শুক্রবার ২৯শে মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১৫ই চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

নারায়ণগঞ্জের ত্রাস কে এই পলাশ?

  |   রবিবার, ০৬ মে ২০১৮ | প্রিন্ট

নারায়ণগঞ্জের ত্রাস কে এই পলাশ?

অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছেন ফতুল্লার শ্রমিক লীগ নেতা কাউসার আহমেদ পলাশ। সরকার, প্রশাসন, দল— কোনো কিছুরই তোয়াক্কা করেন না তিনি। দেশের বৃহত্তম রপ্তানি খাত নিটশিল্পের প্রধান কেন্দ্র ফতুল্লার বিসিক পল্লীর শত শত গার্মেন্ট মালিক-শ্রমিক অসন্তোষের আড়ালে পলাশের চাঁদাবাজির কাছে জিম্মি। শুধু ফতুল্লাতেই পলাশের ৭৪টি শ্রমিক সংগঠন রয়েছে; যার সব কটির শীর্ষপদই তার দখলে। আর ফতুল্লা আঞ্চলিক শ্রমিক লীগের সভাপতির পদটি দীর্ঘ ১৩ বছর ধরে নিজের কব্জায় ধরে রেখেছেন। তার এসব শ্রমিক সংগঠনের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে কানাডিয়ান নাগরিকের মালিকানাধীন র‌্যাডিকেল গার্মেন্ট, হামিদ ফ্যাশন, পাইওনিয়ার সোয়েটার, আর এস সোয়েটার, মিশওয়ার হোসিয়ারি, এন আর নিটিং, মাইক্রো ফাইবার, মেট্রো নিটের মতো প্রায় ৩৬টি গার্মেন্ট বন্ধ হয়ে গেছে। অনেক প্রতিষ্ঠান নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকায় চলে গেছে। যারা টিকে আছে তার অনেককেই কৃত্রিম শ্রমিক অসন্তোষের ভয়ে গুনতে হচ্ছে মোটা অঙ্কের চাঁদা। নারায়ণগঞ্জের বহুল আলোচিত সাত খুন মামলার ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত নূর হোসেনের সাম্রাজ্যের মতোই ফতুল্লায় গড়ে তুলেছেন আলাদা আরেক সাম্রাজ্য। যেখানে সব কথার শেষ কথা পলাশ। দিনের পর দিন অপকর্ম করে গেলেও তার বিরুদ্ধে কথা বলার কেউ নেই। জাতীয় শ্রমিক লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির শ্রমিক উন্নয়ন ও কল্যাণবিষয়ক সম্পাদক পলাশ যেন এখন সন্ত্রাসের মহিরুহে পরিণত হয়েছেন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এক পলাশেই ঘটছে নারায়ণগঞ্জের সর্বনাশ। সরেজমিন জানা গেছে, ফতুল্লার কয়েক হাজার অবৈধ অটোরিকশার চাঁদাবাজিও পলাশের নিয়ন্ত্রণে। এতে ফতুল্লার তিনটি ইউনিয়ন থেকে উঠে গেছে প্যাডেলচালিত রিকশা। ফতুল্লার কয়েক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে বহমান বুড়িগঙ্গা নদী দখল করে অবৈধ বালু আর পাথরের ব্যবসার একচ্ছত্র আধিপত্যও পলাশের কব্জায়। ইতিমধ্যেই বুড়িগঙ্গা নদী দখলমুক্ত রাখতে সরকারের কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত ওয়াকওয়ে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছেন। পাগলা থেকে আলীগঞ্জ পর্যন্ত কয়েক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে নির্মিত ওই ওয়াকওয়ে ভেঙে ফেলায় তার বিরুদ্ধে ৩ মে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) যুগ্মপরিচালক (বন্দর) এ কে এম আরিফ উদ্দিন বাদী হয়ে ফতুল্লা থানায় জিডি করেন। তবে এ জিডি পলাশের দখলদারিত্বে কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি। ভুক্তভোগীরা বলছেন, কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের এক শীর্ষ নেতা তার (পলাশ) বাড়িতে আসার পর থেকে যেন বাদশাহ হয়ে উঠেছেন তিনি।

একনেক অনুমোদিত কাজে বাধা : ফতুল্লার আলীগঞ্জে গণপূর্ত অধিদফতরের জমিতে প্রধানমন্ত্রীর ঐকান্তিক ইচ্ছায় একনেকে অনুমোদন পাওয়া সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য আটটি ১৫ তলা ভবনের ৬৭২টি ফ্ল্যাট নির্মাণ প্রকল্পে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছেন পলাশ। আলীগঞ্জ মাঠ রক্ষার আন্দোলনের নেপথ্যে তিনি মূলত ওই প্রকল্পের ঠিকাদারি কাজে ভাগ বসাতে সরকারি কাজে বাধা দেন; যার ফলে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান পিবিএল-ডিসিএলের (জেভি) পক্ষে গত বছরের ১২ নভেম্বর ফতুল্লা থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করা হয়; যার বিপরীতে ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয় পুলিশ। ফলে নতুন করে ওই প্রকল্পের কাজে বাধা, প্রাণনাশের হুমকি ও মালামাল লুটের অভিযোগ এনে অবৈধ দখলদারদের বিরুদ্ধে গণপূর্ত বিভাগের নারায়ণগঞ্জ জেলার নির্বাহী প্রকৌশলীর পক্ষে উপসহকারী প্রকৌশলী হাফিজুর রহমান ৩ মে ফতুল্লা থানায় আরও একটি সাধারণ ডায়েরি (নম্বর ১১৯) করেছেন। কিন্তু পলাশের ভয়ে তার নামটি পর্যন্ত মুখে আনতে সাহস পাচ্ছেন না সরকারি কর্মকর্তা থেকে শুরু করে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানও। বিআইডব্লিউটিএর যুগ্মপরিচালক (বন্দর) এ কে এম আরিফ উদ্দিনের জিডিতে বলা হয়, নদী ও নদীর তীরভূমি রক্ষায় হাই কোর্টের নির্দেশে বুড়িগঙ্গায় নির্মিত ফতুল্লার পাগলা বাজার থেকে আলীগঞ্জ পর্যন্ত এলাকায় ওয়াকওয়ে ভেঙে ফেলা হয়েছে। নদীর বিপুল অংশ অবৈধভাবে ভরাট করে ইট, বালু, পাথর রেডিমিক্সের ব্যবসা পরিচালনা করছেন আলীগঞ্জনিবাসী মৃত ইদ্রিস আলীর ছেলে কাউসার আহমেদ পলাশ এবং তার নেতৃত্বে কতিপয় অসাধু ব্যক্তি; যার ফলে নদীর পাড়ে গড়ে ওঠা স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হয়ে গেছে। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান পিবিএল-ডিসিএলের জিডিতে বলা হয়, গত বছরের ৮ ও ১১ নভেম্বর সকালে রমজান ও হান্নানের নেতৃত্বে ১৫-২০ জন লোক নিয়ে প্রকল্পের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে কাজ বন্ধ করার হুমকি দেন।

অনুগত চার খলিফা : পলাশের অত্যন্ত বিশ্বস্ত শাহাদাত হোসেন সেন্টু, আবুল, মোকাররম ও আজিজুল হক চার খলিফা নামে পরিচিত। এ চারজন নিয়ন্ত্রণ করেন তার টাকা হাতানোর বিভিন্ন সেক্টর। ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ পুরাতন সড়কের দুই পাশে পরিবহনের পণ্য লোড-আনলোড সেক্টর নিয়ন্ত্রণ করেন মোকাররম। কথায় কথায় নিজেকে তিনি রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের ঘনিষ্ঠজন বলে জাহির করেন। লেবার সর্দার মোকাররম মাত্র পাঁচ বছরে কোটিপতি বনে গেছেন। তিনি এখন বাংলা সিনেমায় কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগকারী প্রযোজক। শহরের জামতলা এলাকায় কিনেছেন দেড় কোটি টাকার বাড়ি, চড়েন অর্ধ কোটি টাকা দামের গাড়িতে, গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জে যান হেলিকপ্টারে। করেছেন বাবার নামে কলেজ। সূত্র জানায়, লোড-আনলোড থেকে মোকাররমের মাধ্যমে পলাশের আয় মাসে কমপক্ষে ৬০ লাখ টাকা। এ ছাড়া বিভিন্ন বৃহৎ শিল্পপ্রতিষ্ঠানের বিদেশ থেকে আসা পাথরও সরিয়ে ফেলা হয় এসব ঘাট থেকে। অন্যদিকে পলাশের হয়ে গার্মেন্ট সেক্টরের দেখভাল করেন শাহাদাত হোসেন সেন্টু। বেতন-ভাতা বা কোনো কারণে শ্রমিকদের সঙ্গে মালিকদের বনিবনা না হলেই সেন্টুর লোকেরা সেখানে শ্রমিকদের উসকে দিয়ে প্রতিষ্ঠানের কাজ বন্ধ করে দেন। বাধ্য হয়ে মালিকরা ধরনা দেন পলাশের কাছে। শুরু হয় দরকষাকষি, রফা না হলেই বন্ধ হয়ে যায় প্রতিষ্ঠান। পলাশের চাঁদাবাজির অন্যতম বড় সেক্টর সরকারি অনুমোদনবিহীন ব্যাটারিচালিত রিকশা ও ইজিবাইক। প্যাডেলচালিত রিকশা (ব্যাটারিচালিত) মালিক-শ্রমিক সংগ্রাম পরিষদের যুগ্ম-আহ্বায়ক আজিজুল হক জানান, এই পরিষদের নামে ১৯টি কমিটি রয়েছে। কমিটির অধীন রয়েছে ৪ হাজার রিকশা। আর ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক মালিক-শ্রমিক ঐক্য জোট নামে চারটি কমিটি রয়েছে। এসব কমিটির অধীন ইজিবাইক রয়েছে ৮০০। শ্রমিক লীগ নেতা কাউসার আহমেদ পলাশের জন্য প্রতিটি রিকশা থেকে মাসে ১০০ ও ইজিবাইক থেকে ৩০০ টাকা চাঁদা আদায় করা হয়। পলাশের চাঁদাবাজির অন্য সেক্টর আলীগঞ্জ ও পাগলার বিশাল ট্রাকস্ট্যান্ড। কয়েক হাজার ট্রাক থেকে তার চাঁদাবাজির পরিমাণ মাসে প্রায় অর্ধ কোটি টাকা।

বুড়িগঙ্গার তীরে ওয়াকওয়ে দখল ভাঙচুর : নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার ফতুল্লার পোস্ট অফিস থেকে আলীগঞ্জ পর্যন্ত বুড়িগঙ্গার তীর ও ওয়াকওয়ে দখল করে অবৈধভাবে ব্যবসা পরিচালনা ও ভাঙচুরের অভিযোগে জিডি করেছে বিআইডব্লিউটিএ ঢাকা বন্দর। এতে পলাশ ও তার সাঙ্গোপাঙ্গদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে। বলা হয়েছে, সরকার কর্তৃক নির্মিত ওয়াকওয়ে তারা অন্যায়ভাবে ব্যবহার ও ব্যবসার কারণে তা ভেঙে ফেলেছে। জানা গেছে, আলীগঞ্জে টিসিবির ভবন সংলগ্ন এলাকা থেকে পিডব্লিউডি খেলার মাঠ পর্যন্ত দখলে রেখেছেন পলাশ। আলীগঞ্জ মাদ্রাসাসংলগ্ন ঘাট থেকে কয়েক শ ফুট ওয়াকওয়ে এখন আর নেই। আলীগঞ্জ মাদ্রাসা ঘাটে নদীর তীর দখল করে বসানো হয়েছে দুটি বিশালাকারের ক্রেন। দু-তিনটি এক্সাভ্যাটরও (ভেকু) রয়েছে। অবাধে চলছে বালু, কয়লার লোড-আনলোডিং কার্যক্রম। স্তূপীকৃত করে রাখা হয়েছে বালু ও কয়লা। স্থাপন করা হয়েছে একাধিক বাঁশের জেটি। এসব নিয়ন্ত্রণে রয়েছেন কাউসার আহমেদ পলাশ। এ ছাড়া আলীগঞ্জ পিডব্লিউডি মাঠের শেষ প্রান্তে বুড়িগঙ্গার তীরে অসংখ্য কাঠের গুঁড়ি স্তূপ করে রাখা হয়েছে। বিআইডব্লিউটিএ ঢাকা নদীবন্দরের যুগ্মপরিচালক আরিফ উদ্দিন জানান, ফতুল্লা, আলীগঞ্জ, পাগলা বাজার এলাকার ওয়াকওয়ে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত করে এলাকার কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি ব্যবসা করছেন। এখানে অনেকেই কাউসার আহমেদ পলাশের নাম বলেছেন। তার নেতৃত্বে ওখানে রশিদ হাজী, সেন্টুসহ বেশকিছু প্রভাবশালী লোক এ কাজ করছেন। মূলত এর মধ্যে পলাশের নামই বেশি শোনা যাচ্ছে। তার ছত্রচ্ছায়ায় এগুলো হচ্ছে। যারা এখানে নতুন নতুন গদি বানাচ্ছেন শোনা যাচ্ছে পলাশ এগুলো উদ্বোধন করছেন। ফতুল্লা মডেল থানার ওসি মঞ্জুর কাদের জানান, এ ব্যাপারে থানায় জিডি হয়েছে। জিডির তদন্ত করে প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

মাদক ব্যবসায়ীর কক্সবাজার ভ্রমণ : সম্প্রতি ফতুল্লায় পলাশের বিরুদ্ধে সংবাদ প্রকাশের জেরে একটি জাতীয় দৈনিকের ফতুল্লা প্রতিনিধি আল-আমিনের চামড়া তুলে নেওয়ার হুমকি দিয়ে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভে অংশ নেন মোল্লা মামুন নামে এক মাদক ব্যবসায়ী। ফতুল্লার সস্তাপুর গাবতলা এলাকার জামাই মতিনের ছেলে মোল্লা মামুন। তিনি গত বছরের ১১ জানুয়ারি পুলিশের হাতে ইয়াবাসহ গ্রেফতার হন। ফতুল্লা মডেল থানার এসআই কামরুল হাসান তাকে গ্রেফতার করে মোবাইল কোর্টে হাজির করেন। এরপর আদালতে দোষ স্বীকারের পর মোল্লা মামুনকে ১৫ দিনের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। ২০১৩ সালের ২০ জানুয়ারি জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সামনে থেকে ট্রাকভর্তি ৫০০ বোতল ফেনসিডিলসহ মামুনকে গ্রেফতার করা হয়। ফতুল্লা পুলিশ ও জেলা ডিবির চিহ্নিত ইয়াবা ব্যবসায়ী মোল্লা মামুন। এদিকে মোল্লা মামুনের ফেসবুক আইডিতে দেখা যায়, কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে পলাশের সঙ্গে ঘুরছেন আর মোবাইলে সেলফি তুলছেন। মোল্লা মামুন একটি সেলফি তার ফেসবুকে পোস্টও করেছেন। এলাকাবাসী জানান, মোল্লা মামুন শ্রমিক লীগ নেতা পলাশের ছত্রচ্ছায়ায় থেকে ফেনসিডিল ও ইয়াবা ব্যবসা করে আসছেন। বিডি প্রতিদিন

Facebook Comments Box
advertisement

Posted ১৩:৩৩ | রবিবার, ০৬ মে ২০১৮

Swadhindesh -স্বাধীনদেশ |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

advertisement
advertisement
advertisement
Advisory Editor
Professor Abdul Quadir Saleh
Editor
Advocate Md Obaydul Kabir
যোগাযোগ

Bangladesh : Moghbazar, Ramna, Dhaka -1217

ফোন : Europe Office: 560 Coventry Road, Small Heath, Birmingham, B10 0UN,

E-mail: news@swadhindesh.com, swadhindesh24@gmail.com