| বুধবার, ০২ এপ্রিল ২০১৪ | প্রিন্ট
আশরাফ আলী খান: রাজধানীর জাহাঙ্গীর গেইট সংলগ্ন শাহীনবাগ এলাকার বাসাটিতে ঢুকতেই ফুটফুটে আরোয়াকে চোখে পড়ল। প্রায় দুই বছরের মেয়েটি ঘরময় ছুটোছুটি করছে। প্রথম দেখায় আমার মতো সবাই তাকে জীবন্ত পুতুল হিসাবে ভুল করার কথা।
সেই বাসায় আগে থেকেই বসা ছিলেন স্থানীয় মুরুব্বীরা। আর বাইরে অপেক্ষমান আছেন অনেক নেতা-কর্মী। একে একে সাংবাদিকরা আসলেন। গুম হওয়া স্বজনদের কান্না ভারী হতে থাকে আস্তে আস্তে। শাহীনবাগ এলাকায় ৭ জনের মতো মানুষকে গুম করা হয়েছে। ঢাকা মহানগর বিএনপির আহবায়ক সাদেক হোসেন খোকা তাদের সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করলেন। স্বজনরা তাদের আপনজনকে ফেরত চান, অন্যকিছু নয়।
এদের মধ্যে গুম হওয়া একজনের বাবা তার ছেলেকে আইনের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে আইনের লোক হিসাবে র্যাবের হাতে তুলে দিলেন। র্যাবও বাবাকে বলেছিল, আপনার ছেলে রাজনীতি করে। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে আমরা আবার বাসায় ফেরত দিয়ে যাব। সেই বাবা এখন সেই বিশ্বাসটাকে নিজের জীবনের চরম বোকামী হিসাবে আফসোস করেন। এরপূর্বে র্যাবে বিশ্বাসী ছিলেন তিনি। তার বিশ্বাস রাখেনি র্যাব। এখন র্যাবের কাছে ছেলের লাশটা হলেও ফেরত চান তিনি।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের দেয়াল ঘেষে অবস্থিত শাহীনবাগ মহল্লার ৭/৮ জনকে গুম করার চারমাস অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। তাদের কেউ ফিরে আসেনি। আইনের গাড়ী, আইনের পোষাক এবং সবকিছু আইনের লোক করেছে বলে তারা সাংবাদিকদের বলেন। তাদের ধরে নেয়ার চাক্ষুস সাক্ষী আছে। কাউকে র্যাব-১, কাউকে পুলিশ-ডিবি পরিচয় দিয়ে বাসা থেকে বা রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে গেছে। কাউকেই আদালতে উঠানো হয়নি। তারা নাই হয়ে গেলেন। বিএনপির নেতাকর্মী হিসাবে সবার কমন পরিচয়।
নিউজ সংগ্রহের ফাঁকে আবার আরোয়াকে দেখলাম একটি পুতুল হাতে ছুটোছুটি করতে। একসময় ক্লান্ত হয়ে পুতুলটাকে পাশে রেখে হতাশাময় চোখে চারপাশ দেখছে সে। উপস্থিত এতগুলো মানুষকেও অবাক চোখে দেখছে। ততক্ষণে উপস্থিত সবাই জানল আরোয়ার পিতা গুম হয়েছে। তার বাবা সাজেদুল ইসলাম সুমন, ৩৮ নং ওয়ার্ড (বর্তমানে ২৫) বিএনপির সেক্রেটারির দ্বায়িত্বে ছিলেন। তিনি ও তার খালাতো ভাই একইদিনে হারিয়ে গেলেন।
একসময় সংবাদকর্মীদের কাজ শেষ হয়ে আসে। সেই বাসার অতিথি রুমে ল্যাপটপে বসে নিউজের বাকী কাজ যখন শেষ করছি তখন আরোয়া সে রুমে আসল। কিছুটা জানতে চাইলাম তার ব্যাপারে। স্বজনরা জানালেন এখন আরোয়া প্রতিদিন হাজারবার তার মায়ের কাছে বাবার কথা জিজ্ঞাসা করে। পিতা সুমনের বন্ধুরা বাসায় আসলে বাবা কোথায় জানতে চায় সে। সবাই আশ্বাস দেয় তোমার বাবা আসতাছে।
ছোট্ট এ মেয়েটির দুচোখে পিতৃ আদরের শূণ্যতা এখন সুস্পষ্ট। চুপচাপ মন খারাপ করে বসে আছে সে। মানুষের ভীড়ে তার বাবার নাম বহুবার উচ্চারিত হয়েছিল সেখানে। সবাই একটু একটু করে হলেও আদর করেছে তাকে।
কাজ শেষে সেখান থেকে ফিরে আসার সময় একটু কোলে নিতে চাইলাম ছোট্ট আরোয়াকে। কোনভাবেই সে কোলে আসতে চাইল না। যখন মনে করলাম তাকে জোর করা হচ্ছে তখনই হাল ছাড়লাম। এসময় সুমনের মহল্লার একবন্ধু আরোয়াকে লোভ দেখালেন তাতেই কাজ হল। বললেন, মা তুমি এ চাচ্চুর কোলে আসলে তিনি তোমার আব্বুর কাছে নিয়ে যাবেন। কোলে আসল আরোয়া। যে লোভটির কাছে আরোয়া বশ মানল সেখানে নিজকে বিশাল অপরাধী মনে হল। তার শূণ্যতা পূরণ কেউ কি করতে পারে? এ প্রশ্নটা উত্তর কোথায় পাই?
এভাবে প্রতিদিন শতশত আশ্বাস পাচ্ছে আরোয়া। তার কাছে সবচেয়ে লোভনীয় ও প্রত্যাশিত এ আশ্বাসের ঘাতে সেই ছোট্টমনটি এখন ক্ষতবিক্ষত। দুহাত বাড়িয়ে দুবছর বয়সী আরোয়া তার পিতার অপেক্ষায় আছে জিয়নে স্বপনে। কোলে উঠে একসময় সে আমার কাছে তার আবদার পেশ করে বসে, চাচ্চু তুমি আমার আব্বুকে আমার কাছে এনে দিবা? তার এ আবদারের জবাব কি হবে তা ভেবে আমার জবানি মুহুর্তেই বন্ধ হয়ে গেল। অচানক বেদনায় শান্ত্বনার ‘হ্যা’ শব্দটা কন্ঠ দিয়ে বের হয়নি। শুধু মাথা নাড়ালাম। তার শূণ্যতা পূরণে আমার সাধ্য থাকলে তার পিতাকে বর্তমান অবস্থান থেকে জোর করে ধরে এনে এ ছোট্ট বালিকার নীরব অথচ সুস্পষ্ট আবেদনটায় পূর্ণতা দিতাম। সেটা হোক না কোন সুসমাসাজ বেহেশত থেকে।
কোন পিতাই তার সন্তানের এমন শূণ্যতার আহবানে সাড়া না দিয়ে পারেন না। হয়তো সুমনও যেখানে আছেন সেখান থেকে তার মেয়ে আরোর প্রতিটি ডাক শুনে আসছে। হয়তো প্রতিমূহুর্তে তার অদৃশ্য শক্তিহীন হাতদুটো বাড়িয়ে দিচ্ছে মেয়ের প্রতি। এখন আরোয়ার অস্পষ্ট স্বপ্ন ছাড়া সুমন কোথাও ধরা দিতে পারেন না।
আরোয়াদের বাড়ী থেকে বের হয়ে এলাম দ্রুত। একটু দুরে গিয়ে এক জায়গায় স্থির হয়ে বসে পড়লাম। হৃদয় মোচড়ানো কোন একব্যাথা চোখ বেয়ে টলটলে বেড়িয়ে আসতে থাকে। আরোয়ার এ গভীর শূণ্যতা আর গুম শব্দটা এখন একইসূত্রে বাধা। এখন এসব ভিকটিম পরিবার তার আপনজনের দেখা তো দূরের কথা, এমনকি তাদের কবরস্থানে একবার ফাতেহা পাঠেরও যে সুযোগ নেই।
Posted ১০:০০ | বুধবার, ০২ এপ্রিল ২০১৪
Swadhindesh -স্বাধীনদেশ | admin