শুক্রবার ২৯শে মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১৫ই চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

পশুর হাটের ঘাটে ঘাটে চাঁদাবাজি

  |   সোমবার, ০৪ জুলাই ২০২২ | প্রিন্ট

পশুর হাটের ঘাটে ঘাটে চাঁদাবাজি

রাজধানীর পান্থপথ সিগন্যাল থেকে বারেক টাওয়ার। প্রায় দশমিক ২৫ কিলোমিটার দূরত্বের রাস্তায় দুই পাশে ছিল আড়াই থেকে তিন ফুট মাপের ফুটপাতের একেকটি দোকান। এখন এক পাশের ফুটপাত বাড়িয়ে করা হচ্ছে ১০ থেকে ১২ ফুটের দোকান। মূল রাস্তার পরিমাণ কমিয়ে এক পাশের ফুটপাত বড় করার কারণ খুঁজতে গিয়ে জানা যায় ভয়াবহ তথ্য। প্রতিটি দোকান থেকে ৭০ হাজার থেকে দেড় লাখ টাকা অ্যাডভান্স নেওয়া হচ্ছে। এক প্রভাবশালীর নেতৃত্বে স্থানীয় দু-তিনজনের একটি গ্রুপ ফুটপাতে দোকান বসানোর সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে।

 

নেপথ্যে থেকে তাদের মদদ দিচ্ছেন দুর্নীতিগ্রস্ত কিছু পুলিশ সদস্য। কারণ আশপাশের রাস্তার প্রতিটি দোকান থেকে লাইনম্যানের মাধ্যমে প্রতিদিন ১০০ টাকা উঠানোর পর এর বড় একটি অংশ তাদের পকেটে যায় দীর্ঘদিন ধরে। আজিমপুর ছাপড়া মসজিদ এলাকায় অবৈধ বাজার বসিয়ে দেদার চলছে চাঁদাবাজি। রাজু নামের এক লাইনম্যানের মাধ্যমে স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী ও দুর্নীতিগ্রস্ত পুলিশ সদস্য এসব দোকান বসিয়ে হাতিয়ে নিচ্ছে লাখ লাখ টাকা। ওই এলাকায় দোকান বসাতে হলে দিতে হয় ১০ থেকে ১৫, এমনকি ২০ হাজার টাকা। প্রতিদিন প্রতিটি দোকান থেকে নেওয়া হচ্ছে ১২০ থেকে ১৫০ টাকা। আজিমপুর ভিকারুননিসা স্কুল থেকে সাহেববাড়ি পর্যন্ত চাঁদা তুলছে শাহাবুদ্দিন নামে পুলিশের এক সোর্স। প্রতিটি দোকান থেকে নেওয়া হচ্ছে ৬০ থেকে ৮০ টাকা। শুধু পান্থপথ কিংবা আজিমপুর নয়, পুরো রাজধানীর ফুটপাতের চিত্র অনেকটা একই রকম। প্রতিদিন ফুটপাতের ৩ লাখ দোকান থেকে উঠছে প্রায় ৬ কোটি টাকা।

 

শুধু ফুটপাত নয়, বাদ যাচ্ছে না মানুষের শেষ ঠিকানা কবরস্থানও। আজিমপুর কবরস্থান ঘিরে সক্রিয় হয়ে উঠেছে একটি চক্র। কবরস্থানের ভিতরেই চলছে মাদক সেবন ও ব্যবসা। পছন্দসই জায়গায় কবর দিতে গেলেই মৃতের স্বজনদের গুনতে হচ্ছে ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা। স্থানীয় আরজু, কালা আক্তার ও শাজাহান নিয়ন্ত্রণ করছেন আজিমপুর কবরস্থান। তাদের চাহিদা অনুযায়ী চাঁদা না দিলে ২/৩ মাসের মাথায় গায়েব হয়ে যায় মৃত ব্যক্তির কবরের সামনে লাগানো সাইনবোর্ড। কবরস্থানের অফিস রুম থেকে মৃত ব্যক্তির রেকর্ড বা সনদ নিতে গেলেও গুনতে হয় ১ থেকে ২ হাজার টাকা।

 

এদিকে ঈদ ঘিরে আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে চাঁদাবাজরা। রীতিমতো চলছে চাঁদাবাজির মহোৎসব। পরিবহন সেক্টর থেকে শুরু করে কোরবানির পশুর হাট, কাঁচাবাজার, ফুটপাত, দোকানপাট, ছোট-বড় ব্যবসায়ীকে টার্গেট করে চলছে চাঁদাবাজি। বছরের অন্যান্য সময় নিয়মিত চাঁদা আদায় করলেও এখন ঈদ সামনে রেখে বাড়তি চাঁদা আদায় করা হচ্ছে। শুধু দেশের চাঁদাবাজ নয়, বিদেশে পলাতক আন্ডারওয়ার্ল্ডের শীর্ষ সন্ত্রাসীদের নামেও চাঁদা দাবি করা হচ্ছে। চাঁদা দিতে অপরাগতা প্রকাশ করলে দেওয়া হচ্ছে হুমকি-ধমকি। পরিবার-পরিজন ও নিজের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে অনেকেই নীরবে দিয়ে যাচ্ছেন চাঁদা। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের প্রধান এ কে এম হাফিজ আক্তার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘নগরীর অপরাধ দমনে আমরা আমাদের সর্বোচ্চটাই দেওয়ার চেষ্টা করি। তবে অবশ্যই তা যাচাই-বাছাইয়ের পর।’ চাঁদাবাজির ক্ষেত্রে লিখিত অভিযোগ দেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।

 

বাংলাদেশ হকার্স ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি এম এ কাশেম গণমাধ্যমকে বলেন, ‘লাইনম্যান নামধারী চাঁদাবাজরা হকারদের কাছ থেকে মাসে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। এসব লাইনম্যান অনেক মামলার আসামি। পুলিশ বাদী হয়ে এদের বিরুদ্ধে মামলা করেছে। কিন্তু তারা আদালত থেকে জামিন নিয়ে এসে আবার চাঁদাবাজি শুরু করে। সরকারের কাছে আহ্বান জানাই, প্রায় ৩ লাখ হকারের কাছ থেকে লাইনম্যানরা যে চাঁদা নিচ্ছে, সেগুলো সরকারের রাজস্ব খাতে যোগ করার ব্যবস্থা করলে হকাররা ভালোভাবে ব্যবসা করতে পারবেন। সরকারও লাভবান হবে।’ তিনি বলেন, ‘সারা বছরই চাঁদাবাজি হয়। কিন্তু ঈদ এলে চাঁদাবাজিটা দ্বিগুণ হয়ে যায়। লাইনম্যানরা হকারদের চাঁদা দিতে বাধ্য করে।

 

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দিনরাত ২৪ ঘণ্টা রাজধানীর গুলিস্তান, কাপ্তানবাজার, টিকাটুলিসহ বিভিন্ন এলাকায় রিসিট দিয়ে ভ্যান, ট্রাক, পিকআপ, লেগুনা থেকে গাড়িভেদে ২০ টাকা, ৩০ টাকা ও ৬০ টাকা করে চাঁদা নেওয়া হচ্ছে। চাঁদাবাজদের হাতে থাকে লাঠি। এসব রিসিটে লেখা রয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। এভাবে গুলিস্তান, জয়কালী মন্দির, কাপ্তানবাজার, সায়েদাবাদ, মতিঝিল, কমলাপুর, যাত্রাবাড়ী, জুরাইন, কদমতলী, পোস্তগোলা, শনিরআখড়া, রায়েরবাগ, কোনাপাড়া, ডেমরা স্টাফ কোয়ার্টার, মাতুয়াইল মেডিকেল, মেরাদিয়া, নন্দীপাড়া, মাদারটেক, যাত্রাবাড়ী থেকেও চাঁদা তোলা হচ্ছে।

 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কপোরেশনের (ডিএসসিসি) মহাব্যবস্থাপক শহিদুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘সায়েদাবাদ ও ফুলবাড়িয়া টার্মিনাল ছাড়া অন্য কোনো জায়গা থেকে চাঁদা আদায় অবৈধ। আর ট্রাকসহ পণ্যবাহী এসব পরিবহন থেকে চাঁদা নেওয়ার কোনো নির্দেশনা দেওয়া হয়নি। এভাবে চাঁদা নেওয়ার ঘটনা আমরা জানি না। খোঁজ নিয়ে দেখব। এমন হলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ তিনি বলেন, ‘কয়েক দিন আগে যাত্রাবাড়ী থানা পুলিশ একজনকে আটক করে। পরে আমরা যাচাই করে দেখলাম, তিনি সিটি করপোরেশন নির্ধারিত ইজারাদার নন। তিনি একজন চাঁদাবাজ। পরে তাকে মামলা দিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।’ ডিএসসিসি সূত্রে জানা যায়, প্রতিষ্ঠানটির আয় বাড়াতে ১২ নভেম্বর ২০২১ থেকে এক বছরের জন্য ৭-ইলেভেন এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী মো. আফতাব উদ্দিনকে ৫ কোটি টাকার চুক্তিতে ইজারাদার নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। যানবাহনের ধরন এবং কোন কোন স্থান থেকে সিটি টোল আদায় করা যাবে, তা নির্ধারণ করে দেওয়া আছে। তবে সেই কার্যাদেশের কোথাও পণ্যবাহী ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান থেকে টোল আদায়ের নির্দেশনা নেই।

 

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, পেশাদার চাঁদাবাজরা বছরজুড়েই চাঁদা তোলে। পরিবহনে চাঁদাবাজির কারণে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজারে অস্থিরতা বিরাজ করছে। দেশে পণ্য পরিবহনের জন্য প্রায় ৩ লাখ ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যান রয়েছে। এসব ট্রাক থেকে মাসে তোলা হয় হাজার কোটি টাকার চাঁদা। পশুর হাটগুলোর ইজারাদার কাগজেপত্রে একজন হলেও কয়েক দফা হাতবদল হয়। হাসিলের বাইরে গরুর কারবারির কাছ থেকেও নেওয়া হয় বিভিন্ন অঙ্কের টাকা। প্রভাব পড়ে গরুর দামে। তবে সবকিছু জেনেও রহস্যজনক কারণে নীরব সংশ্লিষ্টরা।

 

২০২০ সালে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, রাজধানীতে মোট হকার আছেন ৩ লাখ, যাদের গড়ে ১৯২ টাকা করে দৈনিক চাঁদা গুনতে হয়। তবে দিন যত যাচ্ছে ততই চাঁদার পরিমাণ বাড়ছে।

 

র‌্যাব সদর দফতরের ইন্টেলিজেন্স উইংয়ের পরিচালক লে. কর্নেল মো. মশিউর রহমান জুয়েল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, অপরাধী সে যে-ই হোক না কেন, আইনের চোখে সবাই সমান। যে কোনো ধরনের অপরাধের বিষয়ে র‌্যাবকে অবহিত করার পরামর্শ দেন তিনি।

 

সূত্রমতে, শুধু পণ্য পরিবহন সেক্টর নয়, যাত্রীবাহী বাস, লেগুনাসহ অন্যান্য পরিবহন থেকেও তোলা হয় চাঁদা। ঈদে যাত্রীদের চাপ থাকায় পরিবহন সেক্টরে বাড়তি আয় হয়। সেই সুযোগে চাঁদাবাজরাও বাড়তি চাঁদা আদায় করে। বিভিন্ন পাড়া-মহল্লার ছোটখাটো দোকান থেকে শুরু করে ঢাকার পাইকারি বাজার এলাকায় চলে বড় অঙ্কের চাঁদাবাজি। এর বাইরে শিল্পপতি, বাড়িওয়ালা, নতুন নির্মাণাধীন ভবন, বেসরকারি ক্লিনিক, হাসপাতাল থেকেও চাঁদা তোলা হয়। চলতি বছর চাঁদাবাজি নিয়ে এখনো কোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটলেও বিভিন্ন সেক্টরের মানুষ আতঙ্কে রয়েছেন। ঈদ এলেও এসব সেক্টরের আশপাশে চাঁদাবাজদের আনাগোনা বেড়ে যায়। কোথাও সরাসরি, আবার কোথাও মাধ্যম ধরে চাওয়া হচ্ছে চাঁদা। বাংলাদেশ হকার ফেডারেশনের দেওয়া তথ্যমতে, ঢাকা শহরে নিয়মিত হকার আছেন প্রায় ৩ লাখ। বছরের অন্যান্য সময় ছোট হকারদের কাছ থেকে ১০০ টাকা ও বড় হকারদের কাছ থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত আদায় করেন লাইনম্যানরা। এলাকাভেদে হিসাবটা কমে-বাড়ে। নিয়মিত হকারের পাশাপাশি মৌসুমি হকাররা ঈদ সামনে রেখে ব্যবসা শুরু করেন। এ সময় ৫০ হাজারের মতো মৌসুমি হকার থাকেন। এসব হকার শুধু একটি স্থানে বসার জন্য চাঁদা দেন এককালীন ২০ হাজার টাকা থেকে শুরু করে ৩০ হাজার পর্যন্ত। এর বাইরে দৈনিক চাঁদা দিতে হয়।

 

সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী ও পণ্য পরিবহনের সঙ্গে জড়িত চালকরা অভিযোগ করে বলেন, সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, বিভিন্ন ফেরিঘাট, ওজন স্টেশন, বাজার কমিটি, পরিবহন সংগঠন ও শ্রমিক ইউনিয়ন, ট্রাফিক পুলিশ, হাইওয়ে পুলিশের পাশাপাশি থানা পুলিশের নামেও চাঁদা তোলা হয়। এর সঙ্গে ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীরাও জড়িত। এই ১০টি ধাপে চাঁদাবাজির কারণে ক্রেতার হাতে পণ্য পৌঁছাতে দাম বেড়ে যায়। বেশ কিছুদিন ধরে বিভিন্ন ধরনের পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় মানুষের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। ব্যবসায়ীরা বলছেন, পণ্য পরিবহনের অতিরিক্ত খরচ, ঘাটে ঘাটে চাঁদাবাজি, অব্যবস্থাপনা এবং সর্বোপরি পণ্য হাতবদল বেশি হওয়ায় ভোগ্যপণ্যের বাজার দিন দিন অস্থির হয়ে উঠছে।  সূএ: বাংলাদেশ প্রতিদিন

Facebook Comments Box
advertisement

Posted ০৮:১২ | সোমবার, ০৪ জুলাই ২০২২

Swadhindesh -স্বাধীনদেশ |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

advertisement
advertisement
advertisement
Advisory Editor
Professor Abdul Quadir Saleh
Editor
Advocate Md Obaydul Kabir
যোগাযোগ

Bangladesh : Moghbazar, Ramna, Dhaka -1217

ফোন : Europe Office: 560 Coventry Road, Small Heath, Birmingham, B10 0UN,

E-mail: news@swadhindesh.com, swadhindesh24@gmail.com