শুক্রবার ২৯শে মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১৫ই চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

আমি লজ্জা পাইনি! আপনি পেয়েছেন কি?

  |   সোমবার, ০৬ জানুয়ারি ২০১৪ | প্রিন্ট

গোলাম মাওলা রনি

golam maula rony

শীতের এই কুয়াশাচ্ছন্ন দিনে আপনাদের অনেকেরই হয়তো মন খারাপ, অনেকের মন ভারাক্রান্ত হয়ে আছে চাপাকান্নায়। আবার অনেকে হয়তো বিজয়ের আনন্দে ফেটে পড়তে চাইছেন। আমি নিতান্তই একজন অনুভূতিশূন্য ভাবলেশহীন মানুষ। তারপরও গত কয়েক দিনের ঘটনায় আমার একটু একটু ভাব এসেছিলো। কী সেই ভাব, সে কথাটিই বলছি।
আগে বলে নেই কেন আমি লজ্জা পাই না। কারণ, আমার লজ্জা শরম বা হায়া উধাও হয়ে গেছে। এটা হয়েছে আমার চেয়েও বড় বড় মানুষের বেহায়াপনা দেখে। দেশের নামকরা কবি, অধ্যাপক, সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবীরা তাদের বিবেক এবং বোধশক্তি পচা নর্দমার কাছে বন্ধক রেখে যখন বেহায়ার মতো ধেই ধেই করে নাচে, তখন আমাদের মতো ক্ষুদ্র মানুষের জীবন ধারণের জন্য লজ্জা নামক অলংকারটি বড়ই বেমানান এবং চরম মূল্যবান হয়ে পড়ে। এই দামি অলংকার নিয়ে লজ্জাহীন সমাজ চলাফেরা করা শোভনীয় নয়।
আমাদের মিডিয়া জগতের মহান পুুরুষেরা ইদানীং সিদ্ধান্ত নিয়েছেন- নৈতিকতার কারণ অন্য কর্তৃক কৃত অনৈতিক বিষয় সমূহ প্রকাশ করা যাবে না এবং মানবতার খাতিরে অন্য কর্তৃক কৃত অমানবিক বিষয় সমূহ প্রকাশ করা যাবে না। তারপরও ২/১টা মিডিয়া কিছু কিছু তামাসার খবর প্রকাশ করে ফেলে। এমনি একটি ঘটনা দেখে আমার ভাব এসে গিয়েছিলো ক্ষণিকের তরে।
একটি টেলিভিশন চ্যানেল কোনো এক ভোট কেন্দ্রের দৃশ্য দেখাতে গিয়ে বললো, সেখানে কোন ভোটার নেই। কিন্তু এই পর্যন্ত বললে বা দেখালে আমার কিছু হতো না। হঠাত্ করেই তারা দেখালো ভোটকেন্দ্রের মাঠে একটি মুরগি বিষ্ঠা ত্যাগ করছে। সেটির বিষ্ঠা ত্যাগের পরপরই একটি মোরগ ছুটে এলো এবং জোর করে মুরগিটির সঙ্গে তার প্রাকৃতিক কর্ম সম্পাদন করলো। এরপর ক্যামেরা তাক করা হলো ৬/৭ বছরের দুটি গ্রাম্য বালকের ওপর। উভয়ে গলাগলি ধরে ভোটের মাঠে এসেছিলো তামসা দেখার জন্য। তাদের মধ্যে একজনের পরনে প্যান্ট ছিল না। শীতের সকালে গায়ে সোয়েটার অথচ উন্মুক্ত পশ্চােদশ নিয়ে শিশুটি তার বন্ধুর সঙ্গে সাবলীলভাবে গলাগলি ধরে হাঁটছিলো। দুষ্ট ক্যামেরাম্যান কয়েকবার তার উলঙ্গ পশ্চােদশের দৃশ্যটি আমাকে দেখতে বাধ্য করলো। এরপরের দৃশ্য আরো অবাক করা, একটি কুকুর অথবা কুকুরী একাকী মাঠ দিয়ে হাঁটছিলো। সেটির পশ্চােদশ অথবা লজ্জাস্থান দিয়ে পেটের নাড়িভুঁড়ির কিছু অংশ বের হয়েছিলো।
আমি সকালের নাস্তা খেয়ে টিভিতে সারাদেশের ভোটের খবর দেখার সময় এসব দৃশ্যও দেখলাম। কেন জানি বমি বমি ভাব চলে এলো। আমি খুব অস্থির হয়ে পড়লাম, দুপুর একটা পর্যন্ত কোনো কেন্দ্রেই ভোটার নেই। ভালো লাগছিলো না। তার ওপর আবার কুকুরের পশ্চােদশের বীভত্স দৃশ্য। আমি জামা কাপড় পরে অফিসে আসার জন্য লিফটে উঠলাম। দেশের চলমান আন্দোলন ও সহিংসতার জন্য অফিস প্রায়ই বন্ধ থাকে। তারপরও আমি যাই। একা একা বসে বসে হা-পিত্যেস করি। বাসায় এসব করা যায় না, স্ত্রী এসে বাধা দেয়। ৫ জানুয়ারি দুপুর বেলাও মনে হলো, যাই অফিসে গিয়ে একা একা হা-পিত্যেস করে আসি।
টিভির ঐসব দৃশ্য মন থেকে মুছে ফেলার জন্য আমি মনে মনে আমার মানসপটে একটি পবিত্র মুখ কল্পনা করার চেষ্টা করলাম। কাকে বসাই সেই মানসপটে। এতো দেখি ভারী মুশকিল, কলঙ্কহীন মুখ পাওয়াই যাচ্ছে না কিংবা মনে আসছে না। অনেক কসরতের পর জলে ফোটা পদ্মের মতো অমলীন একটি পবিত্র মুখ আমার মানসপটে ভেসে এলো। তিনি হলেন এ শতাব্দীর মহাপুরুষ বর্তমান প্রধান নির্বাচন কমিশনার জনাব কাজী রকিব উদ্দিন আহমেদ। রকিব সাহেবের পবিত্র বদন হৃদয়ে ধারণ করে টিভিতে দেখা অস্বস্তিকর দৃশ্য ভুলে আমি বাসা থেকে বের হয়ে এলাম।
লিফট দিয়ে নামার সময় আমার এক প্রতিবেশী আমাকে একটি কৌতুক শুনালেন। বললেন, শুনেন রনি সাহেব; একটি গল্প শোনেন।
‘এক ছেলে তার প্রতিপক্ষের হাতে আচ্ছামতো জুতাপেটা খেয়ে বংশের লোকজনের নিকট সহানুভূতি পাবার জন্য বললো, অমুক বংশের ওমুক আমাকে জুতা দিয়ে পিটিয়ে অসম্মান করেছে। এই কথা শুনে বংশের মুরুব্বিরা বললো, সাবধান, অসম্মান করেছে এই কথা বলবি না। শুধু বলো জুতাপেটা করেছে। কারণ, আমাদের বংশের মান সম্মান এতো বড় আর এতো কঠিন যে, কিয়ামত পর্যন্ত জুতা মারলেও আমাদের অসম্মান হয় না।’
ভদ্রলোক কৌতুকটি বলে হা হা করে হাসতে লাগলেন এবং আমিও তার সঙ্গে হাসলাম। অনেকটা বেকুবের মতো, কিন্তু না বুঝেই।
ইদানীং যে আমার কী হয়েছে বুঝতে পারি না। টিভিতে কিছু লোকের কথা, অঙ্গভঙ্গি, ম্যানম্যানে কণ্ঠস্বরের হুমকি ধমকির প্যান-প্যানানি দেখলে মনে হয় ওইসব লোকের সারা শরীরে কেউ হয়তো মানকচুর রস মেখে দিয়েছে। ওদের চটচটে তৈলাক্ত টাকের বীভত্স রূপকথা বলার সময় থু থু ছিটার দৃশ্য কিংবা ঠোটের দুই প্রান্তে ফেনাযুক্ত থুথুর জঘন্য উপস্থিতিতে মনে হয় এই বুঝি টেলিভিশনের পর্দা ফুটে তারা বেরিয়ে এলো এবং আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাদের দুর্গন্ধ গায়ে মাখিয়ে দিলো।
এসব দৃশ্য হররোজ দেখতে দেখতে আমি অনুভূতি শূন্য হয়ে পড়েছি। ফলে লজ্জা পাবো কিভাবে? অফিসে এসে কিছু লিখার চেষ্টা করলাম। বাংলাদেশ প্রতিদিনে প্রতি শনিবার আমার একটি ধারাবাহিক ঐতিহাসিক উপন্যাস ছাপা হচ্ছে। অনেক পরিশ্রম আর যত্ন-আত্তি করে লিখি। ফলে প্রতিটি পর্বের জন্য তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে তা আবার পরিপাটি করে সাজানোর জন্য সময় নিয়ে চিন্তা করতে হয়। আগামী পর্বে অটোম্যান সাম্রাজ্যের মিলিটারি নিয়ে কিছু একটা লিখতে হবে। ভারতের মুঘল সম্রাট আকবর কনস্টান্টিনোপলে দূত পাঠিয়েছিলেন সেখানকার জেনিসারি বাহিনীর গঠন, কার্যপ্রণালী এবং সফলতার বিষয়ে বিস্তারিত জানার জন্য। এসব নিয়ে দলিলপত্র ঘাঁটতে ঘাঁটতে আমি পেয়ে গেলাম, পৃথিবীর মহামূল্যবান এক অছিয়তনামা, একটি রাজকীয় ফরমান।
অটোম্যান সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা সুলতান উসমান মৃত্যুর পূর্বে তার পুত্র এবং সিংহাসনের উত্তরাধিকারী ওরহানের নিকট একটি পত্র লিখে যান। পত্রটি বংশ পরম্পরায় সকল অটোম্যান সম্রাটদের নিকট সিংহাসনে অরোহণের পূর্বে হস্তান্তর করা হতো। পত্রের সেই চিরন্তন বাণীগুলোকে ধারণ করে অটোম্যানরা প্রায় ৭০০ বছর ধরে দুনিয়ার সবচেয়ে বৃহত্তম সাম্রাজ্যটি গৌরব এবং সম্মানের সঙ্গে শাসন করেছেন।
পাঠকদের জ্ঞাতার্থে চিঠিটি তুলে ধরলাম—
প্রিয়পুত্র!
তোমার জীবনের যাবতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ওপর সর্বদা ধর্মীয় বিষয়গুলোকে অধিকতর মর্যাদা প্রদান করিও। মনে রাখবে ধর্মীয় নীতি নৈতিকতার সাহায্যেই তুমি কেবল একটি শক্তিশালী নৈতিক রাষ্ট্র কাঠামো গড়ে তুলতে পারবে। ধর্মীয় বিষয়াদি তদারকির দায়িত্ব কখনও গুনাগার, পাপী, দায়িত্বজ্ঞানহীন, অনভিজ্ঞ, ভিন্নমতের মানুষ কিংবা অলস ব্যক্তিদের ওপর অর্পণ করবে না। এই ধরনের লোকজনকে ভুলেও রাষ্ট্রক্ষমতার কোনো পদে বসাবে না। কারণ, যে মানুষ তার সৃষ্টিকর্তা আল্লাহকে ভয় করে না সেই মানুষ কখনও আল্লাহর বান্দাদের সম্মান করতে জানে না। একজন পাপী যদি অনবরত পাপ করতে থাকে সেক্ষেত্রে সে কখনও কারো অনুগত হতে পারে না। পণ্ডিত ব্যক্তিগণ, ধার্মিক মানুষজন, শিল্পী এবং সাহিত্যিকগণ হলেন রাষ্ট্রের ভিত্তি। তাদের প্রতি সবসময় সম্মান, শ্রদ্ধা এবং দয়া প্রদর্শন করবে। সব সময় খুঁজে খুঁজে গুণী ব্যক্তিদের বের করে তাদের সঙ্গে সম্পর্ক-স্থাপন করবে এবং তাদেরকে অর্থবিত্ত দিয়ে নিজেকে সম্মানীত করার চেষ্টা করবে। এই সকল লোকের মাধ্যমে তোমার রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় নীতিমালা সমূহ বাস্তবায়ন করবে।
হে পুত্র, তুমি আমার জীবন থেকে শিক্ষা নাও। এই জনপদে আমার নেতৃত্ব ছিল অতিশয় দুর্বল। মহান আল্লাহর অনুগ্রহ নিয়ে আমি তোমাকে বর্তমানের গৌরবময় স্থানে রেখে গেলাম। অথচ এই স্থানে পৌঁছানোর কোনো যোগ্যতাই আমার ছিল না। তুমি আমার জীবনযাত্রা এবং কর্মপন্থা অবলম্বন করো, দ্বীনে মোহাম্মদীকে রক্ষা করো এবং বিশ্বাসী মানুষ ও ফুলকে সুরক্ষা করো এবং ভালবাসো। মহান আল্লাহর অধিকারের দিকে ভুলেও নজর দিবে না এবং আল্লাহর অধিকারের প্রতি সম্মান রাখবে এবং তার বান্দাদেরকে সম্মান করবে। আমি যেভাবে তোমাকে আদেশ ও উপদেশ দিয়ে গেলাম তদ্রুপ তোমার পরবর্তী উত্তরাধিকারীকেও তুমি এই ওছিয়তগুলো পৌঁছে দেবে। প্রতিটি কর্ম সম্পাদনে তুমি সর্বোচ্চ যত্মশীলতার সঙ্গে পরিশ্রম করবে, কখনো নিষ্ঠুর হবে না, প্রতিটি কর্মে স্বচ্ছতা এবং ন্যায়বিচার নিশ্চিত করবে এবং সবশেষে ফলাফলের জন্য মহান আল্লার ওপর নির্ভর করবে। শত্রুর আক্রমণ, প্রতিহিংসা, নিষ্ঠুরতা আর চক্রান্ত থেকে তোমার জনগণকে রক্ষা করবে। কখনো কারও সঙ্গে অসৌজন্যমূলক অসদাচরণ করবে না। জনগণকে সম্মান করবে এবং তাদের স্বার্থ রক্ষা করবে।
লেখক : আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য
(লেখাটি তার ফেসবুক স্ট্যাটাস থেকে নেয়া)

Facebook Comments Box
advertisement

Posted ১৬:৫২ | সোমবার, ০৬ জানুয়ারি ২০১৪

Swadhindesh -স্বাধীনদেশ |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

advertisement
advertisement
advertisement
Advisory Editor
Professor Abdul Quadir Saleh
Editor
Advocate Md Obaydul Kabir
যোগাযোগ

Bangladesh : Moghbazar, Ramna, Dhaka -1217

ফোন : Europe Office: 560 Coventry Road, Small Heath, Birmingham, B10 0UN,

E-mail: news@swadhindesh.com, swadhindesh24@gmail.com