করছেন মোটরসাইকেল চালকেরা। সিগন্যালে দীর্ঘ সময়েও যখন ট্রাফিক পুলিশের হাতের ইশারা মেলে না, তখন তারা একটু এদিক সেদিক দিয়ে চলে যাওয়ার চেষ্টা করেন। সুযোগমতো বাইক উঠিয়ে দেন ফুটপাতে। তীব্র হর্ন দিয়ে দুরন্ত গতিতে ফুটপাতের ওপর দিয়ে মোটরসাইকেল চলার দৃশ্য রাজধানীতে যেন স্বাভাবিক হয়ে গেছে। ক্ষুব্ধ পথচারীরা বলছেন, যে কোনো সভ্য দেশেই ফুটপাত পথচারীদের হাঁটার জন্য। কিন্তু আমাদের দেশে ফুটপাত পথচারীদের জন্য নয়। ফুটপাতে হকাররা ব্যবসা করে। যেখানে হকার নেই সেখানে আছে মোটরসাইকেলের দৌরাত্ম্য। পথচারীরা ফুটপাত ব্যবহারের সুযোগই পায় না। এছাড়া নগরীর অনেক ফুটপাত আবার ভাঙ্গা, চলাচলের অনুপযোগী। তাই পথচারীরা বাধ্য হয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা দিয়েই চলাচল করছেন। গতকাল শনিবার সকাল সাড়ে ৯টা। ফার্মগেট-শাহবাগ সড়কে দীর্ঘ যানজট। ফার্মগেটের একটু সামনে ফুটপাত দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন বেশ কয়েকজন নারী-পুরুষ। হঠাত্ একটি মোটরসাইকেল ফুটপাতে উঠে হর্ন বাজাতে বাজাতে বেপরোয়া গতিতে তাদের পাশ দিয়ে যেতে থাকে। হতবাক হয়ে পথচারীরা ফুটপাতের দু’পাশে ছিটকে পড়েন। এতে দু’জন পথচারী কিছুটা আহত হন। প্রতিবাদ করলে দুই মোটরসাইকেল আরোহী উল্টো তাদের গালিগালাজ করে চলে যান। শুধু এটি নয়, রাজধানীতে এমন ঘটনা এখন নিত্যনৈমিত্তিক। প্রায় প্রতিদিনই পথচারীদের সঙ্গে মোটরসাইকেল চালকদের ঝগড়াঝাটি হাতাহাতিতে গড়াচ্ছে। সড়কের পাশ দিয়ে হেঁটে চলার পথ ফুটপাতে প্রায়ই মোটরসাইকেল উঠে পড়ে। সকাল কিংবা রাত, ফুটপাত ধরে নিশ্চিন্তে হাঁটার অবস্থা নেই রাজধানীবাসীর। পেছন থেকে বিকট শব্দে হর্ন বাজিয়ে সাইড চাইছেন মোটরসাইকেল চালক। এতে প্রায়ই দুর্ঘটনাসহ নানা অঘটন ঘটছে। ফুটপাতের নিরাপত্তা আইন ও ফুটপাতে মোটরসাইকেল চালানো নিয়ে হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞা থাকার পরও এদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী।
ফুটপাতে মোটর সাইকেল চালানো নিয়ে নানা আলোচনার এক পর্যায়ে কয়েক বছর আগে বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছিল। আদালত রায় দেন, কোনো অবস্থায়ই পায়ে হাঁটার পথে মোটরবাইক চলবে না। এ আদেশের পরে নড়েচড়ে বসে পুলিশ প্রশাসন। প্রথমে সচেতনতামূলক কার্যক্রম। পরে অ্যাকশন-মামলা। কিন্তু তাতেও কাজ হয়নি। রাস্তায় জ্যাম হলেই ফুটপাতে মোটরসাইকেল চলতে দেখা যায়। সেক্ষেত্রে পুলিশ প্রসাশনও পিছিয়ে নেই। ফুটপাতে মোটরসাইকেল চলাচল বন্ধ করতে নতুন করে উদ্যোগ নেয় ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) ট্রাফিক বিভাগ। ফুটপাতের মাঝখানে লোহার পাইপ কিংবা বাঁশ পুতে ব্যারিকেড সৃষ্টি করা হয়েছে। কিন্তু কোন কিছুতেই যেন কাজ হচ্ছে না।
মোটরযান অধ্যাদেশ এবং ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ অ্যাক্ট অনুযায়ী, রাস্তায় বা জনগণের চলার জায়গায় কোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা যাবে না। যদি কেউ জনগণের স্বাভাবিক চলার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে তাকে জেল, আর্থিক জরিমানা অথবা জেল ও জরিমানা উভয়ই করতে পারবে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। তবে এসব আইন-কানুনের কোনো তোয়াক্কা করছেন না মোটরসাইকেল চালকরা। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর চোখের সামনেই রাজধানীর প্রায় সব রাস্তায় চলছে বেপরোয়া মোটরসাইকেল।
মিরপুরের বাসিন্দা ব্যাংক কর্মকর্তা তাহমিনা বলেন, সকালে বাসা থেকে বের হলেই দেখা মেলে অসহনীয় যানজটের। কর্মস্থলে যেতে বাসে ওঠা নিয়ে করতে হয় রীতিমতো যুদ্ধ। বাসে উঠতে না পারলে অপেক্ষা আর অপেক্ষা। এরপর অতিষ্ট হয়ে ফুটপাত ধরে হাঁটা। যানজটের কারণে অনেকে মাঝপথে বাস থেকে নেমে হাঁটা শুরু করেন। কিন্তু বিপত্তি দেখা দেয় সেখানেই। মোটর বাইকের কারণে ফুটপাতে যেন হাটাই যায় না। রাজধানীর কাওরান বাজারের হোটেল সোনারগাঁও সিগন্যালে কথা হয় বাইকচালক মনিরুজ্জামানের সঙ্গে। তিনি বলেন, রাস্তায় পুলিশের ব্যবহার দেখে মনে হয়, এই শহরে মোটরসাইকেল চালকেরা সবাই সন্ত্রাসী। তাদের হয়রানি করা হয়। অথচ রাস্তায় সবচেয়ে বেশি শৃঙ্খলা ভঙ্গ করে বাস, লেগুনা, সিএনজি চালিত অটোরিকশাসহ অন্যান্য যানবাহন। এসব যানবাহন রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে যাত্রী উঠানামা করাচ্ছে। এটা দেখার কেউ নেই। তিনি বলেন, সবার আগে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা দরকার। শুধু বাইকারদের পেছনে লেগে থেকে লাভ নাই। মত্স্য ভবন ও রমনা এলাকায় দায়িত্বরত একজন ট্রাফিক পুলিশ কর্মকর্তা জানান, অনেকেই ফুটপাত দিয়ে অবাধে মোটরসাইকেল চালান। তবে যারা এ কাজ করেন তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থাও আছে। ধরা পড়লে আইন অনুযায়ী তাত্ক্ষণিক ৫০০ টাকা জরিমানা করা হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদের বিরুদ্ধে থানায় মামলাও করা হয়। এ বিষয়ে ‘নিরাপদ সড়ক চাই’য়ের পক্ষ থেকে বলা হয়, জনগণকে সবার আগে সচেতন হতে হবে। তাহলেই সব সমস্যার সমাধান সম্ভব।
এ ব্যাপারে মহানগর পুলিশ কমিশনারন আছাদুজ্জামান মিঞা জানান, ফুটপাতে লোহার পাইপ দিয়ে চেষ্টা করেও ফুটপাত রক্ষা করা যায় না। এসব পাইপ ভেদ করেও বাইক ফুটপাতে উঠে যায়। জেবরা ক্রসিংসহ বিভিন্ন মার্কিং করার চিহ্ন থাকলেও কেউ কোন নিয়ম মানে না। আর মোটর বাইকতও পুরোপুরি ইচ্ছামতো চলছে। অর্থাত্ ৯৯ ভাগই নিয়ম মানছে না। এক্ষেত্রে নিজেরা সচেতন না হলেও পুলিশের একার পক্ষে সমস্যার সমাধান সম্ভব হবে না। তিনি বলেন, এখানে সামাজিক সমস্যা, আইন না মানার সমস্যা। সুশিক্ষিতরা গাড়ি চালান। কিন্তু তাদের মধ্যে আইন না মানার প্রবণতা বেশি। তাদেরই সচেতন হওয়া প্রয়োজন।
এদিকে রাজধানীতে কত মোটরসাইকেল আছে তার সঠিক হিসাব না থাকলেও ডিএমপি বলছে, ঢাকায় নিবন্ধনহীন মোটরসাইকেলের সংখ্যা নিবন্ধিত মোটরসাইকেলের চেয়ে দ্বিগুণ। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) হিসাব অনুযায়ী, গত বছরের নভেম্বর পর্যন্ত ঢাকায় মোটরসাইকেলের রেজিস্ট্রেশন হয়েছে ৪ লাখ ৩২ হাজার ৫১১টি। এর মধ্যে ২০১০ সাল পর্যন্ত রেজিস্ট্রেশন হয়েছে ২১ হাজার ৮১টি। ২০১১ সালে ৩৪ হাজার ৭০৮টি। ২০১২ সালে ৩২ হাজার ৮১০টি। ২০১৩ সালে ২৬ হাজার ৩৩১টি। ২০১৪ সালে ৩২ হাজার ৮৯৪টি। ২০১৫ সালে ৪৬ হাজার ৭৬৪টি এবং ২০১৬ সালের নভেম্বর পর্যন্ত ৪৮ হাজার ৯২৩টির রেজিস্ট্রেশন হয়েছে। সূত্র : সমকাল
Posted ১৩:৫৪ | রবিবার, ২৫ মার্চ ২০১৮
Swadhindesh -স্বাধীনদেশ | Athar Hossain