শুক্রবার ২৯শে মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১৫ই চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

বাসা-দোকানের মালামাল বেচে শূন্যহাতে ঢাকা ছাড়ছে মানুষ

  |   মঙ্গলবার, ০৭ জুলাই ২০২০ | প্রিন্ট

বাসা-দোকানের মালামাল বেচে শূন্যহাতে ঢাকা ছাড়ছে মানুষ

এক বুক আশা নিয়ে ঢাকায় এসেছিলেন ভোলার বোরহানউদ্দিন উপজেলার সবুজ মিয়া ও তার স্ত্রী ফাতেমা। দুই সন্তানকে নিয়ে ভালোই যাচ্ছিল তাদের দিন। কিন্তু করোনাভাইরাসের থাবায় তছনছ হয়ে গেছে সব স্বপ্ন। গত কয়েক মাস বসে বসে খেতে খেতে হাত খালি। ঘরের মালামাল বিক্রি করে বাড়ি ফিরে গেছেন সবুজ।

হবিগঞ্জের জসিম ১০ বছরের বেশি সময় ধরে ঢাকায়। ইডেন কলেজের সামনে কাপড়ের ব্যবসা করতেন। চার মাস ধরে কলেজ বন্ধ, বেচাকিনি বন্ধ। ব্যবসার কাপড়, ঘরের টিভি-ফ্রিজ বিক্রি করে ধারদেন শোধ করে ফিরে গেছেন গ্রামে।

টিউশিনির পাশাপাশি ফলের জুসের দোকান চালাতেন রাহাত। করোনায় টিউশনি গেছে, আড়াই মাস বন্ধের পর দোকান খুললেও বেচাবিক্রি নেই। দোকান আর বাসার সব মালামাল বিক্রি করে দেনা-পাওনা চুকিয়েছেন, শুক্রবার ফিরে যাবেন নিজের বাড়ি বিক্রমপুরে।

বৈশ্বিক মহামারি করোনার এই দুরবিপাকে চাকরি, ব্যবসা হারিয়ে সবুজ-জসিমের মতো বহু মানুষ ইতিমধ্যে ঢাকা ছেড়েছেন সপরিবারে। তাদের অনেকে ফিরে গেছেন শূন্য হাতে অনিশ্চিত এক জীবন মোকাবিলা করতে। আর যাদের কিছু জায়গা-জমি আছে, তাতে কিছু একটা করে জীবন নির্বাহের কথা ভেবেছেন কেউ।

প্রতিবেদনের শুরুতে যে সবুজের কথা এসেছে, তিনি বছর তিনেক আগে ঢাকায় এসেছিলেন। প্রাইভেটকার চালানো শেখার পর একটি চাকরি জুটে যায় তার। সংসারের উপার্জনে সবুজের স্ত্রী কবিতাও শামিল হন। অন্যের বাসায় কাজ করে তিনিও মাসে আয় করতেন হাজার পাঁচেক টাকা। দুজনের আয়ে স্বপ্ন ছিল দুই সন্তানকে ঢাকায় লেখাপড়া করাবেন।

দেশে করোনা সংক্রমণ শুরু হলে মার্চ মাসের মাঝামাঝি থেকে স্ত্রী কবিতার উপার্জন বন্ধ। গত এপ্রিলে চাকরি চলে যায় সবুজের। দুই মাস ঘুরেও অন্য কোথাও চাকরির ব্যবস্থা হয়নি। জমানো টাকা দিয়ে দুই মাস চলার পর শূন্য হাত সবুজের।

গত ১ জুলাই সাজানো সংসারটা বিক্রি করে দিয়ে স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে গ্রামে ফিরে গেছেন সবুজ মিয়া।

কণ্ঠে চাপাকান্না নিয়ে সবুজ ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘অনেক ইচ্ছা ছিল, পোলাপানগরে পড়াশোনা করামু। ঢাকার স্কুল-কলেজে পড়াইয়া বড় মানুষ বানামু। ওগো যেন আমাগো মতো কষ্ট করতে না হয়। কিন্তু কিছুই হইলো না।’

সবুজ বলেন, ‘অনেক কষ্ট কইরা, খাইয়া-না খাইয়া সংসারের একটা-একটা জিনিস জুটাইছিলাম। কিচ্ছু নিতে পারলাম না। এই জিনিসগুলা বাড়িতে নিয়া যাইতে যে খরচ, সেই টাকা আমার কাছে নাই। তাই সব এইখানে যে দাম পাইছি বিক্রি করে দিছি। এখন খালি হাতে বাড়ি যাইতাছি।’ চোখ ছলছল করে সবুজের।

করোনা ভাইরাসের কারণে উপার্জন বন্ধ হয়ে গিয়েছিল টাঙ্গাইলের ইউসুফ মিয়ার। গত জুনের শেষ দিকে সপরিবারে ঢাকা ছেড়ে যাওয়া ইউসুফ ঢাকা টাইমসকে জানান, ৫ বছরের বেশি সময় এই নগরে বসবাস করেন সপরিবের। মাসের আয়ের ওপর চলত তার সংসার। চাকরি হারানোর পর দুই মাস কোনো রকমে চলেছেন সামান্য জমানো টাকায়। যে বাসায় ভাড়া থাকতেন, সে বাড়ির মালিক এক মাসের জন্য তার সমস্যাটা দেখেননি। বাধ্য হয়ে ঘরের মালামাল বিক্রি করে ঘর ভাড়া পরিশোধ করে ঢাকা ছাড়েন তিনি।

রাজধানীর ইডেন মহিলা কলেজের সামনে ফুটপাতে কাপড় বিক্রি করতেন জসিম উদ্দিন। হাজারীবাগ এলাকার বাসিন্দা জসিমের সংসার চলত সেই আয় দিয়ে। গত ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনা ভাইরাসের রোগী শনাক্তের পর বন্ধ রয়েছে দেশের আর সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মতো ইডেন মহিলা কলেজ। এর প্রভাব পড়েছে জসিমের ব্যবসায়। চার মাস ধরে আয় নেই। পরিবারের খরচ চালাতে করতে হয়েছে ধারদেনা।

চার মাস পরও পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার লক্ষণ নেই। দেনা আরও বাড়লে শোধ দিতে পারবেন না। জুনের শেষ দিকে জসিম সিদ্ধান্ত নেন সপরিবারে ঢাকা ছাড়ার। ব্যবসায়ের মালামাল, ঘরের ফ্রিজ, টেলিভিশন বিক্রি করে ধারদেনা আর বাসা ভাড়া শোধ করেন এই ব্যবসায়ী। ঘরের বাকি মালামাল নিয়ে এই মাসের শুরুতে ফিরে গেছেন গ্রামের বাড়ি হবিগঞ্জে।

জসিম বলেন, ’১০ বছরের বেশি ঢাকায়। আমার ছোট ব্যবসা দিয়া থাকা-খাওয়া, বাচ্চাদের পড়াশোনা করাতাম। জমানো টাকা বলতে তেমন কিছু ছিল না। এই পাঁচ মাসে অনেক টাকা ঋণ করছি। ঢাকায় থাকলে চলার মতো আর ব্যবস্থা নাই। এমন একটা অবস্থা এখন ধার দেওয়ার মতোও কেউ নাই। তাই বাধ্য হয়ে গ্রামে ফিরে যাচ্ছি।‘

করোনাভাইরাস স্বপ্ন কেড়ে নিয়েছে রাহাত হোসেনের। বড় হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে ঢাকায় এসেছিলেন রাহাত। টিউশনি করে কিছু টাকা জমিয়ে ছিলেন। সেই টাকা দিয়ে লালবাগ কেল্লার কাছে ফলের জুস বিক্রির দোকান দিয়েছিলেন। দোকানের পাশাপাশি দুটি টিউশনিও করতেন। ধীরে ধীরে এগোচ্ছিলেন স্বপ্নের দিকে।

হঠাতই থমকে গেল রাহাতের স্বপ্নযাত্রা। শুধু তামা নয়, করোনাভাইরাস তাকে সেই সফলতার সিঁড়ি থেকে টেনে নামিয়ে আনল। মার্চ মাস থেকে টিউশনি বন্ধ। তিন মাস পর জুসের দোকান খুলতে পারলেও নেই ক্রেতা।

রাহাত বলেন, ‘টেউশনি তো লকডাউনের শুরু থেকেই বন্ধ। পুরো লকডাউনে দোকান বন্ধ ছিল। গত মাসে দোকান খুললাম। কিন্তু কাস্টমার নাই। কেল্লায় যারা ঘুরতে আসেন, তারাই মূলত আমার কাস্টমার। কেল্লা তো বন্ধ। তাই কাস্টমারও নাই। পাঁচ মাস বসে বসে দোকানের ভাড়া দিচ্ছি।’

আয়ের পথ বন্ধ হওয়ায় বাধ্য হয়ে গ্রামের পথ ধরেছেন রাহাত। এরই মধ্যে দোকানের সব মালামাল অন্যত্র বিক্রি করে দিয়েছেন। বিক্রি করেছেন বাসার আসবাবপত্র। সবার দেনা-পাওনা চুকিয়ে শুক্রবার যাবেন নিজ বাড়ি বিক্রমপুরে।

গ্রামে গিয়ে কী করবেন, এমন প্রশ্নের জবাবে রাহাত বলেন, ‘গ্রামে বড় হয়েছি। পড়াশোনা করেছি। চেয়েছিলাম ঢাকায় থেকে নিজের পায়ে দাঁড়াব। সবকিছু গুছিয়েও নিয়েছিলাম। কিন্তু ভাগ্যে সইল না। এখন গ্রামে গিয়ে সবজি চাষ করার প্লান আছে। নিজেদের কিছুটা জমি আছে, সেখানেই কিছু করার চেষ্টা করব।’ ঢাকাটাইমস

Facebook Comments Box
advertisement

Posted ১৩:০০ | মঙ্গলবার, ০৭ জুলাই ২০২০

Swadhindesh -স্বাধীনদেশ |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

advertisement
advertisement
advertisement
Advisory Editor
Professor Abdul Quadir Saleh
Editor
Advocate Md Obaydul Kabir
যোগাযোগ

Bangladesh : Moghbazar, Ramna, Dhaka -1217

ফোন : Europe Office: 560 Coventry Road, Small Heath, Birmingham, B10 0UN,

E-mail: news@swadhindesh.com, swadhindesh24@gmail.com