| রবিবার, ০৪ মে ২০১৪ | প্রিন্ট
বিনিয়োগের আস্থা ফিরে আনতে হলে রাজনৈতিক প্রক্রিয়া ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে হবে। তা না হলে অস্বস্তি ও অনিশ্চয়তা কাটবে না। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) এমন মত দিয়ে বলেছে, পরিস্থিতি শান্ত হলেও অনিশ্চয়তার জন্য স্বস্তি ও আস্থার পরিবেশ ফিরে আসেনি। অর্থনীতিতে যতটা প্রাণ সঞ্চার হওয়ার কথা তা-ও হচ্ছে না। ফলে রাজস্ব আদায় কম হচ্ছে। ব্যক্তি বিনিয়োগ কম হচ্ছে। এডিপি বাস্তবায়নও কমে গেছে। রেমিটেন্স আসার হার কমেছে। পুঁজি পণ্যের আমদানি হ্রাস পেয়েছে। অনেকে বলেছিলেন, রাজনৈতিক পরিস্থিতি শান্ত হলে স্বস্তি আসবে। কিন্তু এ মুহূর্তে স্থবিরতা রয়ে গেছে। নতুন করে সম্পদের নিরাপত্তার ক্ষেত্রেও অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। ব্যক্তি জীবনে নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। যেটি বিনিয়োগের জন্য নেতিবাচক।
রোববার রাজধানীর ব্র্যাক ইন সেন্টারে আসন্ন ২০১৪-১৫ অর্থবছরের বাজেটে সিপিডির প্রস্তাবনা নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা জানান সংস্থাটির সম্মানিত ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। সংগঠনটির নির্বাহী পরিচালক ড. মোস্তাফিজুর রহমানের সভাপতিত্বে সংবাদ সম্মেলনে সিপিডির গবেষণা প্রস্তাব তুলে ধরেন প্রতিষ্ঠানটির গবেষণা পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন। এ সময় উপস্থিত ছিলেন অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম হোসেন, রিসার্স ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান প্রমুখ।
বাজটের বিষয়ে দেবপ্রিয় বলেন, বস্তুনিষ্ঠ ও স্বচ্ছ আর্থিক কাঠামোর বাজেট চাই। আসন্ন বাজেটের জন্য অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। আর্থিক কাঠামোয় বিশ্বাসযোগ্যতা ও প্রশাসনিক দক্ষতা ও সক্ষমতা আনার বিষয় সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ বলে জানান তিনি। তিনি বলেন, বাংলাদেশে বর্তমানে যে অবস্থা তাতে শুধু অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ নয় অভ্যন্তরীণ সঞ্চয়ের ওপরও প্রভাব ফেলছে। এ অনিশ্চয়তা কাটানোর জন্য একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন দাবি করে তিনি বলেন, বাংলাদেশে বর্তমানে যে অবস্থা সেটা চলতে থাকলে শুধু বিনিয়োগ নয়, অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ সঞ্চয়ের ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলবে। বিনিয়োগের পরিস্থিতি ও অর্থনীতির ধারা ফিরিয়ে আনতে হলে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন দরকার। তিনি আরও বলেন, বিনিয়োগের এ অনিশ্চয়তার ফলে দেশ থেকে অর্থ পাচারের প্রবণতা বাড়বে। অর্থ পাচারের প্রবণতা বাড়লে তা কিন্তু আগামী বাজেটেও প্রভাব ফেলবে।
উচ্চমাত্রার জিডিপির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সরকার ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য ৭.৩ শতাংশ জিডিপি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনৈতিক কাঠামোতে তা অসম্ভব। তবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড সঠিকভাবে কর উত্তোলন করতে পারলে ও অবকাঠামো উন্নয়নে স্বল্প সুদে বৈদেশিক ঋণ নিয়ে আসতে পারলে তা সম্ভব হবে।
মূল প্রবন্ধে আসন্ন বাজেটে জিডিপির লক্ষ্যমাত্রা ৬ শতাংশের নিচে নেমে যেতে পারে বলে দাবি করা হয়। এ প্রসঙ্গে ড. দেবপ্রিয় বলেন, যে কোন পরিস্থিতিতে ৬ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জনে যে সক্ষম সে আত্মতুষ্টির জায়গায় এক ধরনের ধাক্কা লাগছে। বাংলাদেশে যাই হোক না কেন, প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশ যে অর্জিত হয় সে নিশ্চয়তা এখন আর দেয়া যাবে না। এর মূল কারণ বিনিয়োগের পতন হওয়া। তিনি বলেন, গতবার জিডিপির শতকরা হারে প্রথমবারের মতো ১ শতাংশের পতন ঘটে। গতবার রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ বেশি ছিল বলে মোট বিনিয়োগে সেটাকে পুষিয়ে নিয়ে একটু ওপরে ছিল। এবার যদি রাষ্ট্রীয় ও ব্যক্তি বিনিয়োগ যদি দু’টিরই পতন ঘটে তাহলে প্রবৃদ্ধি আরও কমে যেতে পারে। আগামী বাজেটের চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে তিনি বলেন, বর্তমানে বিনিয়োগে যে প্রতিবন্ধকতা চলছে তাকে কাটিয়ে ওঠার ক্ষেত্রে সরকারের কাছে আর্থিক, প্রাতিষ্ঠানিক এবং রাজনৈতিক পরিস্থিতির স্থিতিশীলতা দরকার।
দেবপ্রিয় বলেন, অনেকে মনে করেছিলেন যদি রাজনৈতিক সহিংসতা শেষ হয় তাহলে হয়তো দেশে এক ধরনের স্বস্তি আসবে এবং অর্থনীতি আবার চাঙ্গা হবে। কিন্তু গত ৩-৪ মাসে সামগ্রিক আমদানি-রপ্তানি কিছুটা বাড়লেও পুঁজি পণ্যের আমদানি গত দু’মাসে কমে গেছে। তিনি বলেন, সবার মধ্যে ধারণা ছিল কোন রকম একটি নির্বাচন হয়ে গেলে অর্থনীতি আবার চাঙা হয়ে উঠবে। কিন্তু এ মুহূর্তে এটা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। তবে তার অর্থ এ নয় যে অর্থনীতি একেবারে সচল হয়নি। তার মতে, সাময়িক রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, যোগাযোগ ও সরবরাহ ব্যবস্থা সচল হওয়ার কারণে উৎপাদন ক্ষমতা ব্যবস্থা সচল হয়েছে। কিন্তু মধ্যমেয়াদি বড় ধরনের বিনিয়োগের ক্ষেত্রে যে ধরনের অস্বস্তি, অনিশ্চয়তা ছিল তা রয়ে গেছে। সম্পদের নিরাপত্তার ওপরে মানুষের আস্তা তৈরি হয়নি। ব্যক্তি জীবনের নিরাপত্তাও হুমকির মুখে পড়েছে। এ অবস্থা বজায় থাকলে শুধু বিনিয়োগ নয় সঞ্চয়ের ক্ষেত্রেও অনিশ্চিয়তা বাড়ে বলে মত দেন তিনি।
ফাহমিদা তার উপস্থাপনায় আসন্ন বাজেটে অবৈধ আয় বা সম্পদ বৈধকরণে কোন আর্থিক সুবিধার সুযোগ না দেয়ার দাবি জানান। তিনি বলেন, সিপিডির পক্ষ থেকে প্রতি বছরের মতো এবারও এ বিষয়ে বিরোধিতা করা হচ্ছে। যারা অবৈধ আয় বা সম্পদকে মূলধারায় নিয়ে আসার পক্ষে যুক্তি দিয়ে কথা বলে থাকেন, তাদের যুক্তি অর্থনৈতিক যুক্তিতে গ্রহণযোগ্য নয় বলে দাবি করেন তিনি। তিনি বলেন, বাস্তবে অবৈধ আয় বা সম্পদ বিনিয়োগের সুযোগ দেয়ার পরও তার দৃশ্যমান কোন অগ্রগতি হয়নি। এর মাধ্যমে কর ফাঁকি ও আইনের বরখেলাপের একটি সংস্কৃতি গড়ে ওঠে। এ সংস্কৃতি কোনভাবেই দেশের জন্য মঙ্গলজনক নয়। এর ফলে যারা প্রকৃত করদাতা তাদের প্রতি একটি অন্যায় ও শাস্তি বলে দাবি করেন তিনি। এ সুযোগ বারবার দেয়ার ফলে প্রকৃত করদাতার হার কমে যাবে। বাড়বে অবৈধ টাকা ও সম্পদ। রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে এ সুযোগ দেয়া উচিত নয় বলে মনে করেন তিনি। এক্ষেত্রে বিশেষ টাস্কফোর্স, জনমত গড়ে তোলা এবং কঠোর আইন প্রণয়নের দাবি জানানো হয় সংগঠনের পক্ষ থেকে।
ফাহমিদা তার বাজেট প্রস্তবে বলেন, সরকারের নির্দেশের পরও যে সব কোম্পানি ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান পুঁজিবাজারে অন্তর্ভুক্ত হয়নি তাদের উপর অতিরিক্ত ১০ শতাংশ কর আরোপের প্রস্তাব করেছে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। সে সঙ্গে খাতভিত্তিক বিশেষ প্রণোদনা বিশেষ মূল্যায়নের মাধ্যমে হওয়া উচিত বলে মনে করে সংগঠনটি।
গবেষণা প্রস্তাব উপস্থাপন করে ফাহমিদা খাতুন জানান, প্রতি বছরই বাজেটে বেশকিছু খাতে সরকার বিশেষ প্রণোদনা দিয়ে থাকে। আবার অনেক খাতে দীর্ঘদিন ধরে এ প্রণোদনা অব্যাহত থাকে। কিন্তু এ প্রণোদনার অর্থে বিনিয়োগ না বেড়ে তা কর ফাঁকির কাজে ব্যবহৃত হয়। তাই প্রণোদনার পরিমাণ না বাড়িয়ে তা পুনর্বিন্যাস করতে হবে। তিনি আরও জানান, সরকার প্রতি বছর পুঁজিবাজারে বিশেষ প্রণোদনা দিয়ে থাকে। কিন্তু অনেক সরকারি প্রতিষ্ঠান ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও কোম্পানিকে এ বাজারে আসার নির্দেশ দিলেও আসছে না। এসব কোম্পানি এখানে নিয়ে আসলে আর প্রণোদনা দরকার হবে না।
তাই সরকারের নির্দেশনার পরও যারা পুঁজিবাজারে আসেনি তাদের ওপর অতিরিক্ত ১০ শতাংশ কর আরোপ করলে এ সঙ্কট কেটে যাবে বলে মনে করে সিপিডি। ট্যাক্স হলিডে ব্যবস্থার কথা পুনর্বিবেচনার কথা জানিয়ে গবেষণা প্রস্তবে বলা হয়, প্রণোদনা ও সুবিধা চাইলেই সব খাতকে ঢালাওভাবে তা দেয়া উচিত নয়। যে সব শিল্প এখন প্রতিষ্ঠিত তাদের ক্ষেত্রে তা প্রত্যাহার করা দরকার। যেসব খাতে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ রয়েছে শুধু সেসব খাতেই প্রণোদনা দেয়া উচিত। এছাড়া পোশাক শিল্পে প্রণোদনার ক্ষেত্রে শ্রমিকদের অধিকারের বিষয়টি খতিয়ে দেখে পদক্ষেপ নিতে হবে বলে ও প্রতিবেদনে বলা হয়। আর চলতি অর্থবছরে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে যেসব ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প পিছিয়ে পড়েছে তাদের ব্যাংক ঋণসহ বিশেষ প্রণোদনা বাড়ানো দরকার বলে প্রস্তাব করেছে সংগঠনটি।
Posted ১৩:৫৪ | রবিবার, ০৪ মে ২০১৪
Swadhindesh -স্বাধীনদেশ | admin