| শুক্রবার, ০৩ ডিসেম্বর ২০২১ | প্রিন্ট
বিএম. এ আবদুল্লাহ :
বাগেরহাট জেলার মোরেলগঞ্জ উপজেলার ৩০৯ টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকদের ডিজিটাল হাজিরা মেশিন (বায়োমেট্রিক) ক্রয়ে ব্যাপক অনিয়ম দুর্নীতি ও মোটা অংকের অর্থ কেলেঙ্কারীর অভিযোগ উঠেছে। উপজেলা শিক্ষা অফিস ও কতিপয় অসাধু শিক্ষক নেতার সিন্ডিকেট মিলে বিভাগীয় নির্দেশনা না মেনে নয়-ছয় করে এ প্রকল্পের প্রায় ৪০ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে। তবে স্থানীয় এমপির অভিযোগ ও ডিভাইস ক্রয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট একাধিক চক্রের ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে টানা পোড়নে বর্তমানে এ কার্যক্রম আটকে যাওয়ায় হাজিরা মেশিন এখন শিক্ষকদের গলার কাঁটায় পরিনত হয়েছে ।
বাগেরহাট-৪ আসনের সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট মো. আমিরুল আলম মিলন স্বয়ং শিক্ষক হাজিরা ডিভাইস ক্রয়ের নামে সরকারি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মস্ত্রণালয়ের মন্ত্রী বারবার লিখিত অভিযোগ করেছেন। এমপি’র অভিযোগে জানা গেছে, মোরেলগঞ্জ উপজেলায় শিক্ষক হাজিরা ডিভাইস ক্রয়ের নামে কালক্ষেপন করা হয়। অনিয়মের কারনে অধিদপ্তর থেকে শিক্ষক হাজিরা ডিভাইস ক্রয় না করে টাকা ফেরত চাওয়া হয়। কিন্তু ডিভাইস সরবরাহ চক্র টাকা ফেরত না দিয়ে তড়িগড়ি করে সর্বোচ্চ ৬ হাজার টাকার ডিভাইস ১৮ হাজার টাকা ভাউচার দেখিয়ে বাকী টাকা আত্মসাৎ করেন। বিষয়টি জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসারকে অবহিত করা হলে তিনি কোন ব্যবস্থা না নিয়ে বরং উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তাকে দ্রæত কার্য সম্পন্ন করার নির্দেশ দেন।
অনুসন্ধানে জানাগেছে, ২০১৮-১৯ অর্থ বছরের উপজেলার ৩০৯ টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে জন্য স্লিপ প্রকল্পের বরাদ্ধ থেকে ডিজিটাল হাজিরা মেশিন (বায়োমেট্রিক) ক্রয়ের নির্দেশ দেয়া হয়। কিন্তু নির্দেশ অনুযায়ী মেশিন না কিনেই শিক্ষা অফিসের অসাধু কর্মকর্তা ও শিক্ষক নেতাদের ওই সিন্টিকেট উপজেলার প্রতিটি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের মাধ্যমে ২০ হাজার টাকার ভুয়া বিল ভাউচারও জমা দেওয়ায়। ২০২০ সালের প্রথম দিকে ১৮ হাজার টাকা মূল্য দেখিয়ে কয়েকটি বিদ্যালয়ে বায়োমেট্রিক মেশিন ক্রয় করে। বরাদ্ধ পাওয়ার ৩ অর্থ বছর অতিবাহিত হলেও হাজিরা মেশিন কেনা হয়েছে বলে কাগজে কলমে দেখালেও বাস্তবে মেশিন না কিনে ভুয়া বিল ভাউচার জমা দিয়ে বরাদ্দকৃত অর্থ আত্মসাতের চেষ্টার বিষয়টি অবগত হন প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ। যার প্রেক্ষিতে নতুন করে আর বায়োমেট্রিক মেশিন ক্রয় না করে এ প্রকল্পের অর্থ ২৯ জুলাই-২১ এর মধ্যে নির্ধরিত কোডে ট্রেজারি চালানের মাধ্যমে ফেরত দেয়ার জন্য উপজেলা শিক্ষা অফিসারকে নির্দেশ দেন জেলা প্রথমিক শিক্ষা অফিসার ।
২৬ জুলাই-২১ এর ওই আদেশের পর নতুন করে আর কোন ডিজিটাল হাজিরা মেশিন কেনা যাবে না মর্মে নির্দেশ থাকলেও তা অমান্য করে চলতি বছরের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে তড়িগড়ি করে অধিকাংশ বিদ্যালয় বায়োমেট্রিক ডিভাইস পৌছে দেয় ওই সিন্ডিকেট। যা এখনো চালু করা হয়নি। বিধান অনুযায়ী স্লিপ বরাদ্দের মালামাল ক্রয়ের সকল ক্ষমতা স্ব-স্ব বিদ্যালয়ে গঠিত স্লিপ কমিটির। কিন্তু এ সিন্ডিকেটটি আইন কানুনের তোয়াক্কা না করে ইচ্ছেমত নিম্নমানের হাজিরা মেশিন কেনার জন্য ৩টি কোম্পানির সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়। ওইসব কোম্পানির কাছ থেকে নিন্মমানের মেশিন কিনে বিদ্যালয়গুলোতে পৌছে দিয়ে ১৮ হাজার টাকা করে আদায় করে প্রায় ৪০ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নেয়ার পরিকল্পনা করে ।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষক-শিক্ষিকা জানান, কতিপয় শিক্ষিক নেতার চাপের মুখে এ বায়োমেট্রিক মেশিন নিতে তারা বাধ্য হয়েছেন। নেতাদের দেয়া ভাউচার অনুযায়ী ১৮ হাজার টাকা করে পরিশোধ করেছেনে। তারা আরো বলেন, প্রায় ৩ মাস অতিবাহিত হলেও মেশিন চালু করা হয়নি। মেশিনগুলো আলমীরাতে প্যাক করা অবস্থায় রয়েছে। যা যে কোন সময় অকেজো হওয়ার আশঙ্কায় রয়েছে।
এদিকে নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে ইচ্ছেমত নিম্নমানের হাজিরা মেশিন কেনায় সিন্ডিকেটের তুগলকি কর্মকান্ডের বিষয়ে বিভিন্ন মহল থেকে অবহিত হন স্থানীয় সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট মো. আমিরুল আলম মিলন। এ বিষয় তিনি উপজেলা শিক্ষা অফিসারের কাছ থেকে কোন সদুত্তর পাননি। জেলা শিক্ষা অফিসারকে অবহিত করলেও তিনি বিষয়টি আমলে না নিয়ে বরং মেশিন কেনার কাজ দ্রæত শেষ করার জন্য উপজেলা শিক্ষা অফিসারকে নির্দেশ দেন। জেলা-উপজেলা শিক্ষা বিভাগের এহেনো অনিয়মের বিষয়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী বরাবর লিখিত অভিযোগ করেন স্থানীয় সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট মো. আমিরুল আলম মিলন।
উক্ত অভিযোগে প্রেক্ষিতে সরেজমিনে তদন্তে করেন প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের উপপরিচালক (প্রকিউরমেন্ট) শেখ মো. রায়হান উদ্দিন। এসময়ে জেলা ও উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার, স্থানীয় যুবলীগ, সাংবাদিক ও শিক্ষক নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। তিনি উপস্থিত সকলের লিখিত স্বাক্ষ্য গ্রহনসহ সকল বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকদের লিখিত স্বাক্ষ্য দেয়ার জন্য নির্দেশ দেন। তদন্তকালে বায়োমেট্রিক হাজিরা মেশিন স্থাপনে নানা অসঙ্গতী পেয়ে অসন্তোস প্রকাশ করেন তদন্তকারী কর্মকর্তা।
উপজেলা শিক্ষা অফিসার মো.জালাল উদ্দিন খান বলেন, উপজেলা সকল বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকদের কাছ থেকে উপ-পরিচালক বায়োমেট্রিক ক্রয়ের বিষয়ে লিখিত স্বাক্ষ্য নিয়েছেন। সাবেক উপজেলা শিক্ষা অফিসারের সময়ে এ বায়োমেট্রিক ক্রয়ের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছিল। তবে শিক্ষা অধিদপ্তরের উপপরিচালক (প্রকিউরমেন্ট)তদন্ত প্রতিবেদনের বিষয়ে তিনি অবগত নন ।
জেলা শিক্ষা অফিসার মো. শাহ আলম বলেন, ২ বছর পূর্বে স্লিপের ভাউচার জমা দিয়ে বায়োমেট্রিক মেশিন ক্রয়ের সিদ্ধান্ত হয়। সে সময়ে অনেকে এ মেশিন ক্রয় করতে পারেনি। এ বছরে শিক্ষকরা তড়িঘড়ি করে সেসব মেশিন ক্রয় করেছে। তবে মেশিন ক্রয়ে কোন অনিয়ন হয়েছে কিনা তার জানা নাই। তিনি আরো জানান, বায়োমেট্রিক মেশিন ক্রয়ে অনিয়মের কারনে বাগেরহাট-৪ আসনের সংসদ সদস্যের অভিযোগের তদন্ত করেছেন শিক্ষা অধিদপ্তরের উপপরিচালক (প্রকিউরমেন্ট) শেখ মো. রায়হান উদ্দিন।
Posted ০৪:৩৩ | শুক্রবার, ০৩ ডিসেম্বর ২০২১
Swadhindesh -স্বাধীনদেশ | Rafiq Masum