বৃহস্পতিবার ২৫শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১২ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর এর মত্যু: এক হৃদয় বিদারক ঘটনা

  |   মঙ্গলবার, ০৬ মে ২০১৪ | প্রিন্ট

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর এর মত্যু: এক হৃদয় বিদারক ঘটনা

muhammed 2

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর মৃত্যু সম্পর্কে অনেক মুসলমানের মাঝে অস্পষ্টতা ও বিভ্রান্তি রয়েছে। মুসলমানদের মাঝে তো একদল মানুষ বিশ্বাস করেন, তিনি মৃত্যু বরণ করেন নি। তিনি আমাদের মতই কবরে জীবিত আছেন। যার কারণে, তাঁকে তারা হায়াতুন্নবী হিসেবে উল্লেখ করে থাকেন। ইত্যাদি কারণে আজকের পোস্টটি অতি গুরুত্বের দাবি রাখে।  এই পোস্টে যে সকল বিষয় আলোচিত হয়েছে সেগুলো হল:

১) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর বিদায়ের পূর্বাভাষ।

২) অসুখের সূচনা।

৩) মৃত্যুর পূর্বে ওছীয়ত।

৪) জীবনের শেষ দিন।

৫) মৃত্যুর পূর্বক্ষণ।

৬) গোসল ও দাফন ও জানাযা।

৭) শেষ কথা।

তবে আর দেরি নয়। এবার উক্ত পয়েন্টগুলোর ধারাবাহিক আলোচনায় আসা যাক।

১) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর বিদায়ের পূর্বাভাষ:

নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর দাওয়াতী জীবন পূর্ণ হয়ে গেল। ইহকাল থেকে বিদায়ের নিদর্শন সমূহ তাঁর কাছে প্রতিভাত হতে লাগল। তিনি তা অনুভবও করতে লাগলেন। দশম হিজরী সনের রামাযান মাসে তিনি বিশ দিন ইতেকাফ করলেন। অথচ তিনি আগে মাত্র দশদিন ইতেকাফ করতেন। জিবরীল (আঃ) তাঁকে সাথে নিয়ে কুরআন দুই বার অধ্যায়ন করেন। বিদায় হজ্জে তিনি বলেনঃ “জানিনা, সম্ভবত আমি পরবর্তী বছর এই স্থানে আর তোমাদের সাথে সাক্ষাৎ করতে পারব না।”

১১ হিজরীর সফর মাসের শেষের দিকে নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ওহুদ প্রান্তরে গেলেন এবং জীবিতরা যেভাবে মৃতদের শেষ বিদায় জানায়, সেভাবে শহীদদের জন্য দুআ করলেন। কোন এক রাতের মধ্য ভাগে তিনি বাকী গোরস্থানে গিয়ে মৃতদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করলেন, বললেনঃ “হে কবরবাসি! তোমাদের প্রতি সালাম। তাদেরকে শুভ সংবাদ দিলেনঃ নিশ্চয় অচিরেই আমরা তোমাদের সাথে মিলিত হব।”

অসুখের সূচনাঃ

১১হিজরীর ২৯শে সফর সোমবারের দিন রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)  বাক্বী কবরস্থানে একটি জানাযায় শরীক হন। ফেরার পথে তাঁর মাথা ব্যথা শুরু হয়, তাপমাত্রা চরমে উঠে। এমনকি মাথার পটির উপর দিয়েও তা অনুভব করা যাচ্ছিল। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর অসুখ বেশী হয়ে গেল। তিনি বিবিদের জিজ্ঞাসা করতে লাগলেনঃ আগামী দিন আমি কোথায়? আগামী দিন আমি কোথায়? তাঁরা তাঁর উদ্দেশ্য বুঝতে পারলেন। তাই তারা ইচ্ছানুযায়ী তাঁকে থাকার অনুমতি দিলেন। তিনি আয়েশার (রাঃ) ঘরে স্থানান্তরিত হলেন। আয়েশা (রা:) মুআওবেযাত (সূরা ইখলাস, ফালাক্ব ও নাস) ও নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) থেকে মুখস্ত করা দুআগুলো পড়ে পড়ে তাঁর শরীরর মুবারকে ফু দিলেন এবং (বরকত লাভের আশায়) নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর পবিত্র হাতকেই তাঁর দেহে ফিরালেন।

মৃত্যুর পূর্বে ওছীয়তঃ মৃত্যুর পাঁচ দিন পূর্বে নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর শরীরের তাপমাত্রা আরো চরমে উঠে। তারা তাঁকে পানির পত্রের নিকট বসালেন এবং শরীরে পানি ঢালতে লাগলেন। এক সময় তিনি বললেনঃ যথেষ্ট হয়েছে, যথেষ্ট হয়েছে। সেসময় তিনি নিজেকে হালকা মনে করায় মসজিদে প্রবেশ করত: মেম্বারে বসলেন। তখন তিনি মাথায় পটি বাঁধা ছিলেন। চার পাশের উপস্থিত জনতাকে লক্ষ করে বক্তৃতা দিলেন। বললেনঃ

لعنة الله على اليهود والنصارى اتخذوا قبور أنبيائهم مساجد

“আল্লাহর অভিশম্পাত ইয়াহুদ ও খৃষ্টানদের প্রতি। তারা তাদের নবীদের (আ:) কবর সমূহকে মসজিদ বানিয়ে নিয়েছে।” (বুখারী ও মুসলিম)
তিনি আরও বলেনঃ اللهم لاتجعل قبري وثنا يعبد  “হে আল্লাহ! আপনি আমার কবরকে পুজার স্থানে পরিণত করো না।” (মুসনাদ আহমাদ প্রভৃতি)

অতঃপর তিনি মিম্বার হতে নেমে যোহরের নামায আদায় করলেন। আবার ফিরে গিয়ে মিম্বারে বসলেন। অতঃপর আনছার ছাহাবীদের ব্যাপারে ওছীয়ত করলেন। তারপর বললেনঃ  “আল্লাহ্‌ তাঁর এক বান্দাকে দুনিয়ার নয়নাভিরাম বিষয় গ্রহণ ও তাঁর নিকট যা রয়েছে তা গ্রহণের স্বাধীনতা দিলে তিনি আল্লাহর নিকট যা রয়েছে (পরকালে) তাই গ্রহণ করে নিয়েছেন।

আবূ সাঈদ খুদরী বলেনঃ এতদা শ্রবণে আবূ বকর (রা) কেঁদে ফেললেন আর বলতে লাগলেনঃ (হে রাসূল!) আপনার জন্য আমাদের পিতা-মাতা কুরবান হোক। আমরা আশ্চাম্বিত হলাম।  পরে জানতে পারলাম যাকে তা বেছে নেয়ার এখতিয়ার দেয়া হয়েছে তিনিই হলেন রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)। আবূ বকর আমাদের মধ্যে সর্বাধিক জ্ঞানী  ছিলেন। এরপর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেনঃ যিনি আমাকে সঙ্গ দিয়ে ও ধন-সম্পদ দিয়ে সব থেকে বেশি ইহসান করেছেন তিনি হলেন আবূ বকর (রা)। আমি আমার প্রতিপালক ব্যতীত অন্য কাউকে যদি খলীল (অন্তরঙ্গ বন্ধু) রূপে গ্রহণ করতাম তবে অবশ্যই আবূ বকরকে খলীল (অন্তরঙ্গ বন্ধু) হিসেবে গ্রহণ করতাম। তবে ইসলামিক ভ্রাতৃত্ব ও মহব্বত অবশ্যই রয়েছে। মসজিদ অভিমুখে কোন দরজা খোলা থাকবেনা শুধুমাত্র আবূ বকরের দরজা ব্যতীত।”

মৃত্যুর চার দিন পূর্বে রোজ বৃহষ্পতিবার রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামতিনটি বিষয়ের ওছীয়ত করেনঃ ১)  ইহুদ, খৃষ্টান ও মুশরিকদেরকে আরব উপদ্বীপ হতে বের করে দেয়ার ওছীয়ত করেন। ২) তিনি যেভাবে প্রতিনিধি প্রেরণ করতেন ঠিক ঐভাবে (তাঁর পরবর্তীতে) প্রতিনিধি প্রেরণের ওছীয়ত করেন।  ৩) সম্ভবতঃ কিতাব ও সুন্নাহ দৃঢ়ভাবে ধারণ করা। অথবা উসামা (রা) নেতৃত্বে সৈন্যদল প্রেরণ। অথবা উহা তাঁর এই বাণীঃ (ছালাত এবং তোমাদের অধিনস- কৃতদাসদের প্রতি লক্ষ রাখবে।) {তিরমিযী }

নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর অসুখ কঠিন আকার ধারণ করা সত্বেও তিনি লোকদের নিয়ে সমস্ত ছালাত পড়তে থাকেন, এমনকি মৃত্যুর চারদিন পূর্বের সেই বৃহস্পতিবারেও ছালাতে ইমামতি করেন। নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ঐদিন লোকদের নিয়ে মাগরিবের ছালাত আদায় করেন এবং والمرسلات عرفا অর্থাৎ সূরা আল মুরসালাত পাঠ করেন। তবে ইশার সময় রোগ আরও বৃদ্ধি পাওয়ায় তিনি মসজিদ অভিমুখে যেতে পারেননি। আয়েশা (রাঃ) বলেনঃ  নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জিজ্ঞেস করলেন, লোকেরা কি নামায পড়ে নিয়েছে? আমরা বললামঃ না, হে আল্লাহর রাসূল! ওরা আপনার অপেক্ষা করছে। তিনি বললেনঃ আমার জন্য বালতিতে পানি প্রস্তুত কর। আমরা তাই করলাম, তিনি গোসল করলেন। তারপর উঠে দাঁড়াতে গেলেন কিন্তু সংজ্ঞাহীন হয়ে গেলেন। সংজ্ঞা ফিরে পেলে জিজ্ঞেস করলেনঃ লোকজন কি ছালাত আদায় করে নিয়েছে? প্রথম বারের ন্যায় দ্বিতীয়, তৃতীয়বারও তিনি সংজ্ঞা হারালেন। শেষে তিনি আবূ বাকরের (রাঃ) নিকট লোক মারফত  নির্দেশ দিলেন, তিনি যেন লোকদের ছালাতে ইমামতি করেন।

শনিবার কিংবা রোববার দিন নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) নিজেকে কিছুটা হালকা বুঝতে পেরে দুই ব্যক্তির সাহায্যে যোহর ছালাত আদায় করার জন্য বেরিয়ে পড়লেন। তখন আবূ বাকর মানুষদের নামাযে ইমামতি করছিলেন, তিনি নবীজি (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কে দেখতে পেয়ে পশ্চাতে সরতে লাগলে নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাকে ইশারায় নিষেধ করে দেন। তিনি সাথের ঐ দুই লোককে বললেনঃ আমাকে তার পাশে বসিয়ে দাও। তারা তাঁকে আবূ বাকরের বাম পাশে বসিয়ে দিল। আবূ বাকর রাসুলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর নামাযের অনুসরণ করলেন এবং মানুষকে তাকবীর শুনালেন।

জীবনের শেষ দিনঃ

আনাস বিন মালিক বর্ণনা করেনঃ মুসলমানগণ সোমবার দিন ফজরের ছালাতে রত ছিলেন, আবূ বকর (রা) তাদের ইমামতি করছিলেন। হঠাৎ রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)  আয়েশার (রাযিঃ) কামরার পর্দা ফাঁক করে তাদের দিকে দৃষ্টিপাত করলেন এবং মুচকি হাঁসলেন। তারা সেসময় ছালাতের কাতারে ছিল। আবূ বকর (রা) (পিছের) কাতারে দাঁড়ানোর জন্য পশ্চাদ দিকে যেতে লাগলেন। ভাবলেন নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নামাযের জন্য বের হবেন। আনাস (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেনঃ নামাযরত মুসলিমগণ নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)কে দেখে খুশীতে আহলাদ হয়ে নামাযের ক্ষেত্রে বিপর্যয়ে পড়ার উপক্রম হয় (নামায ছেড়ে দেয়ার ইচ্ছা করে)। তখন নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাদের প্রতি ইঙ্গিত করে বললেন, তোমরা ছালাত পুরা কর। এরপর তিনি আবার কামরায় ঢুকে পড়লেন এবং পর্দা ঝুলিয়ে দিলেন।

তারপর নবীজী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর উপর অন্য কোন নামাযের সময় আর  আসেনি। সূর্য কিছুটা উঁচু হয়ে উঠলে তিনি ফাতিমাকে (রা:) ডেকে কানে কানে কিছু কথা বললেন। তিনি কেঁদে ফেলেন, আবার তাঁকে ডাক দিয়ে কানে কানে কিছু কথা বললে তিনি হেসে উঠলেন। আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) বলেনঃ আমরা তাকে পরবর্তীতে এসম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বললেনঃ নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাকে গোপনে বলেছিলেনঃ যে তিনি এখন যে ব্যথায় আক্রান্ত তাতেই ইন্তেকাল করবেন, তাই আমি কেঁদেছিলাম। আবার তিনি আমাকে গোপনে বলেছিলেনঃ আমি তাঁর পরিবার থেকে সর্ব প্রথম তাঁর সাথে মিলিত হব। তাই আমি হেঁসেছিলাম। ফাতিমা রাসুলের (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উপর মহা বিপদ আচ্ছাদিত হওয়া দেখে বলেনঃ  আহা আমার পিতা  কতবড় বিপদে! নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেনঃ আজকের দিনের পর তোমার পিতার উপর আর কোন বিপদ নেই।

নবীর (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)  ব্যথা বেশি হতে থাকে। বিষের প্রভাবও প্রকাশ লাভ করে যা জনৈক ইহুদী মহিলা খায়বারে’ ছাগলের সাথে মিশিয়ে দিয়েছিল এবং তিনি তা খেয়ে ফেলেছিলেন। শেষ মূহুর্তে মানুষকে তিনি উপদেশ দিতে গিয়ে বললেনঃ তোমরা নামাযের প্রতি খেয়াল রাখবে, তোমরা নামাযের প্রতি খেয়াল রাখবে  এবং তোমাদের অধিনস’দের ব্যপারে সতর্ক থাকবে। কথাটি তিনি কয়েকবার বলেছেন। (তিরমিযী প্রভৃতি)

মৃত্যুর পূর্বক্ষণঃ 

নবীর (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) মৃত্যুর সময় ঘনিয়ে আসা দেখে আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) তাকে দেহে ঠেস দিয়ে ধরে রাখলেন। তিনি বলতেনঃ  আমার উপর আল্লাহর অন্যতম নেআমত হল যে, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আমার ঘরে, আমার (পালার) দিনে আমার গলা ও বক্ষের মধ্যবর্তী স্থানে মাথা রেখে ইন্তেকাল করেছেন এবং আল্লাহ তায়ালা আমার ও তাঁর থুথুকে একত্রিত করেছেন। তাঁর মুমূর্ষু অবস্থায় আব্দুর রহমান বিন আবু বাকর (রা:) মেসওয়াক হাতে প্রবেশ করলেন, সেসময় আমি নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)কে আমার গায়ের উপর ঠেস দিয়ে ধরে রেখেছিলাম। আমি দেখতে পেলাম তিনি ওর দিকে তাকাচ্ছেন, বললামঃ মেসওয়াকটি কি আপনার জন্য নিব? তিনি মাথার ইশারায় হাঁ বললেন। আমি তাঁকে মেসওয়াক খানা দিলাম। উহা তাঁর নিকট শক্ত মনে হলে আমি বললামঃ আমি কি ওটাকে নরম করে দিব? তিনি মাথার ইশারায় হাঁ বললেন। আমি উহা (দাঁত দিয়ে) নরম করে দিলাম, উহা তিনি স্বীয় দাঁতের উপর ফিরালেন। অপর বর্ণনায় খুব সুন্দর করে তিনি মেসওয়াক করলেন তাঁর সামনে পানির ছোট পাত্র ছিল। তিনি উহাতে হাত প্রবেশ করিয়ে ভেজা হাত দিয়ে চেহারা মাসাহ করতে লাগলেন,এবং বলতে লাগলেনঃ লাইলাহা ইল্লাল্লাহ, নিশ্চয় মৃত্যুর বড়ই যন্ত্রনা(বুখারী)। মিসওয়াক করা শেষ করে তাঁর হাত বা অঙ্গুলী উপরে উঠালেন এবং  ঘরের ছাদের দিকে তাকালেন, তাঁর ওষ্ঠদ্বয় নড়ে উঠল, আয়েশা (রাযিঃ) তার মুখের কাছে কান পাতলেন।

সে সময় তিনি বলছিলেনঃ “হে আল্লাহ! আপনি যাদেরকে পুরস্কৃত করেছেন তাদের তথা নবী, সিদ্দীক, শহীদ সৎ ব্যক্তিদের সাথে আমাকে ও শামিল করে নিন। হে আল্লাহ! আমাকে ক্ষমা করুন, রহম করুন এবং সুমহান বন্ধুর সাথে মিলিয়ে দিন।”

শেষোক্ত বাক্যটি তিনি তিন বার বললেন এবং তার হাত মোবারক ঝুকে পড়ল এবং তিনি মহান বন্ধুর সাথে মিলে গেলেন। (ইন্না লিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজেউন)

এই দুঃখ জনক সংবাদ দ্র”ত ছড়িয়ে পড়ল, মদীনার চতুর্দিক যেন অন্ধকারা”ছন্ন হয়ে গেল। আনাস (রাঃ) বলেনঃ আমি ঐদিনের মত উত্তম ও উজ্জল আর কোন দিন দেখিনি যেদিন রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)  আমাদের নিকট শুভাগমন করেছিলেন। আর আমি ঐ দিনের মত দু:খজনক ও অন্ধকার দিন আর পাইনি যেদিন রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ইনে-কাল করেন। রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) মৃত্যু বরণ করলে ফাতিমা (রাঃ) শোকাহত হয়ে বলেনঃ হায় আব্বাজান!  যিনি প্রতিপালকের ডাকে সাড়া দিয়েছেন, হায় আব্বাজান! যার ঠিকানা হচ্ছে জান্নাতুল ফিরদাউস। হায় আব্বাজান! আমি তো আপনার মৃত্যু শোক সংবাদ  জিবরীল (আ:) কে শুনাচ্ছি।

আবূ বাকর (রা:) সুন্‌হ নামক আবাসস্থল থেকে ঘোড়ায় চড়ে ফিরে আসলেন। ঘোড়া থেকে নামার পর মসজিদে প্রবেশ করলেন। মানুষের সাথে কোন কথা না বলেই আয়েশা (রাঃ) এর ঘরে  প্রবেশ করে রাসূলের (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) দিকে গেলেন। সেসময় তিনি হাবিরা নামক স্থানের কাপড় দ্বারা আবৃত ছিলেন। তিনি নবীজির (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) চেহারা মুবারক হতে কাপড় সরিয়ে তার উপর ঝুকে পড়লেন। তাঁকে চুম্বন করলেন এবং কাঁদতে লাগলেন অতঃপর বললেনঃ আপনার জন্য আমার পিতা-মাতা কুরবান হোক, নিশ্চয় আল্লাহ আপনাকে দুবার মৃত্যু দিবেন না। আপনার উপর যে মরণ লিখা হয়েছিল তা হয়ে গেছে। এরপর আবূ বকর (রা) সেখান থেকে বেরিয়ে পড়লেন। ওমার (রাযিয়াল্লাহু আনহু) সেসময় মানুষের সাথে কথা বলছিলেন। আবূ বকর বললেনঃ হে ওমার! আপনি বসে পড়ুন। কিন্তু ওমার বসতে অস্বীকার করলেন। তখন আবূ বাকর (রা:) কথা বলতে শুরু করলেনঃ মানুষ এবার ওমার (রাঃ)কে ছেড়ে দিয়ে তাঁর দিকেই ঝুকে পড়ল। আল্লাহর প্রশংসার পর আবূ বাকর (রা:) বললেনঃ

হে লোক সকল! আপনাদের মধ্য থেকে যারা মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর ইবাদত করত তাদের যেনে রাখা উচিত যে মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) মৃত্যু বরণ করেছেন। আর তোমাদের মধ্যে যারা আল্লাহর ইবাদত করত তাদের যেনে রাখা উচিত যে আল্লাহ চিরঞ্জীব চিরস্থায়ী।  আল্লাহ বলেনঃ মুহাম্মাদ তো আল্লাহর রাসূল, তার পূর্বে অনেক রাসূল অতিবাহিত হয়েছেন। যদি তিনি ইন্তেকাল করেন বা নিহত হন তোমরা কি তোমাদের পশ্চাদে ফিরে যাবে? বস্তুত যে ব্যক্তি তার পশ্চাদে ফিরে যাবে সে আল্লাহর কোন ক্ষতি করতে পারবেনা। আল্লাহ অচিরেই কৃতজ্ঞদেরকে প্রতিদান দিবেন। (আলে ইমরানঃ ১৪৪)

ইবনুল মুসাইয়িব বলেনঃ ওমার (রাঃ) বলেন, আমি যখন আবূ বকর (রা) কে উক্ত আয়াতটি পাঠ করতে শুনলাম তখনই আমি অবস হয়ে গেলাম। আমার দুই পা আমাকে বহন করতে পারলনা। তার কাছে উক্ত আয়াত শুনে যমীনে পড়ে গেলাম এবং এক্বীন করে নিলাম যে নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) মৃত্যু বরণ করেছেন।

গোসল ও দাফন পর্বঃ

নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর কাফন্তদাফনের পূর্বে খেলাফত নিয়ে আলোচনা শুরু হল। মুহাজির ও আনছারদের মাঝে সাক্বীফায়ে বানী সায়েদাহ নামক স্থানে এবিষয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা শুরু হয়। পরিশেষে তারা আবূ বাকরের খিলাফতের উপর ঐকমত পোষণ করেন। এসব কাজেই সোমবারের বাকী অংশ অতিবাতি হয়ে যায়। নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর দেহ মুবারক হিবারা নামক স্থানের কাপড়ে আবৃত অবস্থায় তাঁর বিছনায় থাকে। তাঁর পরিবার ঘরের দরজা বন্ধ করে রাখে। রোজ মঙ্গলবার রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)কে তারা তাঁর দেহ থেকে কাপড় না খুলেই গোসল দিলেন। অতঃপর তিনটি সাদা সূতী কাপড়ে কাফন পরালেন। জামা ও পাগড়ী তাতে ছিলনা। তারপর জনগন খন্ড খন্ড জামাআত তথা ১০জন ১০জন করে ঐঘরে প্রবেশ করে তাঁর ছালাতে জানাযা আদায় করেন। নির্দিষ্ট ভাবে কেউ তাদের ইমামতি করেনি। প্রথমে তাঁর আত্মীয়-স্বজন অতঃপর মুহাজেরীন, তারপর আনছারগণ (রা:) তাঁর ছালাতে জানাজা আদায় করেন। পুরুষদের শেষে মহিলারা অতঃপর শিশু কিশোররা তাঁর ছালাতে জানাযা আদায় করে।

তারা নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)কে কোথায় দাফন করবেন এনিয়ে মতবিরোধ করলেন। তখন আবূ বকর (রাঃ) বললেনঃ আমি রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)কে বলতে শুনেছিঃ

“যে নবীই মৃত্যু বরণ করেছেন তাঁকে তাঁর মরণ স্থলেই দাফন করা হয়েছে।”

নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) যে বিছানার উপর মৃত্যু বরণ করেন আবূ তালহা তা গুটিয়ে দিলেন এবং তার নীচে মাটি খনন করে বুগলী ক্ববর তৈরী করলেন। ইহা ছিল মঙ্গলবার দিবাগত রাতের মধ্যাংশ। আল্লাহ আমাদের প্রিয় নবীজির উপর রহমত ও শান্তির ধারা বর্ষিত করুন।

শেষ কথা:

(এ লিফলেটটিতে মুলত: নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর ইন্তেকালের ঘটনা অবগত হওয়ার দাওয়াত পেশ করা হয়েছে, যার সাথে সংযুক্ত রয়েছে তৎসংলগ্ন ঘটনাবলী এবং তাঁর মহান উপদেশাবলী। যাতে করে তা থেকে শিক্ষনীয় বিষয়, উপকারিতা প্রভৃতি উদ্ভাবন করা সম্ভব হয়।

*ইহা শান্তনা স্বরূপ তাদের জন্য পেশ করা হল, যারা বিভিন্ন বিপদে পতিত, যাতে করে রাসুল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)কে হারানো মছীবতের কথা স্বরণ করে তাদের নিকট স্বীয় মছীবত হালকা অনুমিত হয় । কারণ নবীজির (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ইন্তেকাল হচ্ছে সব থেকে বড় মুছীবত।

ইমাম মালিক স্বীয় মুওয়াত্তায় আব্দুর রহমান বিন কাসিম হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন: “আমাকে হারানোর মছীবত যেন মুসলিমদেরকে বিভিন্ন মছীবতে শান্তনা দান করে।”

ইবনু মাজায় আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একদা মানুষের জন্য দরজা খুললেন বা পর্দা সরালেন। দেখতে পেলেন লোকজন আবূ বাকরের ইমামতিতে ছালাত আদায় করছে। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাঁদেরকে এই সুন্দর অবস্থায় দেখতে পেয়ে আল্লাহর প্রশংসা করলেন এবং আশা করলেন যে, আল্লাহ যেন (ছালাতের) এই অবস্থা তাদের মাঝে বিদ্যমান রাখেন। তিনি বললেনঃ হে লোক সকল! যদি কোন মানুষ বা মুমিন ব্যক্তি মুছীবতে আক্রান্ত হয় তাহলে সে যেন  আমাকে হারানো মছীবত দ্বারা  শান্তনা বোধ করে। কারণ আমার উম্মতের কেউই আমাকে হারানোর মছীবতের চেয়ে অন্য কোন বড় মছীবত দ্বারা আক্রান্ত হবেনা।

মূলঃ শাইখ ছফীউর রহমান মুবারক পুরী (রহ)

অনুবাদঃ আখতারুল আমান বিন আব্দুস্‌ সালাম

Facebook Comments Box
advertisement

Posted ১৩:০৮ | মঙ্গলবার, ০৬ মে ২০১৪

Swadhindesh -স্বাধীনদেশ |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

advertisement
advertisement
advertisement

এ বিভাগের আরও খবর

Advisory Editor
Professor Abdul Quadir Saleh
Editor
Advocate Md Obaydul Kabir
যোগাযোগ

Bangladesh : Moghbazar, Ramna, Dhaka -1217

ফোন : Europe Office: 560 Coventry Road, Small Heath, Birmingham, B10 0UN,

E-mail: news@swadhindesh.com, swadhindesh24@gmail.com